বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লকডাউনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি রাখা জরুরি

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ১৩:১৭

একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব, তেমনি সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাও অসম্ভব নয়। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষ যদি আয় হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে, তবে তাদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সামনের দিনগুলোতে সরকারের সামনে মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সুচিন্তিত ও হিসেবি পদক্ষেপ গ্রহণ। নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের জন্য এখনই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ। আমরা আশাবাদী সরকার ঠিক পরিস্থিতি সামলে নেবে।

এক বছর পর আবার দেশে লকডাউন দেয়া হয়েছে। সরকার যে লকডাউনের নির্দেশাবলি দিয়েছে সেখানে এই কথারই প্রতিফলন দেখি, ‘আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’। সরকারের দিক থেকে এই কঠোরতা আর জনগণের দিক থেকে সচেতনতা দুইয়ে মিলে আমাদের সবার সুরক্ষা নিশ্চিত হোক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হোক। দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবন-জীবিকা যেন চ্যালেঞ্জে না পড়ে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সারা পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত কোভিড-১৯ এর ছোবলে। গত বছরের মার্চ থেকেই এর জন্য শুরু হয়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট যা এখনও প্রকট। আবারও চ্যালেঞ্জে আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এই জটিল পরিস্থিতিতে মহাসংকটে পড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। হতদরিদ্র, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামনে আবারও জীবিকার সংকট। খাদে পড়তে যাচ্ছে অসহায় মধ্যবিত্ত। মুখ বুজে সব সহ্য করা ছাড়া আর উপায় কী? আবারও করোনা-সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, মধ্যবিত্তের দুর্ভোগ ততই দুর্বিষহ হচ্ছে। কবে কখন যে এই অসহনীয় অধ্যায়ের অবসান হবে, আমরা তা কেউ জানি না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, ২০২০ সালে করোনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ২৪৮ জন (১০ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত)। একই সময়ে হৃদরোগে মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। অর্থাৎ করোনার চেয়ে হৃদরোগে ২১ দশমিক ৮৭ গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা গেছেন ৮৫ হাজার ৩৬০ জন।

তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে গত এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট এসব আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ বলে জানানো হয়েছে।

অনেকে বলতে পারেন করোনায় মৃত্যুর হার কম। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, করোনা একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। যা মানুষের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীর ক্ষতি করতে সক্ষম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীন এর হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এ রোগ প্রথম দেখা যায়। যা পরে সারা বিশ্বকে গ্রাস করে। এ রোগের সংক্রমণের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্বাসযন্ত্রের রোগের লক্ষণের মতো শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, জ্বর, কাশি এবং সহজে হাঁপিয়ে যাওয়া। রোগের সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে নিউমোনিয়া, সিভিয়ার একিউট রেসিপিটরি সিন্ড্রোম, কিডনির কাজ করা বন্ধ হয়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যু ঘটাচ্ছে অহরহ।

গত বছর করোনার অভিঘাতে চাকরিচ্যুত হয়েছিল শতকরা ৩৬ জন। অনেকের চাকরি থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত বেতন-ভাতা পাননি। তবে সংকটকালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সরকার। স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা চলমান রাখতে কিছুটা হলেও অবদান রেখেছিল।

গত বছর থেকেই জীবনযুদ্ধের এক কঠিন সময় যাচ্ছে আমাদের। করোনা সংকটে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই বিপদগ্রস্ত আছেন এখনও। এই নতুন লকডাউন ৭ দিনের জন্য, তবে পরিস্থিতি বলবে এর সময় আরও প্রলম্বিত হবে কি না। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের কষ্টের সময়ে তাদের সহায়তা করার জন্য কৌশলগুলো চিহ্নিত করার বিষয়ে সরকারের এখনই চিন্তা করা উচিত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন-কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

করোনার কারণে নতুন করে দারিদ্র্য বাড়ছে। নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে (বিআইডিএস, ২০২০)। করোনার প্রথম চার মাসেই বেকারত্ব বেড়েছিল ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়েছে (বিবিএস, ২০২০)। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পর্যাপ্ত নয়।

অভিবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও অক্টোবরে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরই মধ্যে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া ৭১ শতাংশ কমেছে (আরএমএমআরইউ, ২০২০)। পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন বেড়েছে। প্রায় ৫৮ শতাংশ নারী মনে করেন, মহামারিতে দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণেই সহিংসতা ও নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে (ব্র্যাক, ২০২০)।

করোনা অভিঘাতের আগেই যুবকদের অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুব বেকারত্বের হার ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিআইডিএস এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের প্রায় ৩৩ শতাংশই ছিল বেকার। আইএলও ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ১১ দশমিক ১৭ লাখ থেকে ১৬ দশমিক ৭৫ লাখ যুবক বেকার হতে পারেন।

বেশির ভাগ পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুরা এখন আরও বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা শারীরিক সহিংসতা, সামাজিক সমস্যার ঝুঁকিতে রয়েছে (সেভ দ্য চিলড্রেন, ২০২০)। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও আয় হ্রাস, নতুন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। লকডাউনে বস্তির প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারের প্রধান অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।

মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়াই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা যেকোনো সময় তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়টি হারাতে পারেন এবং যেকোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আয় না করে রাজধানীতে বসবাস করা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন।

মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেদের সহায়তার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করার জন্য নতুন কৌশলগুলো চিহ্নিত করার বিষয়ে সরকারের আরও চিন্তা করা উচিত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এই শ্রেণির মানুষ এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন যে, তারা তাদের দুর্দশার চিত্র অন্যদের কাছে কিংবা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে উপস্থাপন করতে চাইবেন না। তারা জীবন উৎসর্গ করবেন কিন্তু অন্যের কাছে সাহায্য চাইবেন না।

কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে এসব মানুষকে জীবন সংগ্রামে সহায়তা প্রদান করা সরকারসহ প্রত্যেক নাগরিকের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা সবাই জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সংকটের সময়ে মানুষকে সাহায্য করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও উচিত এসব মানুষকে চাকরিতে রেখে তাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসা।

একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব, তেমনি সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাও অসম্ভব নয়। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষ যদি আয় হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে, তবে তাদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সামনের দিনগুলোতে সরকারের সামনে মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সুচিন্তিত ও হিসেবি পদক্ষেপ গ্রহণ।

নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের জন্য এখনই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ। আমরা আশাবাদী সরকার ঠিক পরিস্থিতি সামলে নেবে। এর সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে; ভাবতে হবে আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে নিয়ে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং উদ্যোগের অভাবে যদি নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয় তবে সার্বিকভাবে দেশের সমাজ ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

পর্যটন, পরিবহন ও যোগাযোগ, ব্যাংক-বীমা, হোটেল ও রিসোর্টের মতো খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে রপ্তানিবাজার পড়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য আমাদের এখন নতুন নতুন চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

একদিকে যেমন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হবে চলমান কাজ শেষ করা, অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তাসহ দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রেখে কর্মসংস্থান ধরে রাখা, নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, বিকল্প আমদানি ও রপ্তানি বাজারের ব্যবস্থা করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি।

১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এদেশের ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে একত্র করে আর একটি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই সংকট মোকাবিলা করে এবং পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধার করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা আস্থা রাখি প্রধানমন্ত্রীর সকল প্রচেষ্টার ওপর।

লেখক: প্রাবন্ধিক-গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর