প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে করোনায় দৈনিক সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা। সংখ্যাটিও চূড়ান্ত নয়। কারণ যারা সংক্রমিত, তাদের সবাই পরীক্ষার আওতায় আসছেন না। অনেকেই পরীক্ষা করাতে পারছেন না। আবার অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। অনেকে টেরও পাচ্ছেন না যে, শরীরে করোনাভাইরাস বহন করে চলেছেন। ব্যক্তিগত ইমিউনিটির কারণে তিনি নিজে হয়ত বেঁচে যাচ্ছেন, কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের সংস্পর্শে গিয়ে তাদের সংক্রমিত করছেন।
প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর। হাসপাতালের আইসিইউ তো দূরে থাক, সাধারণ বেডও খালি নেই। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলছেন, পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, চলে যাচ্ছে, নাকি গেছে? ট্র্যাডেজি হলো, যখন ৫৪ লাখের বেশি মানুষ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন এবং দ্বিতীয় ডোজ সমাগত, তখন এই ক্ষুদ্র অণুজীবের সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ সত্যিই সুনামির মতো পালটে দিচ্ছে আমাদের চিরচেনা দৃশ্যপট; গত কয়েক মাস ধরে যে দৃশ্যপটটি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছিল। মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। প্রথম দফায় করোনার টিকা চলে আসায় দেশের মানুষ যখন নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে আনন্দবোধ করছিল, তখন সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হচ্ছে।
কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হলো তার কারণও অজানা নয়। গত ২ এপ্রিল শুক্রবার, যেদিন ২৪ ঘণ্টায় আরও ছয় হাজার ৮৩০ জনকে শনাক্ত করা হয় নতুন করে অর্ধ শত মানুষের মৃত্যুর খবর দেয়া হয়, সেদিনই রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের সামনে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার একটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে— যে দৃশ্য দেখে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের মনে হবে, বাংলাদেশে করোনা বলে কিছু নেই। একই দিন জুমার নামাজের পরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশেও একই কাণ্ড ঘটেছে।
বাস্তবতা হলো পরীক্ষা বিবেচনায় এখন শনাক্তের হার প্রায় ২৪ শতাংশ— যা গত বছর, অর্থাৎ করোনার প্রথম ধাক্কার সময়েও দেখা যায়নি। মৃত্যুর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে চিকিৎসার সংকট। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করে করে বিনা চিকিৎসায় বা সময়মতো পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপোর্ট না পাওয়ায় সংক্রমিতদের করুণ মৃত্যু হচ্ছে।
ধারণা করা হয়েছিল বা মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, এরকম ভয়াবহ দৃশ্য দেখার দিন বোধ হয় সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু না। পরিস্থিতি এখন গত বছরের চেয়েও ভয়াবহ এবং এর পেছনে প্রধানত দায়ী মানুষের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, করোনাকে ভুলে যাওয়া বা পাত্তা না দেয়া এবং বেপরোয়া চলাফেরা। সেইসঙ্গে সরকারের সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তও এর জন্য বহুলাংশে দায়ী।
গত বছরের মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কয়েক দফায় খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে না আসায় সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে সকল কওমি মাদ্রাসা। কওমি মাদ্রাসাগুলো কেন খোলা, এখানে কি করোনা ছড়ায় না, নাকি এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি নির্দেশনার আওতামুক্ত— সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সবশেষ ২ এপ্রিলও করোনার ‘দোহাই দিয়ে’ কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ করা হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি মাওলানা জোনায়েদ আল হাবীব বিক্ষোভ সমাবেশে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সরকারের প্রজ্ঞাপনে কওমি মাদ্রাসা বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ এই করোনার দোহাই দিয়ে কওমি মাদ্রাসা বন্ধ ও ইসলামি সভা-সমাবেশ বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। যদি এবার করোনার দোহাই দিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করা হয় তবে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ বলাইবাহুল্য, এসব সমাবেশে শারীরিক দূরত্ব দূরে থাকুক, ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষারও সুযোগ থাকে না। এরকম জনসমাগম থেকেই করোনা দ্রুত ছড়ায়।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও দ্বিতীয় দফায় করোনার ঢেউয়ের পেছনে মানুষের এই বেপরোয়া আচরণ, বিশেষ করে বাইরে বের হলে মাস্ক না পরাকে দায়ী করেছেন।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র যেভাবে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে; যেভাবে মানুষ মাস্ক ছাড়া গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে; বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশ ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যেভাবে হাজার হাজার মানুষের সমাগম এমনকি ওপেন এয়ার কনসার্ট হয়েছে— তাতে মনে হয়েছিল, দেশ থেকে করোনাকে বিদায় জানানো হয়েছে। কিন্তু করোনা যে বিদায় নেয়নি, বরং সে যে ঘাপটি মেরে ছিল এবং সুযোগমতো নতুন করে আমাদের ধাওয়া দিচ্ছে, এটিই নির্মম বাস্তবতা। এখানে নানাবিধ সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্তের কারণে রাষ্ট্রও দায় এড়াতে পারে না।
জনসমাগম এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও এবং বাণিজ্য মেলা না করার সিদ্ধান্ত হলেও বইমেলা ঠিকই আয়োজন করা হলো। যদিও এবারের আয়োজন বেশ সুন্দর, গোছানো। পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে মেলা হওয়ায় সেখানে একসঙ্গে অনেক মানুষের মিলিত হওয়া সহজেই এড়ানো যায়। কিন্তু দেখা গেল, মার্চের শেষদিন মেলার সময়সীমা কমিয়ে দেয়া হলো। বিকাল তিন থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো, বিকাল ৩টার সময় কতজনের পক্ষে মেলায় যাওয়া সম্ভব? আবার কেউ যদি পাঁচটার পরে মেলায় প্রবেশ করেন, তিনি কী বই দেখবেন আর কী কিনবেন? রাত ৮ বা ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকলে করোনা বেশি ছড়াবে, আর সাড়ে ছয়টায় গেট বন্ধ করলে কম ছড়াবে— বিষয়টা কি এমন? বরং উলটো হওয়ার শঙ্কাই বেশি। কারণ অল্প সময় মেলা উন্মুক্ত থাকায় একসঙ্গে অনেক বেশি লোক মেলায় আসবেন এবং তাতে বরং স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা বেশি।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি-সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সংগত কারণেই এবার বইমেলায় মানুষের উপস্থিতি কম। কারণ এই মেলায় নিয়মিত দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের একটি বড় অংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর ভেতরে থাকা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক। ফলে এবার মেলায় এমনিতেই তুলনামূলকভাবে ভিড় কম। সেক্ষেত্রে যেহেতু মেলা শুরুই হয়েছিল, সেটিকে সময় কমিয়ে আনার কোনো যুক্তি নেই। বরং যদি করোনা সংক্রমণের কথাই বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে মেলাটি বন্ধ করে দেয়াই সংগত।
একদিকে জনসমাগম এড়াতে সরকারি ঘোষণা, অন্যদিকে ২ এপ্রিল মেডিক্যাল পরীক্ষায় নেয়ার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে হাজার হাজার মানুষের সমাগমের সুযোগ করে দেয়ার কোনো মানে নেই। করোনার এরকম ভয়াবহ ঊর্ধগতির সময়ে এই পরীক্ষাটি নেয়া খুব জরুরি ছিল কি না বা পরীক্ষাটা করোনার প্রকোপ একটু কমলে নেয়া যেত কি না— সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কার্যক্রম যেহেতু বন্ধ। একইরকম সাংঘর্ষিক ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি পিএসসির পরীক্ষার দিনেও। ওইদিনও বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রের আশপাশে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে।
গত ১ পৌষ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সাকরাইন উৎসবে হাজার হাজার মানুষে সমাগম হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো বালাই ছিল না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং রাজনীতিবিদরাই সেসব অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। অর্থাৎ গত কয়েক মাস ধরে সবকিছু এমনভাবে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিলো যে, দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এই দেশে করোনা বলে কিছু আছে বা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তার জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। আবার যখন এই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকল, তখনও তাৎক্ষণিক যেসব পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল, তাও নেয়া হয়নি।
অনেকেই মনে করেন, গত বছরের মতো লকডাউন দিতে হবে। কিন্তু লকডাউন বা কারফিউ স্টাইলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মনে রাখা দরকার, দেশের মানুষের একটি বড় অংশই দিনমজুর। ফলে এক দুই সপ্তাহ টানা লকডাউন হলে সেসব মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকিও বটে। কারণ রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে যে পরিমাণ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বজনপ্রীতি, তাতে সব মানুষ সরকারের খাদ্য সহায়তা পাবে না। সবার ঘরে সঠিক সময়ে খাবার পৌঁছে দেয়া যাবে না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামবেই। এটি একটি করুণ বাস্তবতা। আবার করোনা যেভাবে ধেই ধেই করে আসছে—তাতে টানা দুই সপ্তাহ সিরিয়াস লকডাউন না দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে কি না— সে শঙ্কাও এড়িয়ে দেয়া যায় না।
করোনাভাইরাস এসে প্রথম দফাতেই যেমন আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার সব জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে; আমাদের সকল উন্নয়নের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে— এবার দ্বিতীয় দফার ঢেউ সামলাতে না পারলে বা নানাবিধ বৈপরিত্য মোকাবিলা করে সত্যিই একটি জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে না পারলে হাসপাতালের আরও অসংখ্য সিট খালি হয়ে যাবে—মানুষের করুণ মৃত্যুর কারণে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেসব সিটে নতুন কেউ গিয়ে ভর্তি হবেন।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, এরকম পরিস্থিতি রাষ্ট্র বা সরকারের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মানুষ যদি এখনও বেপরোয়া আচরণ করতে থাকে, মানুষ যদি হাতের নাগালে থাকা অতি সস্তার মাস্ক না পরে বা পরতে বাধ্য না হয়; যদি সব ধরনের জনসমাগম সত্যিই বন্ধ করা না যায়; যদি গণপরিবহনে সত্যিই স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব মানা না হয়; যদি পাঁচটি বন্ধ আর দশটি খোলার খেলা চলতে থাকে— তাহলে আমাদের কেবল প্রতিদিন সংক্রমণের রেকর্ড ভাঙা এবং মৃত্যুর সংখ্যা গোণা ছাড়া উপায় থাকবে না এবং একদিন আমরাও সেই সংখ্যা হয়ে যাব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।