২০২০ সালের শুরুতে আমরা করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে চিকিৎসার জন্য পাগলের মতো ছোটোছুটি করেছি। আক্রান্তদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। হাসপাতালগুলোতে প্রাণ রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় আমরা অনেক আত্মীয় হারিয়েছি। আমরা মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছি যে, বিগত পঞ্চাশ বছরে আমরা আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে পারিনি। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে আমরা নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করেছি।
২০২০ সালে করোনার প্রথম আক্রমণে আমরা আমাদের বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়টি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম। স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকল। অবস্থার ভয়াবহতা দেখে সব গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। তাতে সরকার তথা স্বাস্থ্য বিভাগের টনক নড়ে, আর আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তারা ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নড়েচড়ে বসেছে।
স্বাস্থ্যসেবা খাত যে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে ছিল তা বেরিয়ে আসতে শুরু হলে স্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাপক রদবদল শুরুর মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হলো যে, শুদ্ধিকরণ চলছে। এতে লোক দেখানো কিছু কাজ হলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো উন্নতিই হয়নি। উন্নতি হয়নি এই অর্থে যে দেশের সবার জন্য স্বল্প বা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার কোনো উন্নত ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি।
রাতারাতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বদলে ফেলার জন্য সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উঠেপড়ে লাগলেও বাস্তবতাটা সবাই বুঝতে পারল। সবার জন্য কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যে কোনো এডহক কারবার নয় সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সবাই আশা করছিল যে, দীর্ঘস্থায়ী একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার কার্যকর বাস্তবায়নের বার্তা মানুষ পাবে।
২০২১ সালে করোনার নতুন ঢেউ শুরু হওয়ার পর অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘ এক বছর সময় পার হলেও এর মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতির তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি।
তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আগের এই এক বছর সময়টাতে হাসপাতালের আইসিইউ বেড ও সাধারণ বেড সংখ্যা বৃদ্ধি, হাসপাতালগুলোর সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নতি, করোনাসহ সকল টেস্ট ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যয় সাধারণের নাগালের মধ্যে এনে এর দৃশ্যমান কোনো উন্নয়নের লক্ষণ কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি।
এই সময় দাঁড়িয়ে যদি স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এ পর্যন্ত সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলার সামান্যতম কোনো ব্যবস্থাও সরকার গ্রহণ করেনি। শুধু গতানুগতিক ঠোঁটসেবা দিয়ে চাতুর্যের সঙ্গে এই খাতকে অব্যবস্থাপনার বেড়াজালেই ফেলে রাখা হয়েছে। এখানে সত্যিকার অর্থেই এক দুষ্টচক্র রয়েছে, যারা চায় না স্বাস্থ্যখাত সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করার মতো উন্নত হয়ে গড়ে উঠুক। এর পেছনে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের এক বিরাট যোগসাজশ রয়েছে তা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশে এই বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য যে তিনটি বিষয়কে দায়ী করা যায় সেগুলো হলো, এক: দেশের আর দশটা ব্যবস্থাপনার মতোই এই খাত আপাদমস্তক দুর্নীতি ও অদক্ষতায় ডুবে রয়েছে। দুই: বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই বিভাগের যোগসাজশ এর উন্নয়নকে টেনে ধরেছে। তিন: স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সরকারের উদাসীনতার কারণে এই খাতকে অগ্রাধিকারের তালিকায় কোনোভাবেই আনা সম্ভব হয়নি।
একটা দেশের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার কিছু বাঁধাধরা নিয়ম আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যান্ডেট অনুযায়ী, একটি দেশে প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে দুটি করে হাসপাতাল বিছানা থাকতেই হবে, আর স্ট্যান্ডার্ড হলো প্রতি হাজার মানুষের জন্য তিনটি হাসপাতাল বিছানা।
এছাড়া হাসপাতাল বিছানার অনুপাতে আইসিইউ সংখ্যারও একটা বাঁধাধরা নিয়ম আছে, যা হলো হাসপাতাল বিছানার তুলনায় শতকরা কমপক্ষে ৫ ভাগ আইসিইউ বেড থাকতেই হবে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ হাসপাতাল বিছানার বিপরিতে পাঁচটি করে আইসিইউ বেড থাকতে হবে। তবে প্রতি একশ হাসপাতাল বিছানার বিপরীতে ৬/৭ টি আইসিইউ বিছানা থাকাটা আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এই হিসাব ৯ থেকে ১০ ভাগ।
বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যা সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যা সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি। এই হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি হাজার মানুষের জন্য রয়েছে দশমিক শূন্য আটটি বিছানা, যার অর্থ প্রতি হাজার মানুষের জন্য একটি হাসপাতাল বিছানাও নেই।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ হাসপাতাল বিছানা রয়েছে, যার বিপরীতে প্রয়োজন কমপক্ষে পাঁচ হাজার আইসিইউ বেড, অথচ বাস্তবে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট আছে মাত্র প্রায় আটশ আইসিইউ বেড। আর আইসিইউ পরিচালনার বিশেষজ্ঞ আছেন আইসিইউ সংখ্যার অর্ধেকেরও কম।
এছাড়া, একটি হাসপাতালে যে পরিমাণ লজিস্টিক স্টাফ আর টেকনোলজিস্ট দরকার বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে তার অর্ধেকও নেই, অথচ এসব নিয়ে সরকারের এবং বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো মাথা ব্যথাই নেই। হয়ত তারা এই হিসাবটি নিয়ে উদ্বিগ্নও নয়।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো টেস্ট টেস্ট আর টেস্ট। স্বাস্থ্য বিভাগ বিগত এক বছরে যেমন টেস্ট করার জন্য পর্যাপ্ত কেন্দ্র বাড়াতে পারেনি, তেমনি বেসরকারি ল্যাবরেটরিগুলোতে টেস্ট কিট সরবরাহ করে টেস্টের দাম সহনীয় পর্যায়ে এনে মূলধারার টেস্টের সঙ্গে সেগুলোকে সম্পৃক্ত করার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এটাকে উদাসীনতা বলব, নাকি ইচ্ছাকৃত অবহেলা বলব জানি না।
আমরা এই কয়দিন ধরে দেখছি সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো বেড খালি নেই, মানুষ রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছে। পথেই অনেকে মারা যাচ্ছে। এই সুযোগে প্রাইভেট হাসপাতালের চলছে রমরমা ব্যবসা। আর অনেক রোগী অর্থের অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী ভর্তি করলেই আপনজনদের গুণতে হচ্ছে ৭ থেকে ১৪ লাখ টাকার বিল। হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা তো দূরের কথা, সাধারণ অক্সিজেন নিয়েও প্রাইভেট হাসপাতালগুলো নোংরা ব্যবসা করছে।
স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতির কারণে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র যাচ্ছেতাই উপায় অপেশাদার লোকেরা হাসপাতাল খুলে বসেছে, যেগুলোতে যথাযথ চিকিৎসার বালাই না থাকলেও অর্থ লুটের কাজটা ঠিকই চলছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর বেশিরভাগ নাগরিকের কোনো আস্থা নেই। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর কাছে মানুষ জিম্মি হচ্ছে, যার ফলে অর্থের অভাবে ৯০ ভাগ মানুষ জটিল রোগের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা ভয়াবহ। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে আমাদের যা করতে হতো তা হলো- চিকিৎসা সেবায় আটটি বিভাগকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ। আমরা জানি, পৃথিবীর কোথাও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা হয় না। তাই এর অর্থের যোগানের পরিকল্পনাও সরকারকে করতে হবে। সরকার যদি জরুরি ভিত্তিতে অত্যন্ত মেধাবী ও সৎ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রতিটি বিভাগের জন্য কমিটি করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতায় বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইত তাতে পদ্মা সেতুর চেয়েও কম টাকা লাগত। তার জন্য শুধু প্রয়োজন সৎ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি।
বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। চিকিৎসার জন্য যদি প্রতি মাসে ১০০ টাকা প্রদান সাপেক্ষে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হয়, তাহলে প্রতি মাসে ১৭০০ কোটি টাকা আয় হবে যা প্রতি বিভাগে জনসংখ্যার অনুপাতে ভাগ করে দিলে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে বিশ্বের সবচাইতে উন্নতমানের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।
নিশ্চিত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার লক্ষ্যে সবাই এই অর্থ প্রদান করবে, আর যারা করতে পারবে না তাদের অর্থ দেশের দানশীল ব্যক্তি ও সংস্থা, যাকাত ফান্ড অথবা সরকারের স্বাস্থ্য প্রণোদনা তহবিল থেকে দেয়া যেতে পারে। তবে স্বাস্থ্য কার্ড ছাড়া কেউই চিকিৎসা সেবা পাবে না এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে এনআইডির মাধ্যমে স্বাস্থ্য ডাটাবেজ তৈরি করে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এই ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থা কিন্তু ১৯২০ সালের ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লুরই ফসল।
লেখক: বাংলাদেশ প্রতিনিধি, টিভি ফাইভ মন্ড (ফ্রান্স)