বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লকডাউন, জীবন-জীবিকা ও সরকারের দায়বদ্ধতা

  •    
  • ১০ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:৫৮

দেশের এই জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার অনুমোদন পেতে তিন দিন লাগাটা এই মুহূর্তে সবার জন্য কত যে ক্ষতিকর, তা হয়তো আইনপ্রণয়নকারীরা বুঝতেই পারেননি। এ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে যে ঘোষণাগুলো দেয়া হলো, সেগুলোও ছিল অত্যন্ত খাপছাড়া ও অকার্যকর।

২০২০ সালে প্রথমবার করোনা হানা দিলে মানুষ যেমন ভয় পেয়েছিল, তেমনি সরকারও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তা মোকাবিলার চেষ্টা করেছিল। সরকার সে সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে লকডাউনের বিকল্প ব্যবস্থা নেয় ও পাশাপাশি মানুষের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য প্রণোদনা ঋণের ব্যবস্থাও নেয়। যদিও এসব ব্যবস্থায় নানান ভুলত্রুটি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে।

সে সময় সরকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক করতে তেমন কিছু না করতে পারলেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য বেশ কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিল। পাশাপাশি প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রত্যেক জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে এলাকাভিত্তিক সমস্যা সমাধানের যথেষ্ট চেষ্টা করেন।

এবার ২০২১-এর মার্চ মাসে করোনার তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানল। মার্চের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে শুরু করল যে বুঝতে বাকি রইল না, এবারের ধাক্কাটা আরও ভয়াবহ হবে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি এক ভয়াবহ রূপ নিল, কিন্তু কেন যেন সরকারকে অত্যন্ত নির্লিপ্ত দেখা গেল।

করোনার ঊর্ধ্বগামী পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচণ্ড হইচই শুরু হলে সরকার সংবিৎ ফিরে পেলেও কেমন যেন এলোমেলো আচরণ শুরু করে। যখন মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করে তখন হঠাৎ করেই সরকার সাত দিনের জন্য লকডাউনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু যেদিন থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলো, বলা হলো তার তিন দিন পর সেই লকডাউনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেবেন।

দেশের এই জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার অনুমোদন পেতে তিন দিন লাগাটা এই মুহূর্তে সবার জন্য কত যে ক্ষতিকর, তা হয়তো আইনপ্রণয়নকারীরা বুঝতেই পারেননি। এ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে যে ঘোষণাগুলো দেয়া হলো, সেগুলোও ছিল অত্যন্ত খাপছাড়া ও অকার্যকর। যেমন একদিকে বইমেলা চালু, অন্যদিকে দোকানপাট বন্ধ, আবার অফিস-আদালত খোলা তো পরিবহন বন্ধ, অটোরিকশা, রিকশা, বাস সব চালু তো রাইড শেয়ার বন্ধ, কলকারখানা খোলা তো হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ।

সব মিলিয়ে সংক্রমণ রোধে যে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে হবে এবং শহরে জনসমাগম রোধ করতে হবে, সেই ব্যবস্থা নেয়ার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। বরং হঠাৎ করে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যার প্রতিবাদে মানুষ পথে নেমে আন্দোলন শুরু করল।

সরকারের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ল। এই অবস্থায় সংক্রমণ যখন হু হু করে বাড়ছে তখন বাধ্য হয়ে সরকার আবার দোকানপাট সবকিছু খুলে দিল।

গত বছরের শুরুতে করোনার প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতি ধরে রাখতে সরকার প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছিল, যা পুরোটাই ছিল এক প্রহসন। এই অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো কাজেই আসেনি।

সব ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হওয়া দুর্দশাগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দকৃত ওই প্রণোদনার অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের ভুল নীতির কারণে ব্যাংকগুলো যা করেছে সে কথা উল্লেখ না করলেই নয়; ১) ব্যাংক ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে এই প্রণোদনা ঋণ দেয়ার সরকারি নির্দেশ থাকার কারণে ব্যাংকগুলো শুধু তাদের ঘনিষ্ঠ ক্লায়েন্টদের এই সুবিধা দিয়েছে। ২) আরেক শ্রেণির লোকদের ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, যা দিয়ে তারা নিজেদের পুরনো খেলাপি ঋণের খাতা পরিষ্কার করেছে। অর্থাৎ আগে যারা খেলাপি ছিল তাদের এই প্রণোদনা ঋণ অনুমোদন করে সেই অর্থ দিয়ে তাদের আগের ঋণের টাকা সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের খালি হাতে বিদায় করেছে। ৩) ঋণ বিতরণের সময় সরকারের প্রণোদনার ৪% এর ঋণের অংকের সঙ্গে নিজেদের ৯% এর অংকের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য করেছে বিপদগ্রস্ত লোকদের। এর ফলে ঋণ গ্রহিতাকে সুদের হার গুণতে হয়েছে ৬.৫% এবং এর সঙ্গে সরকারের দেয়া ভর্তুকির ৪% নিয়ে ব্যংকগুলো চাতুর্যের সঙ্গে ঠিকই ১০.৫% লাভ করে নেয়। এই ঠকবাজির মধ্যে পড়ে প্রণোদনার অর্থ ব্যবসায়ীদের সামান্যতম কাজেও আসেনি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো দেশে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি যারা, অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা, তারা ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনি।

এখন আলোচনায় আসা যাক, বর্তমান লকডাউন বা সাধারণ ছুটি বিষয়ক সংকট সমাধানের উপায় নিয়ে। সরকারের এত বিশেষজ্ঞ, এত উপদেষ্টা, এত পরামর্শক আছেন, অথচ তাদের কেউ প্রত্যেক নাগরিকের কথা চিন্তা করে এই সংকট সমাধানের উপায় বের করার বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ সরকারকে দেননি। এবার দেখা যাচ্ছে সরকার যেন করোনার কাছে এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণই করেছে।

তবে আমাদের বাঁচতে হলে এই মুহূর্তে সব কিছু বন্ধ করে সবাইকে ঘরে ঢোকানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই তা মানতেই হবে।

যদি সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের করোনা সংক্রমণ রোধে সবাইকে ঘরে আটকে সৎ নিয়তে সবাইকে ভালো রাখতে চায় তাহলে গত বছর যেই অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল তার চেয়ে কম অর্থেই অত্যন্ত সফল ভাবে তা করতে পারবে।

দেশে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীর মোট সংখ্যা প্রায় এক কোটি ও দেশের সব শহরে ব্যবসায় নিয়োজিত কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি মানুষ। দেশে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাদের পুঁজি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী যাদের পুঁজি এক লাখ টাকা থেকে ৬০ লাখ টাকা, তাদের সংখ্যা ২০ লাখ। এবং ১ কোটি টাকার চেয়ে বেশি পুঁজির ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২০ লাখ। সেই হিসেবে প্রাথমিক ভাবে এক মাসের জন্য লকডাউন দিলে সরকার যদি ৬০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৮ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়, তাহলে ৪৮০ কোটি টাকা দিতে হবে, আর ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের যদি তাদের কর্মচারীদের অর্ধেক বেতন, প্রতিষ্ঠানের ভাড়া পাশাপাশি নিজেদের জীবন ধারণের জন্য ১ লাখ টাকা করে প্রদান করা হয় তাহলে সরকারকে ২০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে।

এর বাইরে অন্যান্য পেশার মানুষ ও হতদরিদ্র যারা বিভিন্ন শহরে জীবিকার সন্ধানে আসে তাদের সহায়তার জন্য আরো ৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক মাসে মোট সর্বোচ্চ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন, আর যদি তা কোনো কারণে দুমাস টানতে হয় তাতে ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের কিস্তি প্রদান বিলম্বসহ অন্যন্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা নিয়ে সংকট নিরসনের পদক্ষেপ নিতে পারে। অনুদানের অংক এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সবাইকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে কিছুই নয়। এই টাকা দেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা অথবা খেলাপি ঋণের টাকার চেয়ে অনেক কম। পক্ষান্তরে সরকার এই টাকা দিয়ে সবার জীবিকার ব্যবস্থা না করলে শক্ত লকডাউন কার্যকর করা কখনোই সম্ভব হবে না।

সরকার যদি লকডাউন পরিস্থিতি সুন্দরভাবে মোকাবেলা করতে চায় তাহলে তাকে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত নির্দেশ প্রদান করতে হবে। যেমন যারা বাসা, দোকান বা অফিস ভাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের বিষয়টিও দেখতে হবে। দেখা যায় করোনার উসিলায় অনেক অসাধু ভাড়াটিয়া মাসের পর মাস ভাড়া না দিয়ে জায়গা ব্যবহার করছে। সরকার যদি প্রত্যেক দোকান ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের লকডাউন বা বন্ধ কালীন সময় তাদের মার্কেট মালিক, দোকান মালিক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাড়িওয়ালাকে অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দেয়ার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয় এবং শর্ত দেয় যে এই সময় কেউ ভাড়া করা জায়গার অংশ বা পুরোটা ছাড়তে পারবে না। তাহলে আয় কম হলেও ভাড়ার উপর যারা জীবন যাপন করছেন তারাও করোনাকালে বিপদগ্রস্ত হবে না। এসব দেখভালের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অত্যন্ত কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।

সরকার সব ব্যবসায়ী সমিতি, স্থানীয় প্রশাসন, পৌর কর্পোরেশন ইত্যাদির সমন্বয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের তালিকা করে সমস্ত দলিলাদি পরীক্ষান্তে এই প্রণোদনা দিতে পারে।

অত্যন্ত সুচারুরূপে আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেই সরকার এই আধাখেঁচড়া লকডাউনের দ্বিধাগ্রস্ততা থেকে বেড়িয়ে এসে কঠিন শাস্তির বিধান রেখে কার্যকর লকডাউন দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে৷

লেখক: বাংলাদেশ প্রতিনিধি, টিভি ফাইভ মন্ড (ফ্রান্স)

এ বিভাগের আরো খবর