বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পশ্চিমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি

  •    
  • ২ এপ্রিল, ২০২১ ২০:৫৪

বদলাতে হবে ইউরোপীয় সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশসহ গোটা এশিয়া সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তাদের ৫০ বছর আগের চিন্তাচেতনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

ইউরোপ ও আমেরিকার সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে এ মুহূর্তে ঠিক এশিয়ার উন্নয়নকে বুঝতে ভুল করছেন। কারণ, এ ধরনের জনঘনত্বপূর্ণ এলাকার উন্নয়ন সম্পর্কে তাদের কোনো সম্যক ধারণা নেই। তাছাড়া জনঘনত্বপূর্ণ দেশ এবং যেখানে কেবল প্রথম জেনারেশন শিক্ষিত হচ্ছে সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা যে ঠিক ইউরোপের মত হতে পারে না, এটাও তারা বুঝতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, তারা আরও একটি বিষয় ভুল করছেন, তারা কখনই মাথায় নিচ্ছেন না, একটি জাতিগোষ্ঠীর বা নৃগোষ্ঠীর চরিত্র অনুযায়ী সে দেশের শাসন ব্যবস্থা চালাতে হয়। আর সে পথেই উন্নয়ন করতে হয়। থাইল্যান্ডের কোনো ক্যাব চালককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার ক্যাবে রাজার ছবি কেন, সে যা উত্তর দেয় তা হলো, রাজা তার কাছে নেক্সট টু গড। তাই থাইল্যান্ডের যেকোনো ধরনের শাসন রাজাকে মাইনাস করে নয়। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার নৃগোষ্ঠী অনেক বেশি আরগুমেনটেটিভ অন্য দিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নৃগোষ্ঠী অনেক বেশি রেজিমেন্টাল। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম একভাবে কাজ করে সমাজে ও রাষ্ট্রে, আর দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় ভিন্নভাবে, যার কোনো কিছুর সঙ্গে পশ্চিমাদের মিল নেই।

অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে গত ৭৫ বছরে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ ইউরোপীয় বিশেষ করে ব্রিটেনের সরাসরি কলোনি ছিল। যারা সরাসরি কলোনি ছিল না, তারাও এক ধরনের মানসিক কলোনি ছিল। ৭৫ বছর সেই কলোনি থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর নাগরিকের ও রাষ্ট্র পরিচালকদের চরিত্রও বদলে গেছে। এমনকি গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যারা এই রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের কারো জীবনে ইউরোপীয় কলোনির কোনো ছাপ নেই। এমনকি ইউরোপ যে প্রতি মুহূর্তে অর্থনৈতিক ও সামজিক উন্নয়নের গতিতে নিম্মমুখী হচ্ছে, সেটাও তারা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে।

গত প্রায় দেড় দশকে আর যে বিষয়টি ঘটেছে, তা হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এখন আর শুধু ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে তাদের সব উন্নয়ন ও সব যোগাযোগের বন্ধন নিয়ে বসে নেই। পূর্ব এশীয় দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে যোগাযোগ। এরা পরস্পরে অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক নানান ক্ষেত্রে তাদের যোগাযোগকে দৃঢ় করছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছেলেমেয়েরা এখন আর শুধু ইংরেজি শিক্ষাকে তাদের ভবিষ্যতের জন্যে একটি নিশ্চয়তা মনে করছে না। তারা ম্যান্ডারিন, হিন্দি ও জাপানি শেখাও তাদের ভবিষ্যতের একটি নিশ্চয়তা মনে করছে। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নানান দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার কাছে এসে গেছে।

ইউরোপীয় সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মাথায় এ মুহূর্তে এ বিষয়গুলো নেই। তারা ভাবতে পারে না বাংলাদেশের একটি ছেলে বা মেয়ে ইউরোপ ঘুরে এসে বুঝতে পারে ইউরোপ নিম্মগতির দিকে। তাকে ভবিষ্যত খুঁজতে হবে এশিয়ায়। প্রয়োজনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব এশিয়ায় তাকে যেতে হবে। এমনকি সে নতুন অনুসন্ধানের জায়গা মনে করে আফ্রিকাকে। বাস্তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই সামগ্রিক পরিবর্তন মাথায় রেখে ইউরোপ বা আমেরিকার সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা এশিয়ার কোনো দেশ বা তার উন্নয়নকে বিশ্লেষণ করতে পারে না।

যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে ব্রিটেনের পুরানো দিনের পত্রিকা ইকোনমিস্ট একটি বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে তারা বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে মূল ভূমিকা দেখিয়েছে কিছু এনজিওর। কারণ, এই এনজিওগুলো শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৫০ এবং ৪০ বছর আগে। তখনকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ইউরোপীয় ডোনারদের টাকায় চলা এই এনজিওগুলো ওই অর্থে বাংলাদেশে কোনো দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। তারা নারী ক্ষমতায়নের একটা সূচনা করেছিল এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ক্ষুদ্র ঋণের চক্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বাস্তবে যাকে দারিদ্র্য দূরীকরণ বলে, সেটা কিছুমাত্র হয়নি তাতে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে দ্রুত জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার উৎখাত হওয়ায় এই এনজিওগুলো এক ধরনের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারে পশ্চিমা দুনিয়ায়। এবং তাদের স্লাইড শো দেখে ইউরোপীয়রা মনে করে, ওরাই মনে হয় বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করছে।

বাস্তবে বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ দুটোই ঘটেছে ৯০ এর পরে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। এবং সেটা পশ্চিমাদের অর্থের ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব কর্মসূচিতে। এমনকি যে খালেদা জিয়ার শাসনামল মৌলবাদে আকীর্ণ, তার সময়েও নারী শিক্ষা বেড়েছে। আর শেখ হাসিনার একের পর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়ার ফলে নারী শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়ন যেটা বলে সেটাই বাংলাদেশে ঘটেছে। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশে এই নারী ক্ষমতায়নের পাশাপাশি মৌলবাদও বাড়ছে। এই মৌলবাদ কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকাতেও বাড়ছে। এখানে ইসলামিক মৌলবাদ, সেখানে ক্রিশ্চিয়ানিটির মৌলবাদ। শাদা-কালো বর্ণবাদের মৌলবাদ। পার্থক্য শুধু এটুকু। তবে বাংলাদেশের জন্যে যে ভবিষ্যদ্বাণী এখনই করা যায়, তা হলো, এই যে নারী ক্ষমতায়ন রাজনৈতিক শাসনের কারণে সৃষ্ট, এই ক্ষমতায়নকৃত নারীরাই কিন্তু বাস্তবে এ দেশ থেকে মৌলবাদকে উচ্ছেদ করবে। ইউরোপে কে করবে তার কোনো পূর্বাভাস এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, ইকোনমিস্ট দোষ দিচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থাকে। এমনকি তারা বাংলাদেশকে নব্বই দশকের আগের বাংলাদেশ মনে করে কোনোরূপ কোনো সাংবাদিকতার নীতি না মেনে আল-জাজিরার একটি কল্পকাহিনীভিত্তিক রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এও বলছে ,বাংলাদেশে সামরিক শাসন আসতে পারে। এটাও তাদের অজ্ঞতা ও অতীতের মানসিকতা। তারা বর্তমান বাংলাদেশকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, বর্তমানের বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে আর পাকিস্তানে ট্রেনিং নেয়া সেই সৈনিকরা নেই। এরা সকলেই বাংলাদেশি। এবং তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে তাদের যে বিশ্লেষণ, তাও কিন্তু এশিয়ার গণতন্ত্রের ধারা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে খুবই সোজা দাগে দেখা। তারা মনে করে, বাংলাদেশে যতগুলো দল রাজনৈতিক দল হিসেবে আছে, সকলেই সত্যি অর্থে রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় দল সামরিক সরকার থেকে উৎসারিত। এবং এগুলো নিঃশেষিত না হওয়া অবধি বাংলাদেশে প্রকৃত রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসবে না। আর সেই রাজনৈতিক পরিবেশ ফেরাতে এগুলো নিঃশেষিত হবার দিকে ঠেলে দেয়া দরকার। এই বাস্তবতার গভীরে তারা না গিয়ে তাদের ইউরোপীয় পরিবেশে বসে ঢালাও মন্তব্য করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে।

বাস্তবে ইউরোপ ও আমেরিকা সত্যি অর্থে গোটা এশিয়াকে চিনতে ভুল করছে। যেমন: আমেরিকা খুবই চাপ দিচ্ছে জাপানকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে চায়নার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চায়না ও জাপান পরস্পরকে অস্বীকার করে এ মুহূর্তে চলতে পারবে না। তাই জাপানের সঙ্গে আমেরিকার সখ্যতার রীতি-নীতি এখন বদলাতে হবে। তেমনি বদলাতে হবে ইউরোপীয় সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশসহ গোটা এশিয়া সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা। তাদের ৫০ বছর আগের চিন্তাচেতনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে, গত দুই দশকে যে পরিবর্তন হয়েছে এ এলাকায়- তা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, বারবার কোনো দেশ সম্পর্কে এ ধরনের ভুল বিশ্লেষণ এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রাইমও।

এ বিভাগের আরো খবর