বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় দায়হীন প্রশাসন, ভয়হীন জনতা

  •    
  • ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০৮:২৭

স্বাস্থ্য খাতে বিশেষত করোনা মোকাবিলায় সীমিত বাজেটেও উদ্যোগগুলো কেমন নেয়া দরকার, তা নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অন্তত বাস্তবায়িত হবে সে প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অমূলক ছিল না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই বলেছেন, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউটা প্রথমটার চেয়ে মারাত্মক হয়ে থাকে। কে শোনে কার কথা! প্রথমবার ছিল দম্ভ। আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাক্বালে আত্মতৃপ্তি। আমরা করোনা জয় করতে পেরেছি, বাকি সবকিছুই জয় করতে পারব।

করোনায় ভয়াবহতা বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয় ইউরোপ, আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারতেও বাড়ছে মৃত্যু। ভারত এবং ব্রাজিলে মৃত্যু গত বছরের রেকর্ড অতিক্রম করছে। আর এক দিনে এত মৃত্যু বাংলাদেশেও গত বছর ঘটেনি। গত বছরের তুলনায় সংক্রমণ, শনাক্ত ও মৃত্যু তিনটাই বেশি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে।

টানা কয়েক দিন মৃত্যু ৬০ জনের বেশি এবং এক দিন তা ৬৬ জনে উন্নীত হয়েছে আর শনাক্ত ৭ হাজারের বেশি বলে সরকারি ঘোষণায় বলা হচ্ছে। গত বছর ৩০ জুনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক, ৬৪ জন। নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে বেশি, নমুনা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২২ শতাংশের মতো কিন্তু মৃত্যু, শনাক্ত বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারি ঘোষণা কেন যেন আস্থা অর্জন করতে পারছে না। এ পর্যন্ত ১০ হাজারের মতো মৃত্যুবরণ করলেও অনেকেই বলছেন সংখ্যা হয়তো আরও বেশি।

ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে রোগী নিয়ে ছুটছেন স্বজনেরা। তাদের উদ্বেগ, আশঙ্কা, অসহায়ত্ব যে কেমন তা ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ বুঝবেন না। শ্বাসকষ্ট হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন অক্সিজেন। আর তা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করতে গেলে প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। সেটা পাওয়া যাবে কোথায় বা কোন হাসপাতালে? হাসপাতালের বেড খালি পাওয়া যাবে তো? আর গুরুতর আক্রান্ত রোগীর জন্য আইসিইউ খালি পাওয়া যাবে কি? প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার ঢাকা শহরে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ১০৪টি আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩৭৬টি। ফলে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা সংকটাপন্ন রোগীর স্বজনরা প্রতিমুহূর্তে কামনা করতে থাকে যারা ভর্তি হয়ে আছে, তাদের মৃত্যু। কারণ, মৃত্যু ছাড়া আইসিইউ বেড খালি হওয়ার উপায় নেই। করোনা মহামারি মানুষকে কতটা অসহায় আর অমানবিক করে ফেলছে! মুখে না বললেও মনে মনে ভাবতে থাকে, একটা বেড দরকার। নিজের স্বজন ছাড়া বাকিরা মরে যাক!

২০২০ সালের মার্চের ৮ তারিখে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এক বছর এক মাস পার হয়েছে। করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বেফাঁস কথা জনগণের সামনে উন্মোচন করেছিল। এরপর বাজেট প্রণীত হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে সে বাজেটে সেটা ভিন্ন আলোচনা, তা করলে হয়তো দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিরক্ত হবেন। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে বিশেষত করোনা মোকাবিলায় সীমিত বাজেটেও উদ্যোগগুলো কেমন নেয়া দরকার, তা নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অন্তত বাস্তবায়িত হবে সে প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অমূলক ছিল না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই বলেছেন, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউটা প্রথমটার চাইতে মারাত্মক হয়ে থাকে। কে শোনে কার কথা! প্রথমবার ছিল দম্ভ। আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাক্বালে আত্মতৃপ্তি। আমরা করোনা জয় করতে পেরেছি, বাকি সব কিছুই জয় করতে পারব।

প্রথম ঢেউ বা ধাক্কার শিক্ষাটা কী ছিল? তা কি কর্তাব্যক্তিদের মনে আছে? যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের ৭৫ শতাংশ ছিল পুরুষ। বাকিরা নারী। বয়স বিবেচনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৫৬ শতাংশ, ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১১ শতাংশ মৃত্যুর কথা পরিসংখ্যান বলছে। মৃত্যুর সংখ্যার শীর্ষে ছিল ঢাকা, প্রায় ৫৭ শতাংশ। করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল ৩১টি জেলা। করোনায় কাজ হারিয়েছে, আয় কমেছে, শ্রমজীবীদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং বিবিএস পর্যন্ত জরিপ করে দেখিয়েছে কীভাবে মানুষের জীবনে কষ্ট বেড়েছে করোনার আঘাতে। প্রায় ১ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছিল এবং ৯৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষের অন্তত ২০ শতাংশ আয় কমে গিয়েছিল। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনে যে অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে তা কাটাতে অনেকদিন সময় লাগবে। কিন্তু এসব তো তথ্য। তথ্যের কি শক্তি থাকে যদি তা কেউ বিবেচনায় না নেয়? বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছেন তারা। যে যা-ই বলুক না কেন, ক্ষমতায় যারা থাকেন কিছু করার ক্ষমতা তো তাদেরই থাকে। কারণ ট্যাক্সের টাকা বা রাজস্ব আয় সব তো তাদের হাতে, প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ যত পরামর্শই দিন না কেন বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা তো ক্ষমতাসীনদের হাতেই।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেট হাসপাতালের নতুন ২০০টি করোনা আইসিইউ বেড ও ১০০০টি আইসোলেশন বেডের প্রস্তুতকরণ ও কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ১৮টি জনগুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন করোনা প্রতিরোধে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ চলছে। অথচ দেশের কোথাও কোথাও লকডাউন তুলে নিতে আন্দোলন করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সরকারের লকডাউন ব্যবস্থা জরুরি ছিল, তাই সরকার দিয়েছে। যখন লকডাউন তুলে নেয়ার প্রয়োজন হবে, সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। এখন এসব সরকারি নির্দেশনা মেনে না চললে ভবিষ্যতে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে।’ এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কি কিছু আছে? কিন্তু যখন সিদ্ধান্তগুলো পালটে যায়, তখন হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার আছে কি?

লক ডাউন করা হচ্ছে না কি হয় নি, তা নিয়ে এক রহস্য তৈরি হয়েছে। একবার বলা হচ্ছে কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে আবার নগরে গনপরিবহন চলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। অফিস আদালত চলবে, কারখানা চলবে, ব্যক্তিগত গাড়ী, রিক্সা চলবে, বই মেলা চলবে কিন্তু মার্কেট বন্ধ থাকবে। ঢাকাকে যদি করোনার সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত এলাকা ধরা হয় তাহলে সাধারণ ছুটি বা লক ডাউনের সঙ্গে সঙ্গে যে মানুষ ছুটল গ্রামের দিকে তারা কি সংক্রমণের বিস্তার ঘটিয়ে দিতে সহায়তা করল না? জনগণ করোনাকে ভয় পাচ্ছে না, লক ডাউন মানছে না, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করছে, দোকানপাট খুলতে চাইছে- এভাবে তাদেরকে দায়ী করা যাবে কিন্তু তাদের ওপর দায় চাপিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানো যাবে কি?

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর