বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হেফাজতে ইসলামের স্ববিরোধী অবস্থান

  •    
  • ৪ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:১৩

ভারতের মুসলমানদের প্রতি অতি দরদ আর শ্রীলঙ্কা ও চীনের মুসলমানদের নিপীড়নের বিষয়ে নীরব থাকা, পাকিস্তান ও তাদের দোসরদের গণহত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে নির্বিকার থাকা তথা হঠাৎ সরব হওয়া আবার সুযোগ মতো নীরব থাকার নীতি হেফাজতের স্ববিরোধী অবস্থানের কথাই জানান দেয়।

একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে হেফাজতে ইসলামের পরিচিতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে এর যাত্রা শুরু। হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১১ সালে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পর পরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি।

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর আবারও আলোচনায় আসে সংগঠনটি। দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা ১৩ দফা উত্থাপন করে। দাবিগুলোর বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৩ দফা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রথমে সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে। ওই সমাবেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট ও এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সমর্থন দেয়। একপর্যায়ে সমাবেশ থেকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, ডাক দেয়া হয় সরকার পতনের। ওই রাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অভিযানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।

অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও সেসময়ের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম ভোটের ভাগ্যনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম অংশ নেবে এমন প্রচারও ছিল।’ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক আইডিতে লেখা আছে ‘একটি অরাজনৈতিক, দ্বিনি ও ইসলাহী সংগঠন’।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বিনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং যখন আপন সম্প্রদায়ের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে তখন তাদের সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে”। (সুরা তওবা: ১২২)

হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার শুরুতে আমার ধারণা হয়েছিল এমন একটি সংগঠন ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করতে ও বহুধারায় বিভক্ত মুসলমানদের একত্রিত করতে সহায়তা করবে। কিন্তু সহসাই আশাভঙ্গ হলো। হেফাজতে ইসলাম নিজেকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও এটি জাতীয় রাজনীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করল। দেখা গেল, হেফাজতের অনেক নেতা বিএনপি-জামায়াতের ২০-দলীয় জোটের হেফাজতকারীও বটে।

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ঢাকার উপকণ্ঠ ঘেরাও, তারপর সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে শাপলা চত্বরে কিছু সময় অবস্থানের অনুমতি নিয়ে সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের সিদ্ধান্ত, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হেফাজতকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা এবং হেফাজতের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিএনপির নেতাকর্মীদের রাস্তায় নেমে আসার ঘোষণা, শাপলা চত্বরে সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে হাজার হাজার হেফাজতকর্মীকে হত্যার মিথ্যা গুজব রটানো, জীবিত হেফাজতকর্মীকে মৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে শাপলা চত্বরে নিহতদের তালিকা প্রকাশ- পুরোটাই অপরাজনীতি, কোনোভাবেই ইসলামি অন্দোলন নয়।

হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি নিয়ে একাধিক কওমি আলেমও অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর জীবনকর্ম, অবদান’ শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় হেফাজতের সাবেক নেতারা দাবি করেন, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে সংঘটিত পুরো ঘটনার দায়ভার হেফাজতে ইসলামের ওই সময়ের মহাসচিব ও বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর। তারা অভিযোগ করেছেন- তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে না জানিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রাতভর শাপলা চত্বরে রেখে দেন বাবুনগরী। আল্লামা শফী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে; কিন্তু তিনি হুজুরকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তার ধারণা ছিল, সারারাত শাপলা চত্বরে অবস্থান নিতে পারলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নামতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ অরাজনৈতিক তকমাধারী হেফাজতের কোনো কোনো নেতা সরকার উৎখাতের অপচেষ্টা চালিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কোভিডের কারণে কয়েকজন এসেছেন, অন্যরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি বিজেপির নেতা হিসেবে নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদযাপনে যোগ দিতে এসেছেন। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে যিনিই ভারতের সরকারপ্রধান থাকতেন তিনি আমন্ত্রিত হতেন।

মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের কয়েক দিনব্যাপী তাণ্ডবের ফলে এর অরাজনৈতিক খোলসটা পুরোপুরি খুলে গিয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সরকার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তা বাতিল করার আহ্বান জানায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। হেফাজতে ইসলামের দাবি ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনে এমন কাউকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা উচিত হবে না, যাকে এদেশের মানুষ চায় না বা যার আগমন এদেশের মানুষকে আহত করবে। কারণ নরেন্দ্র মোদি একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। ভারতে ঘটা মুসলিমবিরোধী একাধিক সহিংস ঘটনার জন্য নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি করে হেফাজত।

মুসলিমবিদ্বেষ ও মুসলিমবিরোধী একাধিক সহিংস ঘটনায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার জন্য মোদির সফরের বিরোধিতা করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ভয়ংকর গণহত্যা হয়েছে লাখ লাখ কন্যা-জায়া-জননী ধর্ষিতা হয়েছে, হেফাজত সে কারণে পাকিস্তান বা তাদের দোসরদের নিন্দা বা বিচার দাবি করেছে বলে আমার জানা নেই। বরং, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে সোচ্চার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের কৌশলে প্রতিহত করতে নাস্তিক, ব্লগার প্রতিহত করার নামে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যদি পাকিস্তান সরকার আমন্ত্রিত হতো তবে হেফাজত মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে পাকিস্তান সরকারের আগমনকে প্রতিহত করতে যেকোনো উদ্যোগ নিত না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগে নরেন্দ্র মোদির আগমন প্রতিহত করতে তাণ্ডব চালিয়েছে হেফাজত।

শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে একইরকম মুসলিম বিদ্বেষ ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু হেফাজত এক্ষেত্রে নীরব। ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় হোটেল ও চার্চে উগ্রবাদীদের বোমা হামলার ঘটনার পর সেখানকার মুসলমানদের ওপর সেই দেশের সরকারের জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। ১ হাজার ৭শ’ ২০ জন মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি মসজিদে মুসলমানরা নামাজ আদায় করতেও যেতে পারত না। মসজিদ ভেঙে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। সে সময় ৯ জন মুসলমান মন্ত্রী ও ২ জন প্রাদেশিক গভর্নর পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকারীরা জানায় তাদেরকে সরকার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হচ্ছে না। গত বছর শ্রীলঙ্কায় করোনায় মারা যাওয়া সবাইকে বাধ্যতামূলক আগুনে পোড়ানোর আইন করা হয়, যা মুসলিমদের জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন সরকার প্রণীত এই আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দেশটির মুসলিম জনগোষ্ঠী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের নির্দেশিকায় কভিড-১৯-এ মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শ্মশানে পোড়ানো ও মাটিতে দাফন উভয় পদ্ধতির অনুমোদন দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার ভূগর্ভস্থ পানিতে করোনা ছড়ানোর অজুহাত তুলে মুসলিম মৃতদেরও আগুনে পোড়ানোর আইন করে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও দেশটির বিরোধী দলসহ মুসলিমরা এ আইনের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এর প্রেক্ষিতে রাজাপক্ষে সরকার শ্রীলঙ্কায় করোনায় মারা যাওয়া মুসলিমদের ইসলামিরীতি অনুসরণ করে মালদ্বীপে দাফনের জন্য মালদ্বীপ সরকারকে অনুরোধ করে। জাতিসংঘের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক আহমদ শহিদ এক বিবৃতিতে শ্রীলঙ্কা সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী আইনের নিন্দা জানান। তিনি আরও দাবি করেন শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের মালদ্বীপে দাফন শ্রীলঙ্কার মুসলিম সমাজকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করবে। অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার জননিরাপত্তা বিষয়কমন্ত্রী শরথ বীরাসেকেরার বোরকা নিষিদ্ধকরণ ও হাজারের বেশি ইসলামিক স্কুল বন্ধের ঘোষণা নিয়ে তোলপাড় শ্রীলঙ্কা। এই সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কাজও প্রায় শেষ।

সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে বলেছেন, মুসলিম নারীদের জন্য শ্রীলঙ্কায় বোরকা পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি। বোরকা নিষিদ্ধের জন্য কিছু মহলের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলেও শ্রীলঙ্কার সরকার তা এখনও গ্রহণ করেনি বলেও জানান তিনি। রয়টার্স সূত্রে খবর, শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভা অনুমতি দিলেই এটিকে আইন হিসেবে কার্যকর করা হবে। অনুমোদন দিলেই শ্রীলঙ্কায় বোরকা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ করে দেয়া হবে ইসলামিক স্কুলগুলোও। এই প্রসঙ্গে বীরাসেকেরা বলেছেন, জাতীয় সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতেই তিনি এই ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, অতীতে এখানে কেউই বোরকা পরতেন না। তবে বর্তমানে এটি অনেক বেশি করে দেখা দিয়েছে। স্কুলগুলো বন্ধ প্রসঙ্গে তার মত, এই স্কুলগুলো জাতীয় শিক্ষানীতি লঙ্ঘন করছে। তাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়েছে।

চীনে উইঘুর মুসলিম নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে, ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, বন্দি শিবিরে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো হয়, শরীরে সুই ফুটিয়ে নির্যাতন করা হয়, প্লাইয়ার দিয়ে তুলে নেয়া হয় নখ। বিবিসির আরেক প্রতিবেদনে প্রকাশ, চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের জন্য যেসব ‘পুনঃশিক্ষণ’ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে- তাতে নারীরা পরিকল্পিতভবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। এই নারীদের একজন হচ্ছেন তুরসুনে জিয়াউদুন।

বিবিসিকে দেয়া তার এই বর্ণনা তিনি বলেছেন, তখন কোনো মহামারি চলছিল না কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকত। কখনও কখনও তারা আসত মধ্যরাতের পরে। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমতো কোনো একজন নারীকে বেছে নিত। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোনো ক্যামেরা ছিল না। তিনি বলছেন, ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তার পর মুখোশপরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করত। জিয়াউদুন বলেন, শিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এই গোপন বন্দি শিবিরে বাস করেছেন মোট ৯ মাস ।

এই সময়ে তিনি নিজে তিনবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরের দরজায় লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কোড, বসানো হয়েছে মুখ দেখে শনাক্ত করা যায় এরকম ক্যামেরা। ফলে কোন বাড়িতে কারা যাচ্ছেন, থাকছেন বা বের হচ্ছেন তার উপর কর্তৃপক্ষ সতর্ক নজর রাখতে পারছে। তাদেরকে নানা ধরনের বায়োমেট্রিক পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।

চীনা গবেষক আদ্রিয়ান জেনজের লেখা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে নতুন এক তথ্য। প্রতিবেদনে প্রকাশ, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুসলিম নারীদের দেহে জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্র বাসনো বা বন্ধ্যা করানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে চীন। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় ও অন্য স্বাধীনতার ক্রমে ক্রমে হরণ করেছে এবং গণ-নজরদারি, বন্দিত্ব, ধর্ষণ, মগজ ধোলাই এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণের ভয়ংকর নিপীড়নমূলক এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই নীতির উদগাতা।

শ্রীলঙ্কায় মুসলিমবিদ্বেষ ও নিপীড়ন সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর বাংলাদেশ সফরের সময়ও হেফাজত মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনে বিপ্লবী হয়ে ওঠে হেফাজত। রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করে। ভারতের মুসলমানদের প্রতি অতি দরদ আর শ্রীলঙ্কা ও চীনের মুসলমানদের নিপীড়নের বিষয়ে নীরব থাকা, পাকিস্তান ও তাদের দোসরদের গণহত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে নির্বিকার থাকা তথা হঠাৎ সরব হওয়া আবার সুযোগ মতো নীরব থাকার নীতি হেফাজতের স্ববিরোধী অবস্থানের কথাই জানান দেয়।

ইসলাম হেফাজতের মিশন ঘোষণা করলেও ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ও মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে ভয়ংকর তাণ্ডব, অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, রাস্তা অবরোধ করে পথিকের হক নষ্ট করা হয়েছে, রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে, নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, হেফাজত কর্মীদের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া তথা অন্যায়ের প্রতিকার অন্যায়পথে করার পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে এসবই সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও হাদিস পরিপন্থী। এছাড়াও সংগঠনটির বিরুদ্ধে সরকারসমর্থক ও সরকারবিরোধী দুই অংশের কাছ থেকেই আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ওঠেছে। অতি সম্প্রতি হেফাজতের প্রধান নিরীক্ষক (অডিটর) মাওলানা সলিমউল্লাহ দাবি করেছেন, শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি ‘সফল’ করতে নানা উৎস থেকে টাকা নিয়েছিল সংগঠনটি।

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকাও সে সময় অন্তত ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, সেই অর্থসহ অন্তত এক কোটি টাকার হিসাব দিতে পারেননি হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। পুরো টাকাই তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে দৈনিক সমকালকে জানিয়েছেন সংগঠনটির প্রধান নিরীক্ষক (অডিটর) মাওলানা সলিমউল্লাহ। এদিকে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের নানা কর্ম-কাণ্ড নিয়েও বিতর্ক ওঠেছে।

ইসলামের খেদমত তথা ইসলাম নিয়ে গবেষণা ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে হেফাজতে ইসলামের সংস্কার জরুরি। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হেফাজতের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে না মর্মে সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন আবশ্যক। অরাজনৈতিক ইমেজ ফিরিয়ে আনতে হলে কাউকে ক্ষমতায় বসানো কিংবা কাউকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের লক্ষ্যে কারো পক্ষ হয়ে নয়, বরং কেবলমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর পক্ষে তথা ইসলামের পক্ষে কাজ করতে হবে হেফাজতে ইসলামকে। আর কেবলমাত্র ইসলাম হেফাজতের কাজে নিয়োজিত থাকলে হেফাজতের স্ববিরোধী অবস্থান তৈরি হবে না আশা করা যায়।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর