বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তার বিশেষ কৃতিত্ব হলো, তিনিই জাতীয় পর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর লন্ডনের মাটিতে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম পাকিস্তানি গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা, পাকিস্তানের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন এবং পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জোরালো দাবি জানান।
বিবিসি এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসের টেলেক্স মেসেজে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকসহ গণহত্যার খবর শুনে স্বাধীনতা ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ২৭ মার্চ শনিবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের তৎকালীন প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সামনে আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে ‘এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক রইল না। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাব আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা-নির্মমতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাব। তারা আমার ছেলেমেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকহত্যায় গভীরভাবে মর্মাহত বিচারপতি চৌধুরী তার ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন :
পাকিস্তানিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কথা বলার সময় আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। শুধু বাঙালি বলে অবাঙালিরা তাদের হত্যা করায় আমার জাতীয় সম্মানে আঘাত লাগল। যে মানুষ নিজেকে বাঙালি মনে করে তার একটিমাত্র কর্তব্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা। মনে পড়ল জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সরকারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ আর স্যার জন হাবার্টের চক্রান্তে মন্ত্রিসভার অবসান ঘটলে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি গ্রাম থেকে গ্রামে, ঘর থেকে ঘরে যেয়ে এই অন্যায়ের কথা দেশবাসীকে জানাব।’ আমিও বললাম- ‘বিশ্ববাসীকে এই গণহত্যার কথা জানাব, চাইব প্রতিকার। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে।’
জমিদার পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম আবু সাঈদ চৌধুরীর। রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা একজন শিক্ষাবিদ ও বিচারপতি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ ভূমিকার জন্য জাতীয় বীরে পরিণত হন। এই ইতিহাস সৃষ্টির অনেকখানি ভার তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ওই সময় বিদেশ সফররত এই শিক্ষাবিদকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কেউ উদ্বুদ্ধ করেননি। শুধু দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার লক্ষ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদান করতে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে খবর পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ সংবাদ পাওয়ামাত্র এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। অথচ ছাত্রহত্যার ব্যাপারে তার কোনো দায় ছিল না। এমনকি তিনি দেশেও ছিলেন না। এভাবে মর্যাদার আসন ছেড়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার নজির ইতিহাসে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগপত্রে স্পষ্ট ভাষায় লিখেন-
‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’
যদ্দুর মনে পড়ে ভারতে একবার রেল দুর্ঘটনার দায় কাঁধে নিয়ে রেলমন্ত্রী (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন।
১৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদ ছেড়ে দেয়ার ১০ দিনের মাথায় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। ২৬ মার্চ সকালে বিবিসির খবরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের ভাসা ভাসা খবর প্রচারিত হয়। বিবিসির খবর শুনে বিচলিত বিচারপতি চৌধুরী মানবাধিকার কমিশনের সভায় উপস্থিত হয়ে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত বিবিসির খবরের কথা জানান। ঢাকায় গণহত্যার খবর শুনে বিচারপতি চৌধুরী ২৭ মার্চ শনিবার পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের ৯ মাসে বিশ্ব জনমত গঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে সদর দপ্তর স্থাপন করে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নানা দেশে বেড়িয়ে সম্পন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও তাদের দোসরদের প্রাণনাশের হুমকির মুখে অবিচলিত, শান্ত এই কর্মবীর সাহসের সঙ্গে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে কাজ করে গেছেন। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে বিশ্বের শক্তিশালী কিছু দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আপস-মীমাংসার চেষ্টা চালায়। দেশ ও জাতির ঐ সংকটকালীন বিচারপতি চৌধুরীর অবিস্মরণীয় উক্তি ছিল- ‘লন্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে- তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করে দেশে ফিরব না।’
অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। টাঙ্গাইলের নাগবাড়ি গ্রামে জমিদার পরিবারে ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি জন্ম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন। মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ চৌধুরীর পাঠ্যাতিরিক্ত বিষয়েও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ১৯৪০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এমএ এবং বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে লন্ডনের লিংকনস্ ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বর্বর সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। জেনেভায় অবস্থানরত বিচারপতি চৌধুরী এবারও দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেননি। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি দস্যুদের দ্বারা বাঙালি হত্যাযজ্ঞের খবর পরের দিন সকালে বিবিসির সংবাদে তিনি অবহিত হন। কিছুক্ষণের মধ্যে মানবাধিকার কমিশনের সভায় উপস্থিত হয়ে বিচারপতি চৌধুরী বাংলার মানুষের হত্যার কথা জানান। জেনেভা থেকে অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে লন্ডন ফিরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ঢাকা থেকে প্রেরিত টেলেক্স পড়ে কালরাত্রির খবরাখবর তিনি জানতে পারেন।
বাঙালি জাতির ওই ক্রান্তিলগ্নে এভাবে প্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জান্তার হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিচারপতি চৌধুরী কাজ করার ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দেন। এই সিদ্ধান্ত তার পরিবারের সদস্যদের এবং তার জীবনের জন্যও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, তখনও তিনি জানতেন না বাঙালি জাতির মুক্তির কান্ডারি বঙ্গবন্ধু কোথায়? বাংলাদেশ সরকার তখনও গঠিত হয়নি। প্রথম সারির নেতারা নিহত, গ্রেপ্তার নাকি আত্মগোপনে- কিছুই তার জানা ছিল না। জাতির ওই সংকটময় মুহূর্তে বিচারপতি চৌধুরীর দেশের পক্ষে কাজ করার ওই সরব ঘোষণা শুধু ঐতিহাসিক বললেই দায়িত্ব শেষ হবে না, এটা ছিল পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। শুধু এই একটি মাত্র সিদ্ধান্তের জন্য বাঙালি জাতির ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিনগত মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঢাকাসহ পূর্ব বাংলায় সব কটি সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি আর্মি বের হয়ে এসে সিভিলিয়ানদের ওপর একযোগে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগের বড়-ছোট নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। পাকিস্তানি বেতারে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ অন্যদিকে চট্টগ্রামস্থ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’ বাংলাদেশে পত্রপত্রিকা বন্ধ। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে জনগণ পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু বন্দি না মুক্ত, জীবিত না মৃত কেউ জানে না। দেশের বেতার-টিভি পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লন্ডন, আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হলেও বাংলাদেশের মানুষের এ ব্যাপারে জানার সুযোগ ছিল না।
দেশ-বিদেশের বাঙালি সন্তানরা ওই সময় এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ১৬ দিনের মাথায় ১০ এপ্রিল ভারতের অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক দীর্ঘ বেতার ভাষণ দেন।
১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ শপথ গ্রহণ করেন। তখন দেশ-বিদেশের মানুষ নিশ্চিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১ দিন পর ২৭ মার্চ শনিবার ছুটির দিনে খোদ লন্ডন শহরে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী একজন বীরের মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর ওই বীরোচিত ঘোষণা শুধু লন্ডন বা আমেরিকায় অবস্থানরত বাঙালিদের নয়, বাংলাদেশের জনগণসহ সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালি সন্তানদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।
ঐতিহাসিকরা হয়তো একদিন লিখবেন- ‘২৬ মার্চের পর পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর অবস্থান, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সারা বাংলায় গণহত্যা, আওয়ামী শীর্ষ নেতাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে দেশ-বিদেশের মানুষ যখন কিছুই জানতে পারছিল না, তখন একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ আবু সাঈদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণার পর ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এরপর তিনি কমনওয়েলথ সচিবালয় সাধারণ সম্পাদক আর্নড স্মিথের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় গণহত্যা বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে অনুরোধ জানান।’
১০ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের সঙ্গে আবু সাঈদ চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়। লর্ড হিউম তাকে দেখেই বলেন, ‘পাকিস্তানের হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। চিন্তার কারণ নেই।’ বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচানোর জন্য চেষ্টার অনুরোধ জানান। হিউম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট খবর আছে। শেখ মুজিব ভালোই আছেন।’ ওই দিনই ১০ এপ্রিল বিকেল ৪টার সময় বিচারপতি চৌধুরী বিবিসিতে যান। মি. পিটারগিল একক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি পাকিস্তানিদের গণহত্যাসহ পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বিস্তারিত বলেন। বিবিসির দুজন সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এবং শ্যামল লোধ বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য নেন এবং প্রচার করেন। বিবিসি তখন সকাল-বিকাল বাংলাদেশের খবর বিশেষভাবে প্রচার করত। এভাবে বিচারপতি চৌধুরী ২৫ মার্চের পর থেকে লন্ডনে দ্বারে দ্বারে ঘুরে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে চাঙা করে তোলেন।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতার অবস্থান না জেনে এবং যুদ্ধকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগে লন্ডনে মুক্তিসংগ্রামের সপক্ষে কাজ শুরু করে দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করেন। যুক্তরাজ্যে নানা দলমতে বিভক্ত বাঙালিদের তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন। মূলত তিনি ছিলেন বহির্বিশ্বে বাঙালিদের ঐক্যের প্রতীক। ইউরোপ ও আমেরিকার বাঙালি সমাজকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মন্ত্রে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন। ২৩ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে বিদেশে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করে।
বিচারপতি চৌধুরী ২৭ আগস্ট লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করেন। তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক গিয়ে সেসব দেশের সরকার, জনপ্রতিনিধি, বিচারক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাস এবং সাইপ্রাস, যুগোশ্লাভিয়া ও আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস, অ্যাসেসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট ও কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মতো আন্তর্জাতিক সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে প্রচার করতে তার নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে যায়। প্রতিনিধিদল জাতিসংঘে প্রচারকার্য চালাবার সময় বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছায়।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বিচারপতি চৌধুরী ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালিদের এক কাতারে শামিল করতে সক্ষম হন। ওই সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত হলেও মূলত তিনি বাংলাদেশ সরকারের অঘোষিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্মানজনক পরিসমাপ্তির প্রসঙ্গটি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অবগত করার উদ্দেশ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তিন সপ্তাহব্যাপী পাশ্চাত্যের দেশগুলো সফর করেন। ২৯ অক্টোবর মিসেস গান্ধী ভিয়েনা থেকে লন্ডনে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিচারপতি চৌধুী ক্লারিজেস হোটেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৪৫ মিনিটের এই সাক্ষাৎকারে দুজনের মধ্যে মূলত পাশ্চাত্য দেশসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কী মনোভাব পোষণ করেন সে বিষয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বিচারপতি চৌধুরী ভারত কেন স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষজনক উত্তর দেন।
মুক্তিসংগ্রামের ওই কঠোর দিনগুলোতে বাঙালি জাতিসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ, সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনের সমর্থন ভালোবাসা যেমন বিচারপতি চৌধুরী পেয়েছেন, তেমনি পাকিস্তান সরকার ও তাদের দোসররা পদে পদে তাঁর কর্মকাণ্ডে বাধার সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানিরা তার কার্যকলাপ সম্পর্কে ব্রিটেনের কাছে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ করেছে। বিভিন্ন সময় তার সভা পণ্ড করার চেষ্টা করেছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সে সময় সার্বক্ষণিকভাবে তাকে পাহারা দিয়েছে। ’৭১-এর সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন ও অপরাধমূলক কাজের অভিযোগের দায়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারেনি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন-
‘বিচারপতি চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল, যে কাজে তিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন তাঁর দৃঢ় যুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের মনে। বাঙালির অন্তর্নিহিত শক্তি ও আন্তরিক ইচ্ছার ওপর তাঁর আস্থা ছিল অপরিসীম। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, সত্যের জয় হবে। তাই অতো জোরের সঙ্গে তিনি বলতে পেরেছিলেন, “লন্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে। তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করে দেশে ফিরব না।” বিচারপতি চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।’
’৭২-এর ৮ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১০ জানুয়ারি দেশে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বিচারপতি চৌধুরী মাত্র ৫১ বছর বয়সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলেন।
বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাবার্তা সম্পাদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতম আঘাতের ফলে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ’৭১-এর বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তি নন, বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, তার নামেই স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। কোনো ব্যক্তির নাম যখন প্রেরণার উৎস হয়- তখন তিনি ইতিহাসে স্থায়ী মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হন।... বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে স্বাদেশিকতা, স্বাজাত্যবোধ জাগিয়েছেন, সর্বোপরি এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক-সাংবাদিক।