মহামারি করোনার কারণে এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে এবারের বাংলা একাডেমির বইমেলা ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মধ্য মার্চের পরে শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে, কিছু না পাওয়ার বেদনা মনকে আহত করে।
সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে শেষদিক থেকে নিজেদের বইমেলার স্টল বানানো থেকে শুরু করে স্টল ভাঙা পর্যন্ত আমার উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে আছে। বলতে গেলে প্রায় ত্রিশ বছর। এই প্রায় তিন দশকে দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা একাডেমির বইমেলার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়নি। সে কথায় পরে আসছি।
এবারের বইমেলার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। হবে না, হবে না- এমন অবস্থায় শুরু হয়েছে। তারপরও আশঙ্কা সবার মনে কখন জানি বন্ধ হয়ে যায় প্রাণের বইমেলা। এমনিতেই লোকসানের মুখে পড়তে হবে প্রকাশকদের। তারপরও যদি মেলা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে লোকসানের পরিধিটা আরেকটু বাড়বে। প্রতিবারই স্টল তৈরির সময় বিভিন্ন মিডিয়ার মানুষ মতামত জানতে চায়, কী আশা করি আমরা? কিন্তু এবার প্রায় সকলেরই প্রশ্ন- বিক্রি কেমন হবে বলে আশা করছেন? ক্রেতা আসবে? কেমন আশা করছেন ইত্যাদি।
আমি যে ধরনের বই নিয়ে মেলায় বসি, সেখানে লাভের আশা করাটা অযৌক্তিক। কোনো রকম খরচ উঠলেই হয়। তাও গত ২/৩ বছর ঘাটতিতেই থাকতে হচ্ছে। তারপরও প্রশ্নের জবাব দেয়াটা উচিত। জবাবে বলি, ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে এটা ধরে নেয়া যায়। কিন্তু লাভ হবে একটাই- যে কজন মেলায় এসে বইয়ের আড়ং দেখবে, তার মনের মধ্যে কেনার একটা ইচ্ছা জাগবে, হয়ত পকেট হালকার কারণে কিনতে পারবেন না। তারপরও কেনার বাসনা মনের মধ্যে লালন করবে। ‘যদি ভাগ্যে হয়’।
এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী। মুজিববর্ষ। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা। এই উপলক্ষে বাংলা একাডেমি এমন কোনো কাজ কি করেছে যাকে এই সময়টাকে ফ্রেমে বাঁধা যায়? আমারতো মনে হয় না। না, এমন কিছুই হয়নি যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মনে করবে যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালি জাতি ঘটা করেই পালন করেছিল। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কী করা যেত? অনেক কিছুই করা যেত। যেমন, দেশের প্রতিটি উপজেলায় না হোক জেলাতে বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র খোলা যেত। যেমন আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিক্রয়কেন্দ্র, আছে শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির স্থাপনা। বাংলা একাডেমির ক্ষমতায় না কুলালে একই মন্ত্রণালয়ের আওতায় আছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তাদের সহায়তায় সেটা করা সম্ভব ছিল। তাতে দেশের মানুষ বেশ কিছুটা উপকৃত হতো। বই কেনার আগ্রহটা বাড়ত, জ্ঞানের পরিধিটা বাড়ত।
আমরা যদি পাশের দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকীতে তারা দেশের বিভিন্ন জেলাতে সরকারিভাবে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করেছে। যা ‘রবীন্দ্র সদন’ নামে পরিচিত। রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকীতেও সরকারি সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থায়ী স্থাপনা করে দেয়া হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামেও স্থাপনা আছে; আছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। আর বাংলা একাডেমি এমনই যে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মশত বার্ষিকীতে কোনো স্থায়ী স্থাপনাই করেনি বা তা করার চেষ্টাও করেনি। আলগা চটকদারি কিছু আয়োজনে আমাদের ব্যর্থতাকে ঢাকবার চেষ্টা করেছি মাত্র। আগামী প্রজন্ম এ দায় থেকে আমাদের ক্ষমা করবে না কোনোদিন।
বাংলা একাডেমি তাদের বইয়ের দাম কিছুটা কমাতে পারে, যেমন বাংলা একাডেমির অভিধানগুলো বাজার মূল্যের চেয়ে বেশ কমই দাম রাখে। কথাটা এই কারণেই বলা যে, বই বিক্রির লাভের টাকায় বেতন-ভাতা হওয়ার কথা নয়। তাহলে অন্য প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কোনো মানেই হয় না। তাতে কম আয়ের মানুষদের বই কেনার আগ্রহটা কমে যায়। এটা আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।
আর একটা বিষয়, তা হলো ডিজিটালাইজেশন করা। বাংলা একাডেমির বই বিক্রি এখনও হাতেলেখা মেমোর ওপর ভরসা করতে হয়। এখানে ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড অচল, বিকাশ বা অন্যান্য ডিভাইসতো বলতে গেলে অচ্ছুত। সত্য মিথ্যা জানি না- দুর্জনেরা বলেন, এখানে নাকি কিছু ‘কিন্তু’ আছে। আজকের এই যুগে বাংলা একাডেমি এখনও ডিজিটাল হতে পারল না, এটা অবাক করা ঘটনা বৈকি। আমি প্রতি বছরই বাংলা একাডেমি থেকে কিছুনা কিছু বই কিনে থাকি। এবার একটি বইও কিনিনি।
প্রথমত, পকেটে নগদ টাকা বেশি থাকে না, কিন্তু কার্ড থাকে, যা অচল একাডেমিতে। দ্বিতীয়ত, মেলাতে বই কিনতে শতকরা ২৫ টাকা কমিশন পাওয়া যায়। বিকাশে পরিশোধ করলে আরও শতকরা ১৫ টাকা ক্যাশ ব্যাক পাওয়া যায়, তাহলে বাংলা একাডেমির বই কেন কিনব? তৃতীয়ত, কেনার মতো কোনো বই এবার একাডেমিতে পাইনি। নতুন যা ছাপানো হয়েছে তা সবই চর্বিতচর্বণ।
আমি মাঝে মাঝে কিছু প্রকল্পের কাজ করি। বিভিন্ন রকমের প্রকল্প। করোনাকালীন তেমনি একটা প্রকল্পের প্রয়োজনে বেশ কিছু বাংলায় লিখিত বইয়ের প্রয়োজন পড়ে। বইগুলো কারিগরি বিষয়ক। কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নশীল দেশে উন্নতির জন্যে, দেশের যুব সম্প্রদায়কে দক্ষ করে গড়ে তোলাই একমাত্র কাজ বলেই প্রতীয়মান হয়। এই কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্যে সহজবোধ্য বই প্রয়োজন। বাজারে কিছু পাওয়া যায় বটে, তবে তা সম্পূর্ণ নয় এবং দামও বেশি যা গ্রামের সাধারণ অল্প শিক্ষিত বেকারদের পক্ষে কেনা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। বাংলা একাডেমি একটি সরকারি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের কর্মক্ষেত্রটি খুঁজে দেয়া কর্তব্যজ্ঞান করতে পারে।
বেশ কয়েক বছর ধরে মেলার একটি অংশকে সরিয়ে উদ্যানে নেয়া হয়েছে। এটা বাংলা একাডেমির একটা ভালো সিদ্ধান্ত, কিন্তু অসম্পূর্ণ। যারা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পড়ে আছে তাদের বিক্রি-বাট্টা নেই বললেই চলে। এমনকি কী ধরনের বই বের হয়েছে সেসব দেখারও দর্শক নেই এপাশে। এবছরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যত বিক্রেতা আছে তার অর্ধেকও ক্রেতা বা দর্শক এখানে আসেন না। এতে কারো কোনো উদ্দেশ্যই সফল হয় না। এ বছরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গড়ে প্রতিদিন খুব বেশি হলেও শ’ তিনেক দর্শক আসেন, তার মধ্যে ১০/১২ জন ক্রেতা থাকেন। প্রায় দেড় শ’র বেশি বিক্রেতার জন্যে এটা নিশ্চয়ই সুখবর নয়। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো- প্রতিদিন বাংলা একাডেমি আয়োজিত যে আলোচনা অনুষ্ঠান হয় (বর্তমানে স্থগিত), তার দর্শক উপস্থিতি নিয়ে। আমার মনে হয় যারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, সামনে উপস্থিত দর্শক দেখে তারা তেমন উৎসাহবোধ করেন বলে মনে হয় না, যা তাদের কণ্ঠের অনুরণন শুনেই বোঝা যায়।
যা হোক, এবারে উদ্যানে যে জায়গাজুড়ে মেলা বসানো হয়েছে, আমার মনে হয় পুরো মেলাটিই সেখানে স্থানান্তর করা যেত। তবে একটা কথা না বললেই নয়, তা হলো, মেলার স্টলগুলোর ডিজাইন একেবারেই বেমানান।
এবারের মেলার নকশা নিয়ে অনেকেরই সমালোচনা করতে শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, আর্কিটেকচারও না, তবুও সাধারণ চিন্তায় মনে হয়েছে সবগুলো স্টল প্যাভিলিয়নের আকারে করা যেতে পারত। প্যাভিলিয়নগুলো ৪ বা ৬টি স্টল নিয়ে সজ্জিত হতে পারত। তাহলে অল্প জায়গায় বেশ খোলামেলাভাবে সবাই চলতে পারত। এতে অনেকটা নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকত। সারি সারি লম্বা বস্তির মতো মনে হতো না। বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানের জন্যে বিজয়স্তম্ভের খোলা স্থানকে বেছে নেয়ার সুযোগ ছিল।
মেলাকে শুধু কেনা-বেচার স্থান চিন্তা করলে ভুল হবে, যা আমরা করছি বর্তমানে। এখানে বিনোদন থাকা একান্ত জরুরি। তাই উন্মুক্ত মঞ্চটিকে আরও সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।
গত ক’দিন আগের খবর, শোনা যাচ্ছিল মেলা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। খবরে প্রকাশ পেল মন্ত্রী বলেছেন- মেলা স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেমন চলছে, তেমনই চলবে। স্টল মালিকেরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছিলেন মন্ত্রীর কথায়, কিন্তু ৩১ মার্চ মেলার শুরুতেই একটি ঘোষণা শোনা গেল- মেলার সময় কমিয়ে দুপুর ৩ থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হয়েছে এটা একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত। দুর্জনেরা বলেন, আমলাতান্ত্রিক পলিসি। কর্মকর্তাদের লাভ থাকবে কিন্তু অন্যদের ক্ষতি করা যাবে। মেলা বন্ধ করার সাহস তাদের হয়নি, ক্ষতিপূরণের দাবি ওঠার ভয়ে, কিন্তু মেলায় তাদের উপস্থিতি বন্ধ করা যাবে। কেননা, মেলা-সংশ্লিষ্ট সবাই জানে মেলাতে ৪টার দিকে কিছু তরুণ-তরুণী আসে ঘুরতে। কিন্তু যারা বই কিনতে আসেন তাদের উপস্থিতি সন্ধ্যা ৬টার পরেই হয়। আর শুক্র-শনিবার ছাড়া কেউ অফিস-আদালত ছেড়ে মেলাতে আসবে না, এটা নিশ্চিত।
এর আগে মেলার সময় ১ ঘণ্টা কমিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনা না করেই। এবার কারো মতামত নেয়া বা আলোচনা করা হয়েছে কি না সেটা অবশ্য জানা যায়নি। যদি মেলার সময় কমাতেই হয়, তবে তা বিকেল ৫ থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত করা যেতে পারে। তাতে কিছু ক্রেতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বর্তমান নিয়মে যদি দেশের বন্দর আর কাঁচাবাজার উন্মুক্ত থাকে- করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করার কোনো রাস্তাই খোলা থাকে না।
লেখক: নাট্যকার, সংস্কৃতিকর্মী।