করোনাকালের ভয়াবহতার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এক বাড়ি থেকে ৬ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করার ঘটনার কথা পড়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ‘বিষণ্নতা থেকেই’ পরিবারটির দুই ভাই তাদের মা-বাবা, নানি ও একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের ধারণা।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ওই পরিবারের এক সদস্য, যাকে পুলিশ সন্দেহ করছে অন্যতম হত্যাকারী ও আত্মহত্যাকারী হিসেবে সেই ফারহান জানিয়েছে, ২০১৬ সালে নবম গ্রেডে পড়ার সময় থেকে তার ‘বিষণ্নতায় আক্রান্ত’ হওয়ার কথা। সেখানে সে লিখেছে শিক্ষাজীবন বির্পযস্ত হওয়ার কথা, তাকে বন্ধুদের ত্যাগ করা ও জীবন দুর্বিষহ হওয়া এবং আত্মহত্যার কথা।
একজন তরুণ ঠিক কোন মানসিক অবস্থায় পৌঁছলে ভাইকে মোটিভেট করে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে এবং পরে নিজে আত্মহত্যা করে, তা সহজেই অনুমেয়। এই ধরনের ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি মা তার সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে বা বাবা পরিবারের সবাইকে হত্যা করে নিজেও মারা গেছে। এগুলো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মানুষ যখন নিজের ‘মৃত্যুকে বরণ করে’ নেয়ার জন্য তৈরি হয়, তখন ধরেই নিতে হবে, সে মানসিকভাবে অসুস্থ বা ভয়াবহ রকমের ডিপ্রেশনের শিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে রোগের বোঝা হিসেবে বা ডিজিজ বার্ডেনের এক নম্বর কারণ হবে বিষণ্নতা। আর সে সময় বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে মৃত্যুর শিকার হবে। আধুনিক মানবজাতির জন্য এ এক ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণী।
অথচ মানসিক স্বাস্থ্য বা রোগ নিয়ে ভুল ধারণা, লজ্জা, ভয়, কুসংস্কার বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও রয়েছে নানা মিথ। তাই একদিকে যেমন মানসিক রোগী ও তার পরিবার চিকিৎসা নিতে চায় না, অন্যদিকে কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় আমাদের মতো দেশগুলোতে সব রোগী সুচিকিৎসা পায় না। এদেশে অধিকাংশ মানুষ একে মনে করে পাগলামি। আর মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাকে সবসময়ই পাগলের চিকিৎসা বলে মনে করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক যুগ আগে ‘স্বাস্থ্য’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘কেবল নীরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয় বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ আমাদের অসচেতনতার ফলে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে শুধু ‘শারীরিক’ অংশটুকুর মধ্যে। আর তাই বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই মানসিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
জীবনের চাপ-তাপ, অত্যাচার-নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচার, ব্যর্থতা সব মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে শিশুদের ওপর ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক প্রভাব, তাদেরকে ডিপ্রেশন বা হতাশার মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমনকি কোনো কোনো সময় এই অবস্থার জের শিশুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
মানসিক সমস্যাকে আমরা এতটাই অবহেলা করি বা এড়িয়ে চলি কিংবা বুঝতে না পেরে এমন একটা সময়ে চিকিৎসকের কাছে যাই, যখন পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে রোগী আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। অথচ সমস্যার শুরুতেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া যে দরকার, তা আমরা এখনও বুঝি না। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো বাংলাদেশে অধিকাংশ রোগী এবং তার আশপাশের মানুষ বিশ্বাসই করেন না যে, মানসিক রোগ বলে কিছু আছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-২০১৯ অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৬.৮% এবং এদের ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন ভুগছেন বিষণ্নতায়। অথচ অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এর শতকরা ৯২ জন রয়েছেন চিকিৎসা আওতার বাইরে।
অপরদিকে শিশু কিশোরদের মধ্যে এ হার ১৩.৬%। যাদের ৯৪% কোনো চিকিৎসা পাচ্ছেনা।
অথচ এর বিপরীতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকমাত্র ২৬০ জন, প্র্যাকটিস করছেন এমন সাইকোলজিস্টের সংখ্যা ৬০০-এর কাছাকাছি। স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দকৃত মোট বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে।
মানসিক রোগীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে বর্তমানে আরও বেড়েছে। কারণ করোনাকালে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যোগ হয়েছে অসংখ্য মৃত্যু-ব্যর্থতা, অভাব-বিপর্যয়। কিন্তু আমরা কেউই এই মানসিক সমস্যাটা নিয়ে সচেতন নই। আমরা পড়তে পারছি না, পরীক্ষা দিতে পারছি না, চাকরি পাচ্ছি না, চাকরি হারাচ্ছি, পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছি- এগুলো সবই মানসিক চাপ কিন্তু এর জন্য নেই কোনো চিকিৎসা সহায়তা।
পরীক্ষায় ফেল করলে, বিয়ে ভেঙে গেলে, প্রেমে ব্যর্থ হলে, সম্পদহানি ঘটলেও মানসিক স্বাস্থ্য ভয়াবহভাবে হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ তার এই বিষণ্নতা বা হতাশার কোনো চিকিৎসা করে না বা করতে পারে না।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যেকোনো শারীরিক রোগকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলেও মানসিক সমস্যাকে বাংলাদেশে এখনও ঠাট্টা, বিদ্রূপ বা হালকা বিষয় হিসেবে ধরা হয়। মানসিক রোগের অনেক শারীরিক প্রভাব আছে। আর সেসব শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষ ডাক্তারের কাছে যান। এই সমস্যার মূল কারণ যে মানসিক স্বাস্থ্য- এটা রোগীদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসকরা এটা বুঝতে পারেন না। কারণ আমরা যে এমবিবিএস পাস করি সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি পড়ানোই হয় না। এজন্য তারাও রোগীর মূল সমস্যা বুঝে তাকে আমাদের কাছে রেফার করতে পারেন না।”
উন্নত দেশগুলোতে পরিবার, স্কুল এমনকি কর্মক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু এরপরেও টেক্সাসের এই ঘটনার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এর বিপরীতে আমাদের দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই।
এদেশে মানুষ যখন মানসিক সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সবচেয়ে আগে যায় ওঝা-পির-ফকিরদের কাছে। মানসিক রোগ ভালো করার সবচেয়ে যুৎসই চিকিৎসা হচ্ছে পানিপড়া বা ঝাড়-ফুক। অধিকাংশ মানুষ বা পরিবার বুঝতেই পারে না হতাশা, বিষণ্নতা, সন্দেহ এগুলো এক ধরনের মানসিক রোগ এবং এর চিকিৎসা আছে। যদি এই রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা না পান, তাহলে যেকোন ধরনের বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
বর্তমানে এত টানাপোড়েনের মধ্যে মানুষকে থাকতে হয় যে, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাই কঠিন। এখনকার শিশু প্রকৃতির কোলে বড় না হয়ে, ডিভাইস-নির্ভর হয়ে বড় হচ্ছে, সেটা কি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে? হচ্ছে না, কারণ খেলাধুলা মন ভালো রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আগে শিশুরা খেলত, বেড়াত, পরিবারের নৈমিত্তিক কথোপকথনের বাইরে থাকত বলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য আজকালকার শিশু-কিশোর-তরুণদের চেয়ে ভালো ছিল।
টাকা না থাকাও যেমন মানসিক চাপের কারণ, তেমনি অতিরিক্ত অর্থ আয়ের পেছনে ছুটলেও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সততা মানুষের মনকে সুস্থ রাখে। মনকে চাঙ্গা রাখার জন্য ভালো কাজ করার কোনো বিকল্প হয় না।
প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটালে, বন্ধুকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরলে, বাবা-মায়ের পাশে বসে থাকলে, এমনকি আপনজনের কণ্ঠস্বর শুনলে- পরিবারের সবাইকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখলেও একটা আনন্দের ভাব আসে। কেউ যখন খুব কষ্টে থাকে, তখন কেউ যদি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, সেই মানুষটি কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারে বা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে।
প্রতিটি পরিবারেরই উচিত শিশুরা যেন এই গুণগুলো নিয়ে বড় হতে পারে, সেই চেষ্টা করা। শুধু মোবাইল, ভিডিও গেম বা ডিজিটাল ফ্রেমে ঘরে বন্দি হয়ে থাকলে শিশু মানসিক সমস্যা নিয়ে বড় হবে। মানুষ ভয়, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও অপমান বা যেকোনো নেতিবাচক বিষয়ে মানসিক সাপোর্ট না পেলে অপমান উপেক্ষাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। এরপর নিজেও একজন নেগেটিভ মানুষে পরিণত হয়।
সাধারণ স্বাস্থ্যশিক্ষা কখনোই পূর্ণাঙ্গ হবে না, যতক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা না হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য অর্থ কেবল মানসিক রোগ নয়, বরং মনের যত্ন নেয়া, নিজের সক্ষমতা আর দুর্বলতা বুঝতে পারা। আসলে দৈনন্দিন চাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে উৎপাদনশীল থাকাটাই মানসিক স্বাস্থ্য। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মনকে বাদ দিয়ে শরীর নয়। সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য চাঙ্গা রাখার জন্য ও মনে কোনো রোগ না হলেও মনের যত্ন নেয়ার জন্য।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন