বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্বাধীনতার ঘোষণায় অহেতুক কুতর্ক

  • প্রদীপ মালাকার   
  • ৬ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৫৯

জিয়াউর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো দিন বলেননি যে, তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন অথবা জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রয়াত লে. কর্নেল আকবর হোসেন, প্রয়াত লে. কর্নেল মীর শওকত আলী এবং জীবিত কর্নেল অলি আহমদও (বীর বিক্রম ) জিয়ার জীবদ্দশায় কোনো দিন দাবি করেননি, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। জিয়া ১৯৭৩ সালে বিচিত্রা ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দেয়ার কথা বলেন এবং বঙ্গবন্ধুর উচ্চ প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরও জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা-বিষয়ক বিতর্কে এর আগে নামীদামি অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইভ টকশোতে এলডিপিপ্রধান ও সাবেক বিএনপি নেতা কর্নেল অলি আহমদ (বীর বিক্রম) জিয়াউর রহমানকে বারবার স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতারাও গত বছর স্বাধীনতা দিবস পালনকালে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে থাকেন। লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন সময়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেই ক্ষান্ত থাকেননি, তিনি জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। স্পষ্টতই বোঝা যায় আজও বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো জাতির এই নিষ্পত্তিমূলক ও স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের খেলা খেলছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ আসন পেয়ে (১৬৭টি আসন) পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যোগ্যতা লাভ করে। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও তার সুহৃদ পশ্চিম পাকিস্তানের কুটিল রাজনীতিবিদের চক্রান্তে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্থান্তর করতে অস্বীকার করে। ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এবং লাগাতার হরতাল, প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। তত দিনে বঙ্গবন্ধু ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও বুঝতে পারেন পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। কিন্তু তারও আগে সেই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-তে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়ে তিল তিল করে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন।

তার পর আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহয়ারর্দী উদ্যান ) প্রায় ১ লাখ মানুষের সমাবেশে স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দিবার না-ও দিতে পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে।’ আসলে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা। এই মহাসমাবেশ থেকেই বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে বাঙালি সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, সকল যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এয়ার লাইন্স বন্ধ রাখে। জনগণ সকল প্রকার খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো গংরা বিচলিত হয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব করেন। ২৩ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার অন্তরালে বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র এনে সমাবেশ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু আলোচনা শেষে সহকর্মী নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের কাছে প্রকাশ করেন, প্রহসনের আলোচনায়, ইয়াহিয়া তার দাবি মানবে না এবং তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, ইয়াহিয়া শক্তি প্রয়োগ করবে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল টিক্কা খানকে বাঙালি নিশ্চিহ্ন করতে আদেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে রাত ১১টায় সংবাদ পৌঁছে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে ট্যাঙ্কসহ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজারবাগ, পুলিশ লাইন, জগনাথ হলসহ সারা ঢাকায় গণহত্যা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সহকর্মী নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামানসহ ছাত্রনেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন এবং তাদের নির্দেশ দেন মুক্তাঞ্চল কিংবা ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার গঠন করতে।

নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সকল সহকর্মী, ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ও শেখ মনির প্রচণ্ড চাপ ও অনুরোধ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি নিরাপদ স্থানে চলে যাই, পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে না পেয়ে অধিক মাত্রায় গণহত্যা চালাবে, জনগণও আমাকে ভুল বুঝতে পারে।’ তারপর বঙ্গবন্ধু রাত ১২র পর আনুষ্ঠানিকভাবে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে অজানা স্থানে নিয়ে যায়। অন্যদিকে পরের দিন ২৬ মার্চ বেলা ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

এবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম পরিচালক যিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠে জিয়াউর রহমানকে সহযোগিতা করেন, সেই বেলাল মোহাম্মদের মুখনিঃসৃত বয়ান জানা যাক। বেলাল সাহেব ২০১১ সালে আমেরিকায় যান বেড়াতে। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনায় যোগ দেন। শুভ্র দাড়ি, মাথার চুলও সাদা, সুঠামদেহী বেলাল সাহেব বলেন, আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তরফ থেকেও প্রস্তাব এসেছিল, ফিরিয়ে দিয়েছি। যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন সত্য কথা বলে যাব।

আমরা কজন উৎসাহী হয়ে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে প্রশ্ন করলে বেলাল সাহেব বিষয়টি পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ থেকে ইপিআরের অধিনায়ক মেজর রফিক সাহেব আমাদের বেতারকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়ার কথা দিয়ে উনি না আসায় আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ যেকোনো সময় বিমান হামলা হতে পারে। তখন আমাদের মধ্যে একজন কর্মী বলেন, ‘স্যার পটিয়ায় জিয়াউর রহমান নামে একজন মেজর আছেন, তার কাছে গেলে হয়তো সাহায্য পাইতে পারি।’

তারপর আবুল কাসেম সন্দ্বীপকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ২৭ মার্চ সকালে বেতারকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর উদ্দেশ্যে পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে যাই। সেখান থেকে আমরা জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে করে কালুরঘাট ফেরত আসি। সেদিন রাত ৮টায় এক নতুন লিখিত ও সম্প্রসারিত বক্তব্যের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু তার একটু আগে জিয়া হেড অফ দ্যা গভর্নমেন্ট বলে একটা ছোট ঘোষণা দিলে আমরা সবাই ছুটে এসে বলি- মেজর সাহেব, এই ঘোষণায় দেশ-বিদেশে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে, বিদেশিরা মনে করবে সেনা বিদ্রোহ। একমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বই ঘোষণা দিতে পারে। গতকাল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি আজ সকালে চট্টগ্রাম থেকে ঘোষণাপত্রটি নিয়ে এসেছি। তার পরই জিয়া ভুল শুধরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে উল্লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

এবার এই নিবন্ধকারের নিজের স্মৃতি। আমি ’৭১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর দিন ২৬ মার্চে প্রাণে বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। আমাদের নরসিংদীর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা টাউন হল মাঠে (বর্তমান পৌরসভা) লঙ্গরখানা খোলে, ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে আসা হাজার হাজার অসহায় ও ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমি ও ছাত্রলীগের বড় ভাইদের সঙ্গে থেকে তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের সেবা করার সুযোগ পাই। এদিন বিকাল ৩টার দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার কয়েক সঙ্গী নিয়ে সড়কপথে নরসিংদী হয়ে লঞ্চযোগে তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ হয়ে আগরতলায় পৌঁছেন। যাত্রাপথে আমাদের টাউন হলের লঙ্গরখানায় আসেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। সঙ্গে আনা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা-সংবলিত স্লাইকোস্টাইলে লিফলেটের কয়েক হাজার কপি উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে বিলি করেন।

জিয়াউর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো দিন বলেননি যে, তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন অথবা জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রয়াত লে. কর্নেল আকবর হোসেন, প্রয়াত লে. কর্নেল মীর শওকত আলী এবং জীবিত কর্নেল অলি আহমদও (বীর বিক্রম ) জিয়ার জীবদ্দশায় কোনোদিন দাবি করেননি যে, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। জিয়া ১৯৭৩ সালে বিচিত্রা ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দেয়ার কথা বলেন এবং বঙ্গবন্ধুর উচ্চ প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরও জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বিভিন্নস্থানে উল্লেখ করেছেন। জর্জ মেগাবাইন নামে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তার এক গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, মুজিবের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা তার নামের ওপর যুদ্ধ করেছেন।

সে নাম ছিল এক মহামন্ত্র, আর সেই জাদুকরি মহামন্ত্র তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়াসহ সমগ্র রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন উজ্জীবিত। দীর্ঘ নয়টি মাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু শেখ মুজিবের নামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ও পরিণতি লাভ করেছিল।

জে. ইয়াহিয়া খান স্বাধীনতার ঘোষণা ও দেশকে বিভক্ত করার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় শেখ মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করে। শুধু নয়টি মাস পাকিস্তানি সরকারের মাথাব্যথা ছিল শেখ মুজিব এবং ওই সময় পাকিস্তানি সরকারের কাছে জিয়াউর রহমানের কোনো গুরুত্ব ছিল না। জিয়াউর রহমানের গুরুত্ব ছিল অন্য দশটি সেক্টর কমান্ডারের মতো।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিএনপি নেতা লে. কর্নেল শওকত আলী একদিন হঠাৎ করেই ঘোষণা করেন, জিয়া ২৬ মার্চ সকালে ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এই ড্রামতত্ত্ব প্রতিবাদের ঝড়ে বুমেরাং হয়ে যায়। জিয়া জীবিত ও ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর প্রতীক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) তার গ্রন্থ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ উল্লেখ করেছেন- জিয়া, ২৬ মার্চ সকাল ৯টায় পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাস করার জন্য যান। কই জিয়াতো তখন প্রতিবাদ করেননি। জিয়ার ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রেরণা ও সান্ত্বনা জুগিয়েছে এই কারণে যে, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক ভাইয়েরা আমাদের সঙ্গে আছে। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকেই খালেদ মোশারফ, সফিউল্লাহ, মেজর রফিক প্রমুখ সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপ্রাপ্তির পর পরই যার যার অবস্থান থেকে শত্রু সেনাদের ওপর হামলা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মুজিবনগরে সেনাকর্মকর্তাদের সম্মেলনের মাধ্যমে ১১টি সেক্টরের একটি সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জিয়া তার অবস্থানে ফিরে এসে যুদ্ধ শুরু করেন, এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু এই স্বাধীনতার ঘোষণার বিতর্ক আর কতকাল চলবে?

আমাদের সংবিধানেই স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ক বিতর্কের সমাধান আছে। বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটিই মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার দলিল হিসেবে গ্রহণ করে এবং তা ৭২-এর সংবিধানে সংযোজন করা হয়। আর এই সংবিধানের অধীনে জিয়া, এরশাদ, খালেদা অনুগত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে গেছেন দীর্ঘ সময়। তখন কোনো প্রশ্ন কেউ তোলেননি। আজ বিএনপির বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, নেতৃত্ব ও জাতির পিতা মানতে এত অনীহা কেন? কেনইবা সব কিছুতে অস্বীকার করার প্রবণতা।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিএনপির অতীত বলতে কিছু নেই। জিয়াউর রহমান ১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে মুসলিম লীগ, কিছু বাম ( ভাসানি ন্যাপ) ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে প্রথমে জাগদল ও পরে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। দলটির মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা থাকার সুবাধে দলটিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্রেডিট নেয়ার জন্য এই প্রয়াস। সেই জন্যই বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপাঠককে গোয়েলবসীয় কায়দায় ঘোষক প্রচার করতে থাকে। তারা জানে বার বার ঘোষক হিসেবে প্রচার করলে পুরাতন প্রজন্ম না হোক, নতুন প্রজন্ম একদিন বিশ্বাস করবে। তারা হয়তো ভুলে গেছেন বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বার বার মিথ্যাচার করে কোনো লাভ হবে না। তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে নতুন প্রজন্ম অনায়াসে ’৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্কাইভে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সন্ধান পেয়ে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথা আন্তর্জাতিক ইতিহাসে ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং অবদানের কথা উল্লেখ আছে। কাজেই জাতির হৃদয় থেকে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে কখনও মুছে ফেলা যাবে না। বাংলাদেশে আলো-বাতাস, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যতদিন বহমান থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বালিয়ে বেঁচে থাকবেন।

লেখক: প্রবাসী গবেষক, প্রাবন্ধিক।

এ বিভাগের আরো খবর