পরিবহনের এ আধুনিক ও ডিজিটাল যুগে সেকেলে হয়ে উঠেছে ট্রেনের সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হুইসেল।
সাম্প্রতিক স্মার্টফোনসহ এমপি-থ্রি প্লেয়ার এবং ট্যাবের মতো বিভিন্ন ধরনের পোর্টেবল গ্যাজেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেককে দেখা যায়, কানে এয়ারফোন লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল-ক্রসিং পার হচ্ছেন। এ সময় অসচেতনভাবে তারা প্রাণহানির ঝুঁকির বিষয়টিও ভুলে যান।
প্রতিবেশী ভারতে ট্রেনে কাটা পড়ে ২০১৫-২০১৭ এই তিন বছরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী রাজেন গোঁহাই ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই লোকসভায় এ তথ্য দেন। এ খবর প্রকাশ করে হিন্দুস্তান টাইমস। গত বছর দেশটির রেলপথ ব্যবস্থাপনায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী (আরপিএফ) ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় রেলওয়ে আইনের ১৪৭ ধারা অনুযায়ী তাদের ৪ কোটি ৭০ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়।
অপরদিকে উন্নত বিশ্বের দেশ কানাডার রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেদেশে প্রতিবছর রেলে কাটা পড়ে ১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ট্রেনের নিচে প্রাণ যায় কমপক্ষে ৫০০ মানুষের।
গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) বাংলাদেশ জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর রেলে কাটা পড়ে ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের তথ্য মতে, উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের অন্তত ৪০০ জনের কানে হেডফোন লাগানো ছিল।
ফিলিপাইন, পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশেও রেলে কাটা পড়ে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।=
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। কিন্তু গত তিন শতকে ট্রেনের সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় আধুনিকতার কি কোনো ছোঁয়া লেগেছে?
উত্তরটা ধরে নেয়া যেতে পারে ‘না’।
দুঃখজনকভাবে, লোকোমোটিভ মাস্টারকে একমাত্র সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হুইসেল বাজানোর ওপরই নির্ভর করতে হয়। স্রেফ অন্যমনস্কতার কারণে সারা বছর যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন, সেসব মর্মান্তিক মৃত্যুর অসহায় সাক্ষী হয়ে থাকতে হয় মাস্টারদের।
হুইসেল কেন কার্যকারিতা হারাচ্ছে?
প্রযুক্তিবিষয়ক ম্যাগাজিন টেকজুরি জানায়, বিশ্বে ২০১৮ সালে ফ্রি ইয়ারফোনসহ ১৫৬ কোটি স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে। এসব স্মার্টফোনের বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই হচ্ছেন তরুণ-তরুণী। যারা এসব আধুনিক ফোনের মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তি ব্যবহারে মরিয়া। বাসা থেকে বের হলেই তাদের কানে এয়ারবাড ঢুকিয়ে রাখার বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়।
জীবনযাত্রায় এই ধরনের পরিবর্তনের ছোঁয়া রাস্তায় তাদের জন্য বয়ে আনে ভয়াবহ বিপদ। এদের কেউ কেউ লেভেল-ক্রসিং পার হওয়ার সময় দ্রুতগতির ট্রেনের নিচে অনেক সময় কাটা পড়েন।
অন্যদিকে, রেললাইনের পাশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভারী যন্ত্রের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এমন সব ভারী যন্ত্র থেকে উচ্চমাত্রার শব্দ বের হয়। ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, স’মিল, পাইলিং মেশিন, পাথর ভাঙার মেশিন, এমনকি যানবাহন পরিবহনে ব্যবহৃত ফেরির উচ্চমাত্রার শব্দ ট্রেনের হুইসেলকেও ম্লান করে দেয়। এতে অনেক সময় হুইসেলের শব্দ পথচারীর কানে পৌঁছায় না। এমনিভাবে কার্যকারিতা হারায় হুইসেল, আর ঘটে যায় ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা।
এ ছাড়া, রেলপথের পাশে জনসভা, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে লাউড স্পিকারের ব্যবহার কয়েক দশকে বেড়েছে অনেক বেশি। এর আগে এই ধরনের কানের পর্দা ফাটানো শব্দের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। তাতে করে দ্রুতগতির ট্রেনের হুইসেলের শব্দ অনেক দূর থেকে মানুষকে সতর্ক করতে পারত। তখন উচ্চশব্দের মাইকের এমন ব্যাপক পরিসরে ব্যবহারের প্রচলনও ছিল না। তাই দ্রুতগতির ট্রেনের হুইসেলটি লোকেরা সহজেই শুনতে পেতেন।
এখন রেললাইনের পাশে আয়োজিত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান-সমাবেশ থেকে সৃষ্ট উচ্চ শব্দের কারণে মানুষ ট্রেনের হুইসেল তেমন একটা শুনতে পাচ্ছে না। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলেন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের বাসিন্দারা। রাজ্যের অমৃতসরে দশেরার অনুষ্ঠানে রাবণের কুশপুত্তলিকায় আগুন দেয়ার সময় দুটি চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রাণ হারান অন্তত ৬২ জন। গুরুতর আহত হন আরও শতাধিক।
সাউন্ডপ্রুফ (শব্দনিরোধী) গাড়ি ও কোয়াটেস্ট (শব্দহীন) এসইউভি চালিয়ে লেভেল-ক্রসিং পার হওয়ার সময় চালক ও যাত্রীরা হুইসেল না-ও শুনতে পারেন। এ কারণে তারা অপ্রত্যাশিত ও ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন।
তা ছাড়া সেকেলে হুইসেল বধিরদের সতর্ক করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
রেলপথে হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার পাশাপাশি ট্রেনের গতি ও সংখ্যা বাড়াতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আধুনিকায়নে নেয়া হচ্ছে হাজারও ব্যবস্থা। সারা বিশ্বে কয়েক শতক ধরে সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য এবং রেললাইনে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে। তবে এত কিছুর পরও সেকেলে হুইসেলের ওপর একক নির্ভরতা এখনও রয়ে গেছে।
সেকেলে হুইসেলের বিকল্প কী হতে পারে?
রেলপথে অসতর্ক ব্যক্তিকে সতর্ক করতে, চলন্ত ট্রেনের লোকোমাস্টাররা হুইসেল বাজানোর পাশাপাশি বিকল্প উপায় হিসেবে লেজার লাইট ও দূরপাল্লার বৈদ্যুতিক শক গান (লং রেঞ্জের ইলেকট্রিক শক গান) ব্যবহার করতে পারেন। জরুরি ও আপৎকালীন অবস্থায় সতর্ক করার জন্য জলকামান (ওয়াটার ক্যানন), এয়ার ব্লোয়ার অথবা এয়ার কমপ্রেসর ব্যবহার করতে পারেন।
আপৎকালে ট্রেনের হুইসেল বাজানো আর ব্রেক কষা ছাড়া তেমন কিছুই করার থাকে না লোকোমাস্টারের। তবে জরুরি ব্রেক কষলেও ট্রেন থামতে দুই কিলোমিটারের মতো দীর্ঘ পথ লাগে। এমনটি নিশ্চিত করেছে কানাডার অন্টারিওর পরিবহনবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ট্রেন থামানোর এ জরুরি চেষ্টার সময় চালকদের হুইসেল বাজানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
আমরা যদি রেলপথে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে চাই, তবে লোকোমোটিভে সুরক্ষাব্যবস্থা আরও আধুনিক করতে হবে।
একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে প্রতিটি লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের সামনে ‘সেফগার্ড’ সংযোজন (ইনস্টল) করা। চার ফুট পুরুত্বের সম্পূর্ণ রাবারের তৈরি সেফগার্ড প্রতিটি ইঞ্জিনের সামনে সংযোজন করে এর ধ্বংসাত্মক শক্তিকে কমিয়ে আনতে হবে। সেফগার্ডের প্রস্থ ও উচ্চতা হতে পারে ছয় ফিট (৭২ ইঞ্চি) করে।
সেফগার্ডটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি হওয়ার কারণে ট্রেনের সঙ্গে যানবাহন, মানুষ ও বন্য প্রাণী ধাক্কা খেলে রেললাইনের যেকোনো এক পাশে ছিটকে পড়বে। এতে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা অনেকটা কমবে।
একই সময়ে, যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেউ ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন, তবে এই ডিভাইসটি ও এয়ার ব্লোয়ার ওই ব্যক্তিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তার অপচেষ্টাকেও রুখে দেবে।
একটি প্রাথমিক অনুমান অনুসারে বলা যেতে পারে, প্রতিটি ইঞ্জিনে এ ধরনের সংস্কারমূলক সুরক্ষাব্যবস্থা সংযোজনের জন্য ৫ লাখ টাকা ( প্রায় ছয় হাজার ডলার) খরচ হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. শিফুন নেওয়াজ এক আলাপচারিতায় বলেছেন, এমন প্রস্তাবিত বিকল্প সতর্কতামূলক সুরক্ষাব্যবস্থা ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু কমিয়ে আনতে কার্যকর হতে পারে।
লোকোমোটিভের সামনে প্রস্তাবিত এমন রাবারের ব্লক দ্রুতগামী ট্রেনের সঙ্গে যানবাহন, এমনকি অন্য একটি ট্রেনের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে প্রতিরোধক (কুশন) হিসেবে কাজ করতে পারে, জানিয়েছেন পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এ সহকারী অধ্যাপক।
লেখক: সাংবাদিক