বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সক্ষমতা

  •    
  • ৯ এপ্রিল, ২০২১ ২১:১৬

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক মিল আছে ঐতিহাসিকভাবে। বাংলাদেশ উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।

ঐতিহাসিকভাবে এশিয়াতে শুধু নয়, গোটা পৃথিবীতে জাপানই একমাত্র দেশ, যারা নতুন ও ভালো কিছু খুব চমৎকারভাবে গ্রহণ করতে পারে এবং সেই গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে নতুনের পথে এগিয়ে নিতে পারে। ১৮৬৮ সাল থেকে তাদের মেজাই আমলে তারা ইউরোপের ও আমেরিকার যে উন্নয়নের পথ ও ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে নিজেদের পরিবর্তন করে, তা এশিয়া, আফ্রিকা এমনকি অনেক ইউরোপীয় কলোনিও পারেনি। এমনকি পারেনি আজকের উন্নত চায়না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানের প্রাইভেট কোম্পানিগুলো আমেরিকা থেকে কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং তাদের অন্যান্য পলিসি গ্রহণ করে দ্রুত এগিয়ে যায়। টয়োটা কোম্পানি আমেরিকার পথ অনুকরণ করে গোটা বিশ্বে তাদের বাজারকে ছড়িয়ে দেয়। এমনিভাবে সকল প্রাইভেট কোম্পানি ইউরোপ ও আমেরিকাকে অনুকরণ করে এবং তাদের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে দ্রুতই জাপানের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখে। এমনকি একাডেমিকভাবেও জাপানের প্রাইভেট কোম্পানিগুলো জাপানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে মূল ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে সরকার অনেক পিছিয়ে থাকে।

এমনকি প্রাইভেট কোম্পানিগুলো নিজ উদ্যোগে থিংকট্যাংক তৈরি করে এবং তারাই মূল ভূমিকা পালন করে সব কিছু পরিবর্তনে। এমনকি তারা একটি ইনভেস্টিগেশন টিমও তৈরি করে, যাদের মূল কাজ ছিল সরকারের নানান দিক ও স্থান এবং বেসরকারি খাত কী কী অসুবিধা ভোগ করছে এবং তা থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়, তা নির্ধারণ করা। তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত সরকারের জন্যে ওই অসুবিধার সময়কে কীভাবে পার করা যায় তার পরিকল্পনাও তৈরি করে দেয়।

তাই সব মিলিয়ে বলা যায়, জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংকট কাটানোর ক্ষেত্রে তাদের সরকারের ভূমিকা কম ছিল না। তবে তাদের প্রাইভেট কোম্পানিগুলো এবং তাদের থিংকট্যাংকরা সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করে। এবং সত্যি অর্থে জাপানের মতো এত দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত কেউ কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

তবে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারলেও জাপানের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, দেশটি তাদের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একই মাপের সফল নয়। যেমন গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, জাপান দুটো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়েছে। এক ২০১১ সালের মার্চ মাসের ভূমিকম্প ও সুনামি এবং তার সঙ্গে তাদের ফুকুসিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বিপর্যয়। এবং এই কোভিড-১৯। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে যেমন দ্রুত ও অনেকটা বিস্ময়করভাবে তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করেছিল, এই দুটো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তারা সেভাবে মোকাবিলা করতে পারল না। এমনকি এইচ ওয়ান এন ওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা মোকাবিলা থেকে তারা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল, সেটাও তারা কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারল না। বরং জাপানকে এখন কোভিড-১৯ এর চতুর্থ ওয়েভ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক মিল আছে ঐতিহাসিকভাবে। বাংলাদেশ উপমহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কারণ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজ ও জাপানি বাহিনী ঠেকানোর প্রস্তুতি হিসেবে সে সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল পূর্ববঙ্গ, যা আজকের বাংলাদেশ, এখান থেকে সব চাল ও নৌকা সরিয়ে ফেলেন, যাতে আজাদ হিন্দ ফৌজ ও জাপানি ফৌজ বার্মা দিয়ে প্রবেশ করে চলাচলে বাধা পায় এবং খাবার না পায়। এই সব চাল সরিয়ে ফেলায় পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলায় হয় এবং লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষের রেশ না কাটতেই পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। এবং পূর্ববাংলা শেষমেশ পূর্ব পাকিস্তান হয়। কিন্তু সত্যি অর্থে দারিদ্র্য কাটাতে পারেনি। কোরিয়া যুদ্ধে পূর্ববাংলার পাট বিক্রি করে কিছু অর্থ এ দেশ রোজগার করে ঠিকই, কিছু দরিদ্র কৃষক ওই অর্থে তাদের সন্তানদের বিদ্যার্জনে পাঠানোর সুযোগ পায়। তবে বেশি অংশ টাকা পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করে নেয়। আর এই দরিদ্র অবস্থাতেই স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে যেমন আমেরিকা অ্যাটম বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল, বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা অ্যাটম বোমা না ফেললেও গোটা দেশকে একই মাপে ধ্বংস করে। অন্যদিকে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার মাত্র তিন মাস আগে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘটে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়, যাতে দশ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন দেশের অবকাঠামোর প্রায় নব্বইভাগ ধ্বংস হয়, তেমনি মানুষ মারা যায় ত্রিশ লাখেরও বেশি।

তাই বাংলাদেশের জন্যে এই ক্ষত ছিল জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ক্ষতের থেকে অনেক বেশি। অন্যদিকে এই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে জাপানে যদিও ছিল অভিজ্ঞ প্রাইভেট সেক্টর, বাংলাদেশের তখন ওই ধরনের কোনো প্রাইভেট সেক্টর ছিল না। তাছাড়া স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সেক্টর নিয়ে একটি ডিলেমায় ছিল। অর্থাৎ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ সবটুকু রাষ্ট্রের হাতে থাকবে, নাকি প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেয়া হবে কিছু। অন্যদিকে জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাদের অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে সরকারি সেক্টর সমর্থ হয়নি। প্রাইভেট সেক্টর সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসন ছিল অর্থনৈতিকভাবে একদম অনভিজ্ঞ। তাই বাংলাদেশ সে সময়ে অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সত্যি অর্থে খুব ভালো সুফল দেখাতে পারেনি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে তখন ওইভাবে প্রাইভেট সেক্টর ছিল না। তাই সেখানে আশার কোনো দিক ছিল না। তবে বাংলাদেশের সম্বল ছিল একমাত্র তার লিডারশিপ। কিন্তু সে লিডারশিপকে দ্রুত হত্যা করে প্রতিবিপ্লবীরা। যার ফলে যে অর্থে যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়, সে ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ পরিপূর্ণভাবে অর্জন করার সময় ও সুযোগ পায়নি।

এর পরে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে মূলত ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা। সত্যি অর্থে ১৯৯১ অবধি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মূলত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা, মোকাবিলার সক্ষমতা খুব বেশি ছিল না। এরশাদ আমলে ১৯৮৮-এর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সে সময়ের সব থেকে বড় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে এবং তার লাখ লাখ কর্মীদের নিয়ে রুটি তৈরি করে বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন বাঁচান। এমনকি সরকারের বাইরে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হয় বন্যাপীড়িত মানুষকে উদ্ধার করতে ও বাঁচাতে। এবং সেটা এমনই ছিল যে, ওই কাজে গিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের এক ছেলেকে জীবন দিতে হয়েছিল। এর পরে বেগম জিয়ার আমলে হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়, তখনও কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার কোনো সক্ষমতা বাংলাদেশের ছিল না। ওই ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসেবে ১ লাখ ২৭ হাজারের কিছু বেশি মানুষ মারা যায় বলে বলা হয়, তবে বাস্তবে এটা ছিল ৫ লাখের বেশি। অর্থাৎ ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পরে সেবারই সব থেকে বেশি মানুষ মারা যায়।

এরপরে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে। যে কারণে তার আমলে ১৯৯৮-এর বন্যা ও ’৯৬-এর ঘূর্ণিঝড়ে জাতিসংঘের সকল ভবিষ্যদ্বাণীকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলাদেশ নিজেকে বিপদমুক্ত রাখে। এবং সত্যি অর্থে এই দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় এখন পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি সক্ষম।

এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র দেশ হলেও কোভিড-১৯ এর প্রথম ওয়েভ বাংলাদেশ এশিয়ার সব থেকে উন্নত দেশ জাপানের থেকে অনেক ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে খুবই সীমিত স্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে। এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতায় এ দেশ কোভিড-১৯ এর টিকা দেয়ার কর্মসূচিও বেশ এগিয়ে নিচ্ছে। এর ভেতর এই এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ওয়েভ বেশ বড় আকারে আসছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারকে তাই ব্যস্ত থাকতে হবে এই কোভিড-১৯ মোকাবিলায়।

এই দ্বিতীয় ওয়েভ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করবে। তাই এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপান যা করেছিল, বাংলাদেশকে এখন সেটাই করতে হবে। চায়না, ভারত থেকে শুরু করে জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো যেভাবে তাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে এই ভয়াবহ সময়ে, বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরকে সে কাজে মন দিতে হবে। এবং সেটা দেশপ্রেমের সঙ্গে, ব্যাংক লুটের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।

এ বিভাগের আরো খবর