বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অজ্ঞাত আসামি ও পুরুষশূন্য এলাকা

  •    
  • ৯ এপ্রিল, ২০২১ ১০:২৯

ঘরে পুরুষ লোকটি নেই বা তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে চুলায় আগুন জ্বলবে না— এটি খুবই হতাশার কথা। আমাদের এমন একটি সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে নারী নিজেই তার উনুনে আগুন জ্বালাতে সক্ষম। বৃদ্ধ হলে কী খাবেন, কার কাছে থাকবেন, মেয়ের কাছে থাকতে পারবেন কি না, মেয়ে তার ভরণপোষণ দিতে পারবেন কি না, সেই ভীতি থেকে ছেলেসন্তানের প্রত্যাশা যাতে করতে না হয়, এরকম একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

‘গ্রেপ্তার এড়াতে পুরুষশূন্য শাল্লার তিন গ্রাম। বন্ধ মসজিদ-মাদ্রাসা। স্বামী-সন্তান কোথায়-কীভাবে আছে খোঁজ নেই কারো কাছে। খাবার সংকট আর আতঙ্ক নিয়ে শিশু ও নারীদের রাত কাটছে নির্ঘুম।’ সম্প্রতি গণমাধ্যমে এরকম শিরোনাম হয়তো পাঠকের নজর এড়ায়নি।

খবরে বলা হয়, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নাচনী, কাশিপুর ও চণ্ডিপুর গ্রামে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস। তবে ১৭ মার্চের সহিংসতার পর প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।

অতীতেও এরকম সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। মূলত যখনই কোনো এলাকায় বড় ধরনের অপরাধ হয় এবং অজ্ঞাত লোকজনকে আসামি করে মামলা দেয়া হয়, তখনই পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে যায়। মানে পুরুষেরা পালিয়ে বেড়ান। কারণ একবার গ্রেপ্তার হলে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করে বেরিয়ে আসতে আসতে তার জীবন থেকে অনেক মূল্যবান সময় চলে যায়। পুলিশ ও আইনজীবীকে পয়সা দিয়ে দিয়ে অনেকে ফতুর হয়ে যান।

জায়গা-জমি বিক্রি করতে হয়। ফলে যখনই আসামির সংখ্যা অনেক এবং অজ্ঞাত, তখনই গ্রামগুলো এভাবে পুরুষশূন্য হয়ে যায় এবং তার প্রত্যক্ষ ভিকটিম হয় ওই পরিবারের বাকি সদস্যরা। কারণ সাধারণত পুরুষরাই সংসারে আয় করেন। কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা, কেউ কৃষিকাজ। ফলে যখন তিনি পালিয়ে বেড়ান, তখন ঘরের উনুন জ্বলে না। বিশেষ করে যারা দিন আনেন দিন খান। সুনামগঞ্জের শাল্লার তিন গ্রামেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমরা এমন একটা অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি যে, ঘর বা গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গেলেও নারীরা ঠিকই সব সামলে নেবেন বা নিতে পারবেন। পরিবার ও সমাজ এখনও এতটাই পুরুষনির্ভর যে, কোনো কারণে ঘরে পুরুষ লোকটি না থাকলে সেই ঘরে অনাহার উঁকি মারে।

২০১৩ সালে মাদারীপুরের কালকিনিতে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। তখন গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিলো: হত্যাকাণ্ডের জেরে গ্রাম পুরুষশূন্য। নষ্ট হচ্ছে ১৫ একর জমির ধান। তবে ওই গ্রামে তখন শুধু পুলিশের গ্রেপ্তার আতঙ্কই নয়, বরং প্রতিপক্ষের হামলার ভয়েও অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যান।

একটি অদ্ভুত ঘটনার খবর শিরোনাম হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের পূর্ব বেতবাড়িয়া গ্রামে এক তরুণীর মৃত্যু হয় লিভার ক্যান্সারে। জানাজার সময় মেয়ে পক্ষ ছেলের পরিবারের বিরুদ্ধে চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ তোলে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের লোকজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। মেয়ে পক্ষ থানায় অভিযোগ করলে দুই পক্ষের লোকজন নিয়ে থানায় মীমাংসার জন্য ডেকে পাঠান উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। কিন্তু রাত বেশি হওয়ায় তখন থানায় যাননি কেউ। ওসির ডাকে সাড়া না দেয়ার খেসারত দেয়া শুরু হয়।

হাতাহাতির ঘটনায় কোনো পক্ষ অভিযোগ বা মামলা না করলেও শুরু হয় আটক বাণিজ্য। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রাত হলেই ওসি পুলিশ নিয়ে গ্রামে হানা দেন। যাকে পান, তাকেই ধরে নিয়ে যান থানায়। এরপর ছাড়িয়ে আনতে হয় টাকা দিয়ে। অথচ কারো বিরুদ্ধে নেই কোনো মামলা। আটকের ভয়ে গ্রামটি পুরুষশূন্য হয়ে যায়। যদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওসি দাবি করেন, আটক বাণিজ্যের অভিযোগ মিথ্যা।

ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে গত ১৭ মার্চ শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দুদের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় ৫০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দেড় হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। এরপরই শুরু হয় ধরপাকড়। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে যেতে থাকেন পুরুষরা।

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে কয়েকজন ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে এরকম: ‘চাইট্টা পাঁচটা দিন ধইরা পেটে কোনো দানাপানা নাই। ইয়ের পরে তারার বাপ যে কোন দেশে আছে তারও খোঁজ নাই। চুলাত এখন পর্যন্ত আগুন ধরছে না। কে যে কেমনে দিয়া গেছে কোনো খবর নাই। অহন আমরা কী কইরা চলতাম। কী কইরা খাইতাম। তারা অপরাধ না কইরাও অপরাধী।’

ঘরে পুরুষ না থাকায় শাল্লার তিন গ্রামের মানুষ যে খাবার সংকটে পড়েছেন, সেটি শুধু আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়। অর্থনীতিরও প্রশ্ন। যে ঘরে পুরুষ নেই, সেই ঘরের মানুষ না খেয়ে থাকেন? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনও এতটাই পুরুষনির্ভর যে, তাদের উপরেই নির্ভর করে চুলায় আগুন জ্বলবে কি না।

খুব ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মানুষই ছেলেসন্তানের জন্য চেষ্টা করেন। কারণ মেয়ে থাকলেও তাদের মনে এই ভীতি কাজ করে যে, যদি স্বামী-স্ত্রী দুজন বা একজন বৃদ্ধ হয়ে যান, তখন তাকে কে দেখাশোনা করবে? তিনি কার কাছে থাকবেন? এটি ধরেই নেয়া হয় যে, বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা হয় ছেলের কাছে থাকবেন অথবা আলাদা থাকলেও ছেলেই তাদের ভরণপোষণ দেবেন। তার মানে কি মেয়েদের কাছে বাবা-মা থাকেন না? নিশ্চয়ই থাকেন। কিন্তু মেয়ের কাছে বাবা মা থাকতে পারবেন কি না, সেটি নির্ভর করে ওই মেয়ের স্বামীর ওপরে। যদি মেয়েটি সংসারে আয় না করেন, অর্থাৎ যদি তিনি স্বামীর আয়ের ওপরে নির্ভরশীল হন, তখন তার পক্ষে নিজের বাবা মাকে নিয়ে আসা খুব কঠিন। যদি না স্বামী খুব আন্তরিক হন। এটি এখনও আমাদের সমাজের নির্মম বাস্তবতা।

ঘরে পুরুষ লোকটি নেই বা তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে চুলায় আগুন জ্বলবে না— এটি খুবই হতাশার কথা। আমাদের এমন একটি সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে নারী নিজেই তার উনুনে আগুন জ্বালাতে সক্ষম। বৃদ্ধ হলে কী খাবেন, কার কাছে থাকবেন, মেয়ের কাছে থাকতে পারবেন কি না, মেয়ে তার ভরণপোষণ দিতে পারবেন কি না, সেই ভীতি থেকে ছেলেসন্তানের প্রত্যাশা যাতে করতে না হয়, এরকম একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই হোক প্রত্যাশা।

সেই সঙ্গে বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই শত শত বা হাজার হাজার অজ্ঞাত লোককে আসামি করে মামলা দেয়া এবং গ্রেপ্তার বাণিজ্যও বন্ধ করা দরকার। পুলিশের তদন্ত এবং পুরো বিচার ব্যবস্থায় এখনও যেসব বড় ফাঁক রয়ে গেছে, সেগুলো নিরসন করা না গেলে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুফল গুটিকয় মানুষ ভোগ করবে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর