বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস ও বাংলাদেশের অর্জন

  •    
  • ৭ এপ্রিল, ২০২১ ১৩:১০

বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের যে চিত্র তুলে ধরেছিল, তার সঙ্গে ‘বাস্কেট কেস’ অভিধা বেশ মানানসই। পরনির্ভরতাই এ দেশের নিয়তি। বিশ্ব ব্যাংকের হুকুমে চলবে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব মোড়লের কথায় উঠবে-বসবে। কিন্তু এ জন্য তো আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম করিনি? এই হতশ্রী চেহারার দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুব্ধ করেননি।

বিশ্ব ব্যাংক ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সম্পর্কে এক হতাশার চিত্র তুলে ধরেছিল। বাংলাদেশ মাত্র কয়েক মাস আগে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তানিদের গণহত্যার শিকার হয়েছিল ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশেক দুঃশাসন-শোষণের পর দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ-শাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত রাখার নীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত খুব দুর্বল ছিল। তদুপরি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের ক্ষত। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। শিক্ষার হার খুব কম। শিল্পকারখানা পাকিস্তান আমলে গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। যা সামান্য কারখানা ছিল, বেশির ভাগ বন্ধ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ভাণ্ডারের সামনে লেখা- শূন্য। আমদানি-রফাতানি বাণিজ্য বলতে কিছু নেই। খাদ্যঘাটতি প্রায় ৫০ লাখ টন। এক কোটি শরণার্থী ভারত থেকে ফিরে এসেছে। অভ্যন্তরেও পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-রাজাকারদের হামলার কারণে প্রায় দুই কোটি নাগরিক প্রায় উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে। তাদের পুনর্বাসন চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি এমন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

স্বাধীন দেশে মানুষের প্রত্যাশার শেষ ছিল না। সবাই দেখছিল উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন। কিন্তু রাতারাতি তা পূরণ হবার নয়। ভরসা ছিল একটিই- আমরা সব বাধা জয় করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। নিজেদের গড়ে তুলতে পারব। সোনার বাংলা হবেই। বিশ্ব ব্যাংক এমন সময়েই তুলে ধরল হতাশার চিত্র। তাদের পণ্ডিত-অর্থনীতিবিদরা বললেন- ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল।’ যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার বললেন- ‘বাংলাদেশ একটি ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। মতামত তাদের স্পষ্ট- এ দেশটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। অপরের অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের দয়া-করুণায় বেঁচে থাকতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার দরকার নেই, পিছিয়ে ছিল এবং পিছিয়ে থাকবে- এটাই তাদের চূড়ান্ত কথা।

বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এ দেশটির পুনর্বাসন-পুনর্গঠনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়। পালাবদল হয় ক্ষমতার। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আসে, তাদের কাছে বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্য ছিল না। দুই সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতায় আসা খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বেছে নেয়া পথ থেকে সরিয়ে নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এমনকি তারা একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে দায়ী করা বন্ধ করে দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়। সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হতে থাকে। অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমন উৎসাহও ছিল না। বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা বলে সেটা শিরোধার্য করে নেয়া হতে থাকে।

১৯৯৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রকাশ করে। তখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণের প্রত্যক্ষ সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামীর সাহায্যে তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। খালেদা জিয়ার দল বিএনপি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতে ইসলামী এ ঘাটতি পূরণ করেছিল। বিনিময়ে তাদের পার্লামেন্টে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে ৩টি উপহার দেয়া হয়। প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদও তারা এ সুযোগে বাগিয়ে নিয়েছিল। অর্থনৈতিক সুবিধাও পেয়েছিল।

বিশ্ব ব্যাংক যে সময়ে বাংলাদেশের চিত্র ২৫ বছর পর কেমন দাঁড়াবে সেটা প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের প্রায় ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন বছর বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তাকে মূলত নজর দিতে হয়েছে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজের প্রতি। বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জনও ছিল গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের অংশ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে শতাধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

স্বাধীনতার ২৫ বছর পর বাংলাদেশ কেমন ছিল? জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়াই এই ২৫ বছরের মধ্যে ২১ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন। বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে বলেছিল- কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন থাকলেও বাংলাদেশের জন্য হতাশার জায়গাও অনেক বেশি। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ অশিক্ষিত, ২৫ বছর ধরে দেশটি গড়ে মাত্র ৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে, এতে দেশটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে, আর বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর সত্যিকার অর্থেই নির্ভরশীল। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কি আগামী ২৫ বছরেও একই রকম থাকবে?

বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের যে চিত্র তুলে ধরেছিল, তার সঙ্গে ‘বাস্কেট কেস’ অভিধা বেশ মানানসই। পরনির্ভরতাই এ দেশের নিয়তি। বিশ্ব ব্যাংকের হুকুবে চলবে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব মোড়লের কথায় উঠবে-বসবে। কিন্তু এ জন্য তো আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম করিনি? এই হতশ্রী চেহারার দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুব্ধ করেননি।

১৯৯৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক পরের ২৫ বছর শেষে যে বাংলাদেশের চিত্র ধরে ধরে, সেটা কেমন ছিল? ২০২০ সালের বাংলাদেশ কেমন হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশের প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানবসম্পদে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। কেননা একটি শক্তিশালী সমাজ ও অর্থনীতি গড়তে সবার আগে প্রয়োজন শক্তিশালী মানুষ। অথচ বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে মা ও শিশুরা চরম দারিদ্যের শিকার। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হয়। এশিয়ার গড় হচ্ছে ৩.৩ শতাংশ। সুতরাং মানবসম্পদে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।

বিশ্ব ব্যাংক ২০২০ সালের জন্য বাংলাদেশের সামনে আরও কিছু বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যেমন, দারিদ্র্যের হার দ্রুত নামিয়ে আনা। প্রবৃদ্ধির হার ৭-৮ শতাংশে উন্নীত করা। ৫ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ। পরিবেশের কার্যকর সংরক্ষণ। ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৮০০ কোটি ডালার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনা ইত্যাদি।

গত ২৫ বছরে প্রায় সব লক্ষ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু ৫ এপ্রিল প্রথম আলোতে লিখেছেন-

“বাংলাদেশ এখন বিস্ময়করভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। মাথাপিছু জিডিপি হারে পাকিস্তানকে বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে।”

এটা উল্লেখ করা সংগত হবে যে ১৯৯৫ থেকে ২০২০, এই ২৫ বছরের মধ্যে ১৭ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় ছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের হাল ধরে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই সময়ে উন্নয়ন অভিযাত্রায় তিনি যেমন বিশ্বসম্প্রদায়ের সহায়তা পেয়েছেন, তেমনি পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে সফল হয়েছেন। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে পরবেন, সন্দেহ নেই।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা-কলাম লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর