যে বছর পড়াশোনা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে গেলাম, সে বছরই, অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ ১১ বছর বয়সী রুশ শিশু কাতিয়া লিচিওভা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। দেখা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে। এটা ছিল ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে আমেরিকান শিশু সামান্থা স্মিথের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের প্রত্যুত্তরে রুশদের জবাব। সামান্থা চিঠি লিখেছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি ইউরি আন্দ্রোপভকে। আন্দ্রোপভ সামান্থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এটা হচ্ছে সে-ই সময়টা, যখন হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আমাদের দেশে তার শাসন–শোষণ পোক্ত করে নিচ্ছিলেন। ১৯৮৩ সালে শিক্ষা ভবনের সামনে গুলি চালিয়েছিল এরশাদের পুলিশ। তাতে সেলিম, দেলোয়ার, দিপালী সাহারা শহিদ হয়েছিলেন।
আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছেছিলাম ২ সেপ্টেম্বর। তার বহু আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে এসেছিল কাতিয়া। আজ হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো, কেমন আছে মেয়েটা? বেঁচে আছে তো? কী করছে এখন? যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল, সে উদ্দেশ্য যদিও পূরণ হয়নি, তারপরও সে তো হৃদয় থেকেই চেয়েছিল, রাশিয়া আর আমেরিকা তাদের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো ধ্বংস করে ফেলুক। বিশ্বের শিশুদের মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর হোক।
সে বছর মার্চেই কাতিয়া সারা বিশ্বে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিল।
সে সময় যারা এই পৃথিবীতে বসবাস করেছে, তাদের মনে করিয়ে দেয়ার দরকার নেই যে, দুই পরাশক্তির ঠাণ্ডাযুদ্ধের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবী। এই ঠাণ্ডা যুদ্ধ কীভাবে দেখছে শিশুরা—এটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সামান্থা সোভিয়েত ইউনিয়নে এল যখন, তখন দুই দেশের সম্পর্কের বরফ একটু হলেও গলেছিল।
কাতিয়াকে বেছে নেয়া হয়েছিল ৬ হাজার শিশুর মধ্য থেকে। কাতিয়া খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারত, ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভালো ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যা ছিল কম। তাদের মধ্যে পারিবারিক কারণে কাতিয়ার অবস্থান ছিল ভালো। কাতিয়ার পরিবার চার পুরুষ ধরে ক্ষমতার কাছাকাছি বসবাস করেছে। কাতিয়ার বড়দাদি (দাদির মা) মারিয়া দ্মিত্রিয়েভনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘সোভিয়েত নারী’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে তো যাবে, কিন্তু তার তো জানা থাকতে হবে সব উত্তর, যেন অস্বস্তিতে না পড়তে হয়। যেমন, দোকানে পণ্যঘাটতির ওপর যদি কেউ প্রশ্ন করে, তাহলে কীভাবে সে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হবে, সেটাও তাকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। পিচ্ছিল প্রশ্নগুলোয় যেন পা না হড়কে, তার ওপর প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল ওকে।
২১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে সেখানে কাতিয়া ছিল ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। ওর সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে ছিল মার্কিন এক শিশু—স্টার রৌ ছিল ওর নাম। ওরা দুজন মিলে ঘুরে বেড়িয়েছিল সানফ্রান্সিসকো, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন। ঘুরে বেড়িয়েছিল জাতিসংঘের সদর দপ্তর, নাসা, ডিজনিল্যান্ড। কথা বলেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে। পরে কাতিয়া লিখেছিল-
‘আমার দিকে এগিয়ে এলেন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান, করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলেন হাত এবং বললেন, হোয়াইট হাউসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। আমি তাকে খেলনা উপহার দিলাম। বললাম, সোভিয়েত শ্রমিকরা এই খেলনা বানিয়েছে। এরপর আমি তাকে বললাম, ‘আমার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শিশুরা শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। যতদিন পর্যন্ত আপনাদের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকবে, ততদিন শিশুরা আরামে ঘুমাতে পারবে না। আমি জানি, আমাদের দেশ আপনাদের কাছে সব পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই পৃথিবীতে আর কোনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে না। আমরা সারা পৃথিবীর শিশুরা তখন খুব খুশি হব।’ রিগ্যান বললেন, তিনি শিশু না হলেও শিশুরা যেভাবে ভাবছে, তিনিও ঠিক সে রকম শান্তির কথাই ভাবেন। তিনি আমাকে কথা দিলেন যে, এই পৃথিবীতে যেন পারমাণবিক অস্ত্র না থাকে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।’
এরপর কাতিয়া মার্কিন দেশ ভ্রমণের আরও অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। ম্যাকডোনাল্ডের বিগম্যাক খাওয়া থেকে শুরু করে সার্কাস দেখার নানা কাহিনি আছে। তবে, যে ব্যাপারটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে বিস্মিত করেছে, সেটাই বলি।
হোটেল কক্ষেই ওরা সিনেমা দেখল রকি–৪। কাতিয়া বিস্মিত হয়ে দেখল, সেখানে একজন রুশ মুষ্টিযোদ্ধাকে একেবারে অমানবিকভাবে দেখানো হয়েছে। ছোট্ট কাতিয়ার মনে তা রেখাপাত করল। ওর খুব খারাপ লাগল। রাশিয়ার কোনো মানুষ এ রকম অমানবিক নয়। টেলিরিপোর্টারদের প্রশ্নের জবাবে সেই মুষ্টিযোদ্ধা বলেন, ‘ও মরে গেলে মরে যাবে।’ কাতিয়ার মনে প্রশ্ন আসে, রুশ নাগরিকেরা কি এতটা হৃদয়হীন?
পরদিন টেলিভিশনে যখন কাতিয়া সাক্ষাৎকার দিচ্ছিল, তখন বলেছিল, আমার দেশ নিয়ে এই সিনেমায় যা বলা হয়েছে, তাতে একফোঁটাও সত্য নেই। যেমন চেহারার রুশ মুষ্টিযোদ্ধাকে এই ছবিতে দেখানো হয়েছে, সে রকম চেহারার কেউ আমাদের দেশে নেই। সেইসব বয়স্ক মানুষদের কথা ভেবে আমার লজ্জা হয়, যারা এই ছবিটি তৈরি করেছেন।’
কাতিয়ার বয়স তখন মাত্র এগারো। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল, সেটা তার এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়। বড়রা সুযোগ পেলেই যে অন্য দেশকে হেয় করে, সেটা ও বুঝেছিল সহজেই।
এই কথাটা বোঝা দরকার যে, প্রতিটি দেশই তার নিজের মতো করে ইতিহাস রচনা করে। ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীর চোখে। বিজয়ের কথা বলতে গিয়ে শুধু গর্বের কথাই সবাই বর্ণনা করতে চায়। কিন্তু সেই বিজয়ের মধ্যেও যে কত ধরনের যন্ত্রণা, কষ্ট, দুঃখ আছে, তার খতিয়ান কেউ দিতে চায় না।
দেশপ্রেম খুবই প্রয়োজনীয় একটি ব্যাপার। গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক আমরা, এটা মেনে নিলেও এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে আমরা আমাদের ভাবনাকে জারিয়ে নিয়ে অন্য দেশের কথা ভাবি। তথ্য–প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর যেখানেই যা ঘটুক না কেন, সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা জেনে যাই। তাই আমাদের এই সময়ে দেশপ্রেম নিয়ে ভাববার অবকাশ একটু কম। তাছাড়া জাতীয়বাদের প্রশ্নটি সেই কবে মার্কসই তো একটু আলুলায়িত করে দিয়ে গেছেন। জাতীয়তাবাদ একটি জাতির চলার পথের কোনো এক সময় খুব প্রয়োজনীয় প্রশ্ন হলেও সবসময় একই রকমভাবে তা ক্রিয়াপাত করে না। কোনো কোনো সময় জাতীয়তাবাদকে উদার হতে হয়।
আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন গত শতাব্দির চল্লিশ থেকে সত্তরের দশক ছিল জাতীয়তাবাদের উত্থানে ভাস্বর, পরবর্তীকালে সেটা ঠিক সেভাবে আর সমুন্নত থাকেনি। অন্যান্য প্রশ্ন এসে ভাববার বিষয়গুলোর অগ্রাধিকারও পরিবর্তন করে দিয়েছে। বর্তমানে মোল্লাবাদের যে বিস্তার ঘটছে, তা–ও জাতির দর্শন ও চেতনাগত জায়গায় ফাটল ধরার প্রমাণমাত্র।
কিন্তু দেশপ্রেম হারিয়ে যাবে, দেশ–বিষয়ক ভাবনা মানুষকে দোলা দেবে না— এ রকম কোনো সন্দেহ এখনও কারো মনে জায়গা করে নেয়নি। এখনও রাষ্ট্রগুলো আটসাঁটভাবেই বিরাজমান এবং রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে থেকেই অসীমের সন্ধান করছে। অর্থাৎ নিজেদের পণ্য অন্যের দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার সুযোগ একেবারেই ছাড়ছে না। ফলে, বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের পক্ষে থাকলেও রাষ্ট্রের সীমা উঠিয়ে দেয়ার কথা এখন পর্যন্ত কোনো দেশ ভাবছে না। খুব কাছাকাছি সময়ে জার্মানির একত্রীকরণ আমরা দেখেছি। কিন্তু চেকোস্লাভিয়া, যুগোস্লাভিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনই কিন্তু আমাদের দেখতে হয়েছে। জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।
ইতিহাসের এই দিকগুলো বিবেচনা করলে বলতে হয়, যারাই দেশের জন্য গর্ব করতে পারে, তারাই বড় হতে পারে। কিন্তু সে সময় মনে রাখতে হবে, অন্য দেশগুলোকেও সে সমান ভালোবাসতে পারছে কি না। বলা হয়ে থাকে, যে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারে, সে অন্যকেও ততটা ভালোবাসতে পারে। নিজেকে যে ভালোবাসে না, সে অন্যের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। সে কথা মনে রাখলে বলা যায়, কাতিয়া সরাসরি নিজের দেশের নাগরিকদের নিয়ে মিথ্যাচার হতে দেখে যেভাবে প্রতিবাদ করেছে, সেভাবেই প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষের প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু যদি নিজদেশই অন্যায় করে, সে কথাও সোজা দাঁড়িয়ে বলা কি সম্ভব?
সবসময় যে সম্ভব নয়, সেটা তো আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।
শেষ কথা: কাতিয়ার কথা দিয়েই শেষ করি। দেশে ফিরে মেয়েটা তো চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়ে গেল। টেলিভিশনে দেখা যেতে লাগল ওকে। কোথায় না যাচ্ছে মেয়েটা! কিন্তু তারপর দুবছরের মাথায় ও যেন হারিয়ে গেল মিডিয়া থেকে। কেউ আর ওর কোনো খোঁজ পায় না।
কী হয়েছিল কাতিয়ার?
বাবা–মার সঙ্গে কাতিয়া পাড়ি জমিয়েছিল ফ্রান্সে। প্যারিসে করছিল বসবাস। মা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর দেয়া স্কলারশিপে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। অর্থনীতি আর আন্তর্জাতিক আইনে ছিল তার দক্ষতা। সপরিবাবের ফ্রান্সে থেকে পড়াশোনা করা যাবে জেনে তারা চলে এসেছিলেন।
কাতিয়া এরপর পড়াশোনা করেছেন সরবোর্নে। অর্থনীতি আর আইন নিয়ে পড়েছেন। প্যারিসে চাকরি করেছেন। ২০০০ সালে ফিরে এসেছেন রাশিয়ায়। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। তাকে এখন আর কেউ কাতিয়া বলে না। বলে ইয়েকাতেরিনা আলেক্সান্দ্রোভনা। সাধারণত তিনি এখন মিডিয়ার মুখোমুখি হন না। কিন্তু একবার যখন কোনো টেলিসাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওভাবে শান্তির বাণী নিয়ে আমেরিকায় যাওয়ার কি কোনো দরকার ছিল?’
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অবশ্যই দরকার ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করার একটা দায়িত্ব ছিল, বলা দরকার ছিল, আমাদের দেশ শান্তি চায়। আমি, একজন রুশ ছাত্রী, কাতিয়া লিচিয়েভা, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
লেখক: গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।