মিথ্যা বলা মহাপাপ। কারণ মিথ্যা হলো সব পাপের উৎস। একটা মিথ্যা ডেকে আনে আরেকটি মিথ্যা। এভাবে একজন মানুষ জড়িয়ে যায় মিথ্যার ফাঁদে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হেফাজত নেতা মামুনুল হক। সোনারগায়েঁর রয়েল রিসোর্টে আরেকজনের স্ত্রী নিয়ে ফুর্তি করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার পর মামুনুল হক দাবি করলেন সঙ্গে থাকা নারী তার ‘সেকেন্ড ওয়াইফ’। উগ্র অনুসারীরা ছিনিয়ে আনার পর বাসায় ফোন করে নিজের স্ত্রীর কাছে দাবি করলেন, তার সঙ্গে ছিলেন ‘শহীদুল ভাইয়ের ওয়াইফ’, পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে তিনি তাকে স্ত্রী দাবি করেছেন। বেড়াতে গেলে কেউ কাবিননামা নিয়ে যায় না। কিন্তু ঘটনার তিনদিন পরও মামুনুল হক তার দ্বিতীয় বিয়ের কাবিননামা দেখাতে পারেননি। কাবিননামা দেখতে চাইলে বলতে শুরু করলেন, এই নারী তার শরিয়তসম্মতভাবে বিয়ে করা হালাল স্ত্রী। আর একের পর এক ফোনকল ফাঁস হওয়ার পর তিনি এখন মাঠে নেমেছেন, একটি মানবিক বিয়ের গল্প নিয়ে। এই গল্প পড়ার পর আমার মনে সংশয়, কেউ ডিভোর্স দেয়ার পর বিপদে পড়া সেই নারীকে বিয়ে করাটা ‘মানবিক বিয়ে’ হলে, বাকি সব বিয়েই বুঝি অমানবিক!
আমরা আজ সেই মানবিক বিয়ের একটি মানবিক ব্যবচ্ছেদ করতে চাই। তবে তার আগে মামুনুলের মিথ্যার জাল নিয়ে দুটি কথা বলে নেই। ধরা খাওয়ার পর মামুনুল দাবি করেছিলেন, সঙ্গে থাকা নারী তার সেকেন্ড ওয়াইফ এবং তার নাম আমেনা তৈয়েবা।
রয়েল রিসোর্টে রুম নেয়ার সময়ও তিনি স্ত্রী হিসেবে আমেনা তৈয়েবার নাম উল্লেখ করেছেন। মামুনুল হকের স্ত্রীর নাম আমেনা তৈয়েবাই, তবে তিনি তার প্রথম স্ত্রী। রয়েল রিসোর্টে সঙ্গে থাকা নারী তার স্ত্রীও নন, তার নাম আমেনা তৈয়েবাও নয়। সেই আমেনা তৈয়েবার সঙ্গে মামুনুলের টেলিফোন কথোপকথন অনুযায়ী সঙ্গে থাকা নারী ‘আমগোর শহীদুল ভাইয়ের ওয়াইফ’। আর সঙ্গে থাকা নারীর দাবি অনুযায়ী তার নাম, জান্নাত আরা ঝর্না। সঙ্গে থাকা নারী যদি সত্যি মামুনুলের ‘শরিয়তসম্মতভাবে বিয়ে করা হালাল’ দ্বিতীয় স্ত্রীই হতেন, তাহলে তো তিনি তার নামেই রিসোর্টে রুম বুক্ড করতেন, প্রথম স্ত্রী আমেনা তৈয়েবার নামে নয়।
মামুনুল হকের মানবিক বিয়ের গল্প পড়ার পর আমার দুটি গল্প মনে পড়ছে। প্রথমটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কার। এক বন্ধুর সঙ্গে তার প্রেমিকার মান-অভিমান চলছিল। আরেক কমন বন্ধুকে দায়িত্ব দেয়া হলো, সেটা মিটিয়ে দেয়ার। যাকে ঝামেলা মেটানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সাতদিন পর সেই ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। অপর গল্পটি একদম মামুনুলের মতো।
আমাদের এক বন্ধুর বিয়ের বাতিক ছিল। প্রেম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। দুই মেয়ে নিয়ে তাদের বেশ সুখের সংসার ছিল। হঠাৎ তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। তা নিয়ে নানান পারিবারিক ঝামেলা হলো। প্রথম স্ত্রী ও মেয়েরা তাকে ছেড়ে গেল। দ্বিতীয় সংসারে ছেলে হলো, ভালোই চলছিল। হঠাৎ শুনলাম তৃতীয় বিয়ে করেছেন। তাকে বললাম, কী ব্যাপার? তিনি বললেন, বিশ্বাস করেন দাদা এটা মানবিক কারণে করা। বিয়ের গল্প শুনলে আপনি রাগ করবেন না, বরং ধন্যবাদ দেবেন। গল্পটা সেই পুরোনো। আমার বন্ধুর তৃতীয় স্ত্রীকে তার আগের স্বামী ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলেন। বিপদগ্রস্ত সেই নারীকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। সেই মানবিক বিয়ের শেষটা অবশ্য বেশ অমানবিক। তৃতীয় স্ত্রীর করা নারী নির্যাতন মামলায় তাকে কারাভোগ পর্যন্ত করতে হয়েছিল।
মামুনুল হকের মানবিক বিয়ের গল্পের সঙ্গে আমার দুই বন্ধুর গল্পের দারুণ মিল। মামুনুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম স্বামী হাফেজ শহিদুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন। সাংগঠনিক কাজে তার দু-চারজন সহযোগীর অন্যতম। তাদের সম্পর্কটাও বেশ পুরোনো। মামুনুল হকই লিখছেন, ‘সম্পর্কের গভীরতা পারিবারিক পরিধি পর্যন্ত। পরিবারসহ একে অপরের বাসায় যাতায়াত আমাদের দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রে তার পারিবারিক অভিভাবকত্ব করতাম আমি। পারিবারিকভাবে খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শের জন্য তারা আমার দ্বারস্থ হতো। দুই সন্তানের ছোট সংসার নিয়ে চলছিল তাদের জীবন।
একটা পর্যায়ে এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য। মনোমালিন্য থেকে বাদানুবাদ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু। আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। তখন তাদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। তাদের উভয়ের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু কোনোভাবেই আর সেটি সম্ভব হয়নি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। গল্পের এটুকু পড়লে বাংলাদেশের কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না, পারিবারিক যাতায়াতের সুযোগে মামুনুল সেই সংসারে সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে সব তছনছ করে দিয়েছেন। আসলে দীর্ঘদিনের সহকর্মীর স্ত্রীর প্রতি নজর পড়েছিল তার। তিনি আসলে সেই সংসারে ‘সর্প হইয়া’ দংশন করেছেন, আবার ‘ওঝা হইয়া’ ঝেড়েছেন। সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করার নামে তিনি আসলে সংসার ভাঙা নিশ্চিত করেছেন, যাতে বন্ধুর স্ত্রীর দখল নিতে পারেন। গল্পে আরেকটু এগোলে এই ধারণার সত্যতা মিলবে।
মামুনুল লিখেছেন, ‘ছাড়াছাড়ির পর দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন হাফেজ শহীদুল ইসলাম। সেই বিবাহ আমি পড়াই। তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করছেন। সেই ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে আরেকটি সন্তান।’ কী চমৎকার! বন্ধুর সংসার ভেঙে, তাকে আবার নিজেই নতুন বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন। তবে হাফেজ শহীদুলের সুখের সংসারের গল্পটা মামুনুলের বানানো।
শহীদুলের প্রথম সংসারের দুই ছেলে তাদের মা জান্নাত আরা ঝর্না এবং মামুনুলের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। রয়েল রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পর এক ছেলে তো তার মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় মামুনুলকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। আরেক ছেলে ঘেন্নায় মায়ের সঙ্গে কথাই বলতে চাননি। মায়ের সঙ্গে ছেলের কথোপকথনে একটা বিষয় পরিষ্কার, তাদের সুখের সংসার ভাঙার জন্য মামুনুল হকই দায়ী। জান্নাত আরা ঝর্নার বড় ছেলে আব্দুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় মামুনুল হককে ‘জানোয়ার’ হিসেবে অভিহিত করে কীভাবে তিনি তাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়েছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন।
আব্দুর রহমানের পিতা হাফেজ শহীদুল মামুনুল হককে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু মামুনুল সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেননি। বরং হাফেজ শহীদুলের অনুপস্থিতিতে তার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী জান্নাত আরাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। তখন জান্নাত আরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর সেই শোধ নিতেই মামুনুল ছোট ছোট পারিবারিক ঝগড়াকে উস্কে দিয়ে সংসারটি ভেঙে দিয়েছেন এবং জান্নাত আরার দখল নিয়েছেন। এই বিবরণ কিন্তু জান্নাত আরার বড় ছেলের, যে কিনা অনেক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী।
গল্পের পরের অংশটা একদম জলবৎ তরলং- একদিকে ডিভোর্সি এক অহসায় নারী। অপর দিকে মামুনুলের মতো এক লোভী পুরুষ। শুনুন মামুনুল হকের জবানিতেই- “হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে যায় অনেকটা অসহায়। এক রকমের কূলকিনারাহীন। রাগের মাথায় সংসার ভেঙে গভীর সংকটে পড়ে যান তিনি। ওই পরিস্থিতিতে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আমার শরণাপন্ন হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেন। আর সেই দুঃসময়ে সহযোগিতা করার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না তার।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে আমি তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করি।” এই তো সব খোলাসা হয়ে গেল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেড়ে দেয়া স্ত্রীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে নিলেন মামুনুল। আহা, কী মানবিক হৃদয়! বুঝতে অসুবিধা হয় না, অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মামুনুল আসলে তাকে রক্ষিতা করেই রেখেছিলেন।
গল্পের পরের অংশটা শর্টকাট, “জীবনের করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্য নিয়মিতই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। এমতাবস্থায় একজন বেগানা নারীর সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক রাখাকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই, যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে আমার, তাকে বেগানা হিসেবে রেখে অভিভাবকত্ব করব না, বরং ইসলামি শরিয়তের আলোকে বৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি করে নেব। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলি এবং এ বিষয়ে তাদেরকে জানিয়ে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের কালেমা পড়ে বিবাহ করে নেই। দু বছর যাবত এভাবেই মানবিক ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি তার অভিভাবকত্ব করছি এবং একজন অসহায় নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করে একটি পুণ্যের কাজ করেছি বলে বিশ্বাস করি।”
প্রিয় পাঠক, আপনারা কি বিশ্বাস করেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংসার ভেঙে, তার ছেড়ে দেয়া স্ত্রীর অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং কলেমা পড়ে তাকে বিয়ে করাটা পুণ্যের কাজ? ইসলামে দ্বিতীয় বিয়ের বিধান আছে। তবে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে অবশ্যই প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু মানবিক গল্পে মামুনুল হক দ্বিতীয় বিয়ের আগে ‘ঘনিষ্ঠজনদের’ সঙ্গে পরামর্শের দাবি করলেও তিনি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেননি। এ কদিনের নানা কথাবার্তা, টেলিফোন কথোপকথনে এটা পরিষ্কার, অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিলেও মামুনুল আসলে সেই নারীকে বিয়ে করেননি। আর যদি করেও থাকেন, তাহলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি তো দূরের কথা, তাকে জানানওনি।
মানবিক গল্পে মামুনুল লিখেছেন, ‘যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে’, এখন কতদিন সেই বেগানা নারীর অভিভাবকত্ব লাগবে, সেটা অবশ্য মামুনুল পরিষ্কার করেননি। মামুনুল হকের মানবিক বিয়ের গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তার অনুসারীরাও যদি বিপদগ্রস্ত নারীদের বিয়ে করা শুরু করে, তাহলে তো বিপদ।
মানবিক বিয়ে নিয়ে মামুনুলের গাল-গল্প বিশ্বাস না করার আরেকটা বড় কারণ তার কসমের ধরন। ধরা পড়ার পর থেকে তিনি আল্লাহর কসম, আল্লাহর নামে হাজারবার শপথ, কুল্লামার শপথ ইত্যাদি নানা শপথ করছেন। এতদিন জানতাম, চোরের মায়ের বড় গলা। এখন দেখছি, লু…র গলাও কম বড় নয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলাম লেখক।