মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর যে ধন্যবাদ জ্ঞাপনপত্রটি দিয়েছেন, তা পড়ে বিস্মিত হলাম। দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সরকার ১৮টি স্বাস্থ্যবিধি ঘোষণা করেছেন। নিজেদের ঘোষিত সেই স্বাস্থ্যবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে কীভাবে তারা সারা দেশে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করল?
আমরা মনে করি এটা নিশ্চয়ই অপরাধ। দেশে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণের দিন ১ লাখ ১৬ হাজার পরীক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে একটা অপরাধ করেছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর ধন্যবাদ জানানোর মাধ্যমে সেই অপরাধকে স্বীকারের পাশাপাশি আরও বাড়িয়েছে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেই সরকারি আদেশ অমান্য করল। তাহলে জনসাধারণ অমান্য করলে দোষটা কোথায়? তাদেরকে কি সরকার শাস্তি দেয়ার কোনো অধিকার রাখে? বুঝতে পারি না, শিক্ষা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে সরকারি নিয়ম অগ্রাহ্য করতে পারে?
এই পরীক্ষা দিতে আসা এক লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে, পরীক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষকদের কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, সেটা কি একবারও ভেবেছেন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ? গতবার ‘তাইরে নাইরে’ করে পার পাওয়া গেলেও যে, এই দ্বিতীয় ওয়েভে পার পাওয়া যাবে না, তা কি স্বাস্থ্য বিভাগ বা অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় জানে না?
প্রত্যেক পরীক্ষার্থীসহ পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু যে ভিড়ের ছবি প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে তো মনে হয়নি স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মানা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জানের মায়া ত্যাগ করে, করোনাভীতি উপেক্ষা করে পরীক্ষার হলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। পরীক্ষা যারা গ্রহণ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চিকিৎসক হওয়ার পরীক্ষা দিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ল।
গতবার করোনা শুরু হওয়ার পর মানুষজন যখন বেড়াতে যাচ্ছিল, কেনাকাটা করছিল, গার্মেন্টসগুলো তাদের কর্মীদের আনা-নেয়া করছিল, আমরা তখন খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এবার দেখছি সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ খোদ সেই কাজটিই করল। এরকম একটি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেয়া ধন্যবাদকে খুবই হাস্যকর মনেহচ্ছে।
যদিও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি পালন না করায় ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে, তাতে কর্তৃপক্ষের কারো কোনো অপরাধবোধ তৈরি হবে কি না জানার উপায় নেই। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে বলে ধন্যবাদ জানানো হলেও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসকরা বলছেন, ‘স্বাস্থ্যবিধির কোনো কিছুই মানা হয়নি।’
এই ভয়াবহ পরিবেশে পরীক্ষাটা না নিলে বা কিছুদিন পরে পরীক্ষা নিলে ঠিক কী অসুবিধা হতো, তা আমরা বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ সময়ের হিসেবে কিছুটা দেরি হয়ে যেত, কিন্তু এতগুলো মানুষকে তো বিপদের মুখে দাঁড়াতে হতো না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই সেদিন বলেছেন যে, প্রতিদিন এতবেশি পরিমাণে করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকলে, পুরো শহরকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করলেও আমরা জায়গা দিতে পারব না। সেখানে তার অধীনস্থ বিভাগ কীভাবে এরকম দায়িত্বহীন কাজ করল?
জীবন আগে না পরীক্ষা আগে? দেশের প্রায় ৩ কোটিরও বেশি ছাত্রছাত্রী যখন স্কুলে যেতে না পেরে গত একবছরেরও বেশি হাত-পা গুটিয়ে অসহায় অবস্থায় বসে আছে, তখন এই সোয়া লাখ ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া কেন? জানতে ইচ্ছা করছে পরীক্ষা হল পরিদর্শনে কি স্বাস্থ্য সচিব, মহাপরিচালক কেউ কি গিয়েছিলেন?
একইভাবে বিকালে প্রত্যক্ষ করলাম হেফাজতিদের বিশাল সমাবেশ। হেফাজতিরা মনে করে যে তারা জোশেই পার পেয়ে যাবে। কাজেই সরকারি বিধিনিষেধকে তোয়াক্কা না করলেও চলে। তাদের এই সমাবেশ নির্বিঘ্নে হলো। তারাও অপরাধ করল, সরকার তাদেরও বাধা দিলো না। অবশ্য হেফাজতিদের অপরাধ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অপরাধ এক নয়। হেফাজত বা অন্য নাগরিক অসচেতন হতে পারে, নিয়ম না মানার মতো ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে, কিন্তু সরকার নিজেই তাদের ঘোষিত নিয়ম অমান্য করতে পারে না। কাজেই কোনো জমায়েতের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়ার অধিকার আর থাকলো কি সরকারের?
প্রশ্ন হলো, সরকার কেন এমন বিধিব্যবস্থা দেয়, যা তারা নিজেরাই মানে না। অন্যরা না মানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না অথবা স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করার ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধার দিকটিও নজরে আনা হয় না। যেমন করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল গণপরিবহন চলবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। আর তার জন্য যাত্রীদের গুণতে হবে ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া।
৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া দিতে গিয়ে একজন বাসযাত্রীর জীবনে যে কতটা ভোগান্তি নেমে আসতে পারে, তা কি হুকুমদাররা জানেন না? নাকি জানলেও কিছু আসে-যায় না। যারা এ ধরনের অত্যাচারী নিয়ম-কানুন চালু করেন, তারা কেউ গণপরিবহনে যাতায়াত করেন না। তাদের কাউকে বাড়তি বাসভাড়া দিতে গিয়ে হাসফাস অবস্থায় পড়তে হয় না এবং তাদের কাউকে নির্দিষ্ট আয়ে সংসারও চালাতে হয় না।
বাসওয়ালারা যেহেতু যাত্রীদের কাছ থেকে ব্যাপক ভাড়া আদায় করতে পারছে, কাজেই তাদের বেশ উৎসাহভরে কম যাত্রী নিতে সমস্যা নেই। গণমাধ্যমও তাই রিপোর্ট করেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি এতে করে যাত্রীরা কতটা নতুন বিড়ম্বনায় পড়েছেন। বেশিরভাগ যাত্রীই সময়মতো বাসে উঠতে পারছেন না।
বিশেষ করে, সকাল ও বিকেলের দিকে অফিস ও বাসামুখী মানুষকে পড়তে হয়েছে বেশি সমস্যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বাসে উঠতে পারেননি অনেক চাকরিজীবী। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নারী অফিস যাত্রীরা। বাসে সিট কম বলে একটি বাস থামার সঙ্গে সঙ্গে যে হুড়োহুড়ি হচ্ছে, তাতে তারা উঠতে পারছেন না।
পরিচিত একজন ব্যাংক-চাকরিজীবী নারী জানালেন, বুধ ও বৃহস্পতিবার তাকে অনেক ভাড়া গুণে সিএনজিতে মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে হয়েছে। এভাবে সাতদিন চললে বেতনের অর্ধেক চলে যাবে পরিবহনে। সীমা সুলতানা গর্ভবতী এবং কাজ করছেন কারওয়ান বাজারের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব, হুড়োহুড়ি করে বাসে ওঠাও অসম্ভব আবার অতিরিক্ত ভাড়া গোনার মতো বেতনও তার নয়। তাহলে তার উপায় কী হবে? অফিসতো যেতে হবে ৫ দিনই।
তনয় রহমান একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বললেন সরকার তাদের কর্মীদের হোম অফিস দিলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এত তাড়াতাড়ি এবার আর হোম অফিসে যাবে না। তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গাড়ির সুবিধা পান শতভাগ। কিন্তু আমাদের কী হবে? এই বাড়তি ভাড়া দিয়ে, প্রতিদিন প্রতিযোগিতা করে বাসে ওঠা অসম্ভব। হয় সরকার হোম অফিস বাধ্যতামূলক করুক সবার জন্য অথবা পরিবহন উন্মুক্ত করে দিক। আমরা মারা যাই, করোনা আক্রান্ত হই- এটা সরকারকে দেখতে হবে না। তনয়ের ভাষায়, ‘প্লিজ লেট আস টু ডাই’। কিন্তু গণপরিবহনে সিট কমিয়ে, ভাড়া বাড়িয়ে, প্রতিদিন অফিস করতে গিয়ে আমরা আর নাকাল হতে চাইছি না। গতবছরও আমরা এই অতিরিক্ত ভাড়া দিতে গিয়ে ভোগান্তি সয়েছি। অনেকেই গা ঘেষাঘেষি করে ভ্যানগাড়ি ও তরকারিবাহী খালি ট্রাকে করে অফিসে গিয়েছি।
নিউজে দেখলাম বাসের কন্ডাক্টররাও বলছেন, বাড়তি ভাড়া আদায় করতে গিয়ে খুব বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকাংশ যাত্রী বাড়তি ভাড়া দিতে চাইছেন না। বলছেন, অতিরিক্ত যাত্রী ওঠাতে।
অপরদিকে বাড়তি যাত্রী পরিবহন করলে আমাদের জরিমানা হতে পারে এবং হচ্ছেও।
করোনা সংক্রমণের এই দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে বলে আমাদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বার বার বলছেন। ইতোমধ্যেই করোনা রোগীদের ভর্তি হওয়ার মতো সিট নেই হাসপাতালে। এই করোনা ঝুঁকির সময়ে আমরা এমন অনেক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি, যেখানে শিশু-কিশোরসহ লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে।
সরকার অবশেষে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, সেই পদক্ষেপের মধ্যে ফাঁক থেকেই গেল। জনদুর্ভোগের ইস্যুটি তারা ভাবেননি। অফিস, ব্যাংক, আদালতসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান শতভাগ খোলা রেখে শুধু পরিবহনের ওপর চাপ দিলে কি স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে? এ ধরনের নির্বুদ্ধিতার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর, সরকারঘোষিত স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করার পর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক যখন বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিককে বলেন, “আমরা তাদের বেটার ফিউচারের জন্য এটা করেছি, আপনি সেটা দেখছেন না।” তখন আসলেই প্রশ্ন জাগে, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সরকার সিরিয়াস কি না? নাকি দেশের বেটারমেন্টের জন্য তারা আরও অযৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই থাকবে?
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন