বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দুটি স্ট্যাটাস এবং আমাদের অন্ধত্ব

  •    
  • ৩ এপ্রিল, ২০২১ ১৭:৩৭

করোনা মোকাবিলায় জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। এটা মুসলমান-হিন্দু, আস্তিক-নাস্তিক, আওয়ামী লীগ-হেফাজত সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। করোনা কিন্তু ধর্ম চেনে না, দল চেনে না।

আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক অদ্ভুত জায়গা। মানুষ যে কী আচরণ করবে, বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশে সংসদে বিরোধী দল গৃহপালিত, রাজপথে বিরোধী দল নির্বাসিত। তাই বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই একমাত্র খোলা জানালা, জনগণের বিরোধী দল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছে। তারপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মানুষ মন খুলে কথা বলে। নিজের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা জানায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দ্রুত গড়ে ওঠে জনমত।

একবছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা গোটা বিশ্বকে কাবু করে রেখেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। গতবছর করোনা আসার পর বাংলাদেশ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি দিয়ে করোনা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিলও। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামি হয়ে ভাসিয়ে নিতে চাইছে সবকিছু।

গত সপ্তাহে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই নির্দেশনায় নতুন কিছু ছিল না। করোনা নিয়ন্ত্রণের মৌলিক স্বাস্থ্যবিধিগুলোই নতুন করে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা পালনে আমাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। বাধ্য হয়ে সরকার এখন এক সপ্তাহের লকডাউন দিয়েছে। এই লকডাউনটা আমরা ডেকে এনেছি। এখন দেখা যাক, লকডাউন কতটা কার্যকর হয় এবং সেই লকডাউন করোনাকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে আমার সংশয় অতীত অভিজ্ঞতার কারণে।

৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিটাও কিন্তু আমরা ঠিকমতো পালন করিনি। অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এখন সেই অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় কাজও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বলছিলাম, এবারের লকডাউনটা আমরা ডেকে এনেছি। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যারা আমাদের আচরণ দেখেছেন, তারা বুঝবেন, লকডাউন ছাড়া আসলেই আর কোনো উপায় ছিল না। শুক্রবার ছিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা। সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনায় পরীক্ষা না নেয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঠিকই পরীক্ষা নিয়েছে। তার মানে সরকারের সিদ্ধান্তই মানেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাও যদি শুধু পরীক্ষার্থীরা আসতেন, তাহলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। ভেতরে সন্তান পরীক্ষা দিচ্ছে, বাইরে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভিড়। কিন্তু সেই ভিড়ে করোনার পালানোর দশা। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। মানুষের অসচেতনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দুটি ছবি দিয়ে ফেসবুকে লিখি-

“এগুলো ফাইল ছবি নয়, আজকের তাজা ছবি। প্রতিদিন যখন সংক্রমণের রেকর্ড হচ্ছে, মৃত্যু বাড়ছে; সরকার যখন ১৮ দফায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, তখন এই ছবিটিকে কৌতুক মনে হতে পারে। আসলে এটি হলো সরকারের সমন্বয়হীনতার সাইনবোর্ড। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১৮ দফা ঘোষণা করে আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা নেয়! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যদি করোনার চেয়ে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে আর বলার কিছু নেই। করোনা সংক্রমণের নতুন নতুন রেকর্ড দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।”

এর দুই ঘণ্টা পর আরও বড় সমাবেশের ছবি পাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররমে হেফাজতের বিক্ষোভ সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ, সবার মাথায় টুপি কিন্তু কারো মুখে মাস্ক নেই। দুপুরের সমাবেশ নিয়েও সকালের মতোই স্ট্যাটাস দেই-

“আসলেই আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। সকালে ছিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা। আর এখন বায়তুল মোকাররমে চলছে হেফাজতের বিক্ষোভ। এসব ছবি দেখলে করোনা, ১৮ দফা, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব, মৃত্যু, সংক্রমণ- শব্দগুলোকে অবাস্তব লাগে।”

সকালের স্ট্যাটাসের কারণে কিন্তু কেউ আমাকে গালি দেয়নি। কিন্তু দুপুরে হেফাজতের সমাবেশ নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার পর ঝাঁপিয়ে পড়লেন হেফাজতিরা। সরকারের দালাল, ইসলামবিরোধী, নাস্তিক বিশেষণের পর বিশেষণে আমার স্ট্যাটাস রীতিমতো ভারাক্রান্ত। যারা গালি দিচ্ছেন তাদের হাজার যুক্তি, শত অজুহাত। আসলেই খলের কখনো ছলের অভাব হয় না।

সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ মিছিল করেছে, বরিশালে মানবভাস্কর্য বানিয়েছে, বইমেলায় ভিড়, বাসে ভিড়, স্টেডিয়ামে ভিড়; সেসব নিয়ে না লিখে আমি কেন হেফাজতের সমাবেশ নিয়ে লিখলাম সেটাতেই তাদের আপত্তি। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, হেফাজতের নেতাকর্মীদের করোনা হবে না বা তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার দরকার নেই। তবে হেফাজতিদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। অনেকেই মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রের ছবি দিয়ে বলছিলেন, আপনি এই ভিড় দেখেন না, খালি ইসলাম বিরোধিতা! আমি তাদের সমস্যাটা বুঝি। তারা অন্ধ। তারা শুধু একদিক দেখেন। একজন তো আরও বেশি অন্ধ। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে করোনার চেয়ে আপনার আপত্তিটা অন্য জায়গায় সেটা আমরা বুঝি। এমনও হতে পারে, এটাকে জায়েজ করার জন্য সকালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ছবিটা পোস্টাইছেন।’

অবশ্য এমন অন্ধ মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে অনেক। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি তো আছেই; কেউ ব্যক্তিপ্রেমে, কেউ দলপ্রেমে অন্ধ হয়ে যাই আমরা। তাই কোনো বিষয়ের একটা দিকই শুধু দেখি আমরা। আরেকটা দিক চোখেই পড়ে না। কিন্তু পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সব অনিয়মই আমাদের চোখে পড়ে। সব ধরনের

জনসমাগমই করোনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ- সেটা বইমেলা হোক, মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা হোক, হেফাজতের সমাবেশ হোক, আওয়ামী লীগের সমাবেশ হোক।

হেফাজতের সমাবেশের সমালোচনা করায় অনেকেই আমাকে ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম কথা হলো, আমি ইসলামের কোনো সমালোচনা করিনি। হেফাজতের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, হেফাজতের বিক্ষোভ সমাবেশের সঙ্গে তো নয়ই। হেফাজতের নিয়মতান্ত্রিক বিক্ষোভ করার ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি সব মানুষের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ করার সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু দেশে এখন জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিরাজমান।

করোনা মোকাবিলায় জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। এটা মুসলমান-হিন্দু, আস্তিক-নাস্তিক, আওয়ামী লীগ-হেফাজত সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। করোনা কিন্তু ধর্ম চেনে না, দল চেনে না। হেফাজতের নেতাকর্মীরা যাতে সুস্থ থাকেন, বিক্ষোভ করতে এসে যাতে করোনার ঝুঁকিতে না পড়েন; সে কারণেই আমার উদ্বেগ। আমি হেফাজতের নেতাকর্মী, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার্থী, তাদের স্বজন সবারই ভালো চাই, সুস্থতা চাই, নিরাপদ জীবন চাই।

আগেই বলেছি, নিজেদের খামখেয়ালিপনায় আমরা করোনাকে ছড়াতে দিয়েছি, নিজেদের উদাসীনতায় আমরা লকডাউন ডেকে এনেছি। এখন সবাই ঘরে থাকুন। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাবেন না। সরকারের প্রতি অনুরোধ, সাধারণ ছুটির মতো

লকডাউনও যেন ঢিলেঢালা না হয়।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর