বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রূপকথা নয়

  • জাহীদ রেজা নূর   
  • ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ১০:৪৮

মানুষ কখনই শ্রেণিচ্যুত হতে চায় না। আরামের জীবন যাপনে ছেদ পড়লে রুখে দাঁড়ায়। অপরদিকে, যারা সর্বহারার জন্য রাজনীতি করেন, তাদের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে বাস্তবজীবনে এমন বিশাল পার্থক্য লক্ষ করা যায়, যে বিপ্লব তথা সাম্যবাদী বিপ্লবের প্রতিও এখন খুব একটা আস্থা রাখা যায় না। যৌবনের তপ্ত রক্ত এখনও শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার জন্য ঢেলে দেয় মন, কিন্তু বয়স একটু বাড়লেই, রক্তের তেজ স্তিমিত হয়ে এলেই তাদের একটা অংশ যে ডিগবাজিটা খায়, তা অবিশ্বাস্য।

আফ্রিকা নিয়ে আমাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। ইউরোপীয় ভাবধারা অনুযায়ী আফ্রিকাকে অন্ধকার মহাদেশ বলেই জেনে এসেছি আমরা। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানের জন্য আমাদের জনগণের একটা অংশ তাকিয়ে থাকে ইউরোপের দিকে, অন্য অংশ সৌদি আরবের দিকে। নিজদেশের অতীতের দিকেও কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে, তবে তাদের উপস্থিতি সমাজে বড় করে দৃশ্যমান নয়। এই সামগ্রিক বিবেচনায় আফ্রিকা কারো ভাবনায় আছে বলে মনে হয় না।

একটু মনোযোগ দিয়ে আফ্রিকার দিকে তাকালে এমন অনেক ঘটনাই চোখে পড়ে, যা ভাবনার খোরাক দেয় মনে। আফ্রিকা মানেই ইদি আমিন নয়, তুতু আর হুটসিদের খুনোখুনি নয়। সেখানে একটু আয়াসে চোখে পড়বে টমাস সাঙ্কারকে। আমরা তার কথা যখন শুনি, তখন আরও একজন মহান বিপ্লবীর সঙ্গে তাকে এক কাতারে দেখতে পাই।

আফ্রিকার ‘চে গুয়েভারা’ বলা হয় তাকে। বুরকিনা ফাসোকে দুলিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। গরিব মানুষের মনে স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন। এবং অভিজাতশ্রেণিকে বুঝিয়েছিলেন, তারা অকারণেই যে মর্যাদা পায়, সেটা তাদের প্রাপ্য নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষ হয়ে বাঁচার সময় হয়েছে।

বর্তমান বিশ্ব আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ কখনই শ্রেণিচ্যুত হতে চায় না। আরামের জীবন যাপনে ছেদ পড়লে রুখে দাঁড়ায়। অপরদিকে, যারা সর্বহারার জন্য রাজনীতি করেন, তাদের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে বাস্তবজীবনে এমন বিশাল পার্থক্য লক্ষ করা যায়, যে বিপ্লব তথা সাম্যবাদী বিপ্লবের প্রতিও এখন খুব একটা আস্থা রাখা যায় না। যৌবনের তপ্ত রক্ত এখনও শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার জন্য ঢেলে দেয় মন, কিন্তু বয়স একটু বাড়লেই, রক্তের তেজ স্তিমিত হয়ে এলেই তাদের একটা অংশ যে ডিগবাজিটা খায়, তা অবিশ্বাস্য।

টমাস সাঙ্কারকেই বেছে নিয়েছি আজকের লেখার জন্য। তাকে যতটুকু জানতে পারি, তাতেই মুগ্ধ হই। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি ভাবনাও বিচলিত করে—সত্যিই যারা মানব কল্যাণের জন্য জীবন সঁপে দেন, তাদের সবার জন্যই কি একই পরিণতি বিরাজ করছে?

আগের কথা থেকেই শুরু করি

আপার ভোল্টা নামে একটা দেশ ছিল একদিন। সেই দেশে ১৯৮৩ সালের ৪ আগস্ট একটি অভ্যুত্থান হয়েছিল। দেশটিতে কিছুদিন পর পরই অভ্যুত্থান হতো, একজনের বদলে অন্যজন আসত ক্ষমতায়, ফলে দেশের মানুষের কাছে তা গা–সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ১৭ বছরের মধ্যে এটা ছিল চতুর্থ অভ্যুত্থান। ক্ষমতা দখল করেছিল ন্যাশনাল আর্মির গৃহবন্দি ক্যাপ্টেন টমাস সাঙ্কারের অনুসারীরা। টমাস সাঙ্কার ছিলেন মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সমর্থক। সাঙ্কার ক্ষমতায় এলেন এবং এসেই দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখলেন বুরকিনা ফাসো, যার অর্থ ‘যে দেশের মানুষকে কেনা যায় না’। দেশের মানুষ অবশ্য শুরুতেই এর মর্ম বুঝতে পারেনি। তারা ভেবেই নিয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর যা হয়, তাই হবে। বড় বড় কথা হবে। দুর্নীতি উচ্ছেদের শপথ নেয়া হবে। আগের সরকারের নামে কুৎসা রটানো হবে। গ্রেপ্তার করা হবে পূর্ববর্তী সরকারে থাকা লোকজনকে, দুর্নীতির পাহাড় গড়েছিল যারা, তারা কোনো এক সুযোগে ইউরোপ বা আমেরিকায় পালাবে ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে। তারপর যে–ই কে সে–ই। সরকারের লোকেরা নিজেরাই হয়ে উঠবে সেরা দুর্নীতিবাজ।

আমলারা চাষের ক্ষেতে

জনগণ ভুল করেছিল। তাদের অনেক কিছুই দেখার বাকি ছিল। সাঙ্কার প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ বেতন ২ হাজার ডলার নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। সেনাবাহিনীতে যে বেতন পেতেন, সেই ৪৫০ ডলারই নিতে থাকলেন সম্মানী হিসেবে। বাকিটা পাঠিয়ে দিলেন এতিমখানায়।

এরপর যা করলেন, তার জন্য বুরকিনা ফাসো তো নয়ই, আফ্রিকাও নয়, ইউরোপের অনেক দেশই যার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট মার্সিডিস গাড়িগুলো বিক্রি করে দিলেন, তার জায়গায় কিনলেন রেনাল্ট–ফাইভ নামের স্বল্প তেল খরচ করা গাড়ি। আমলাদের বেতন কমালেন। আমলারা সরকারি সফরে যেতেন বিজনেস ক্লাসে, সেটা বাতিল করলেন। ইকনমি ক্লাস বরাদ্দ হলো তাদের জন্য। প্রতিবেশী দেশগুলোয় সফরে গেলে প্রেসিডেন্ট সাঙ্কার সাধারণ বিমানের ইকনমি ক্লাসের টিকিট কাটতেন।

প্রচণ্ড গরম, কিন্তু নিজের অফিসে তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র রাখেননি। ‘দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি এয়ার কন্ডিশনের সুবিধা না পায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সে সুযোগ নেয়ার চেয়ে লজ্জানজক আর কিছুই হতে পারে না। সরকারি কর্মকর্তাদের বলা হলো, দামি ইউরোপীয় পোশাক পরার দরকার নেই, পরুন দেশে তৈরি সুতির পোশাক। বড়দিনের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের বলা হলো, দরিদ্রদের জন্য বেতন উৎসর্গ করতে।

অকাজে সময় নষ্ট করা কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পাঠালেন খামারে কিংবা চাষের ক্ষেতে কাজ করতে। পাঠালেন গরু চরাতে। বললেন, ‘এ সব অভিজ্ঞতা না থাকলে সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে জানবে, দেশের মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করে?’

মন্ত্রণালয়ে প্রেসিডেন্টের ছবি টানাতে নিষেধ করে দিলেন সাঙ্কারা। বললেন, ‘আমার চেহারা ঝুলিয়ে কী হবে? আমাদের দেশে ৭০ লাখ এ রকম মানুষ আছে।’

আমলাদের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু তারা তখনও বোঝেননি, এটা কেবল শুরু। সাঙ্কার নির্দেশ দিলেন, দেশের সকল পুরুষের অন্তত একদিন বাজারে যেতে হবে, খাবার–দাবার কিনতে হবে এবং রান্না করে সংসারের অন্য যারা আছে, তাদের খাওয়াতে হবে। স্ত্রীকে অনেক যত্ন করে খাওয়াতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, তাকে ভালোবাসেন, তার জীবনটা সহজ করতে চান, বুঝতে চান, সংসার জীবনটা সন্তান লালনপালন কত কষ্টকর কাজ। বুঝতে কষ্ট হয় না, ৮ মার্চ বুরকিনা ফাসো উৎসব হিসেবেই পালন করে।

এবার রাষ্ট্রীয় সংস্কার। জোতদার বা জমিদারশ্রেণির কাছ থেকে জমি নিয়ে তা চাষ করতে দেয়া হলো দরিদ্র কৃষককে। দেখা গেল, উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণ। ঘুচল খাদ্যাভাব। মঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা তিরোহিত হলো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পণ্যসাহায্য নেয়া বন্ধ করলেন প্রেসিডেন্ট। বললেন, ‘পৃথিবীতে এমনি এমনি কিছু হয় না…যে তোমার খাবার জোগায়, সে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করে’। একটা দারুণ কথা বলেছিলেন সাঙ্কার, ‘আফ্রিকা পশ্চিমাদের ঋণের টাকা শোধ না করলেই পারে। এটা কতটা তাজ্জব ব্যাপার, গরিব আর শোষিত মানুষ তার সব টাকা দিয়ে দিচ্ছে ধনী শোষকদের হাতে!’ রাজধানীতে প্রথম সুপার মার্কেটও তৈরি করলেন তিনি। দাম বেঁধে দিলেন।

দুর্নীতির ক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখি। ঘুষ খায় যারা, তাদের সতর্ক করার জন্য ব্যবস্থা নিলেন। ১০০ ডলার ঘুষ খেলে তার শাস্তি হতো ১০ বছরের জেল।

দেশ যেন মরুভূমিতে পরিণত না হয়, সে জন্য তিনি ২৫ লাখ গাছ লাগালেন। শিশুদের জন্য করলেন ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা।

একটি দেশে যখন এ রকম ভাবনাচিন্তা এবং কাজ হচ্ছে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব কি চুপ করে বসে থাকতে পারে? দেশটা তো আগে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। সুতরাং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ রকম একজন প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেয়া তো তাদের ‘ঈমানি’ দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল। বলা হয়, চক্রান্ত করার জন্য ফ্রান্স খরচ করেছিল ৫০ লাখ ডলার। বুরকিনা ফাসোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল, যারা এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। কেন যোগ দিয়েছিল, সে কথা বোধ করি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। প্রেসিডেন্টের নির্দেশাবলির কারণে ‘অপমানিত’ লোকজন তো কম ছিল না। সেনাবাহিনীর মধ্যেও অনেকে মনে মনে সাঙ্কারের বিরোধিতা করে। কারণ, প্রতিবেশী দেশ মালির সঙ্গে যুদ্ধের সময় সাঙ্কার মালির সাধারণ মানুষদের ওপর বোমাবর্ষণ করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে যা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বুরকিনো ফাসোতে তা ঘটল ১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর।

রাজধানী উয়াগাদুগুর টমাস সাঙ্কারের বাড়িতে হামলা করল সেনাসদস্যরা। তাদের নেতৃত্ব দিল সাঙ্কারেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সে সময়ের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন ব্লেইজ কমপাওরে। সাঙ্কারাকে সেখানেই গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হলো। লাশ কয়েক টুকরো করে বেনামি কবরে সমাহিত করা হলো।

সাঙ্কারার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। দেখা গেছে, তার শরীরে তিন ধরনের অস্ত্র থেকে মোট ১২টি গুলির চিহ্ন। ব্লেইজ কমপাওরে চেষ্টা করেছিলেন সাঙ্কারাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করতে। কিন্তু বিফল হয়েছিলেন। সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল একটা ভাঙা পেউগিয়ট গাড়ি, ভাঙা রেফ্রিজেটর, তিনটি গিটার, চারটি বাইসাইকেল। সুইস ব্যাংকে কোনো টাকা ছিল না, ছিল না কোনো রোলস রয়েস গাড়ি। ছিল না সোনাদানা, হীরা জহরত!

ব্লেইজ কমপাওরে তার জনগণকে বলেছিলেন, সাঙ্কারার কমিউনিস্ট সরকারের জায়গায় তিনি সত্যিকারের গণতন্ত্র উপহার দেবেন। গণতন্ত্র দেয়ার কথা বলে ব্লেইজ ক্ষমতায় থাকলেন ২৭ বছর, স্বৈরশাসক হয়ে। সাঙ্কারা মারা গেলেন। কিন্তু তিনি আফ্রিকার চে গুয়েভারা নামে টিকে থাকলেন আফ্রিকার জনগণের মনে।

বর্তমান রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ ধরনের নেতা পাওয়া কঠিন।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর