বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভয়াল করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চাই সংক্রমণ প্রতিরোধ

  •  নাসির আহমেদ   
  • ৩১ মার্চ, ২০২১ ১৯:২৫

করোনা আজ আমাদের জাতীয় দুর্যোগের পর্যায়ে পৌঁছাতে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, যুব ক্লাব, ক্রীড়া সংগঠন, এনজিওসহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকে বাঁচাতে, দেশকে বাঁচাতে।

করোনা পরিস্থিতি ভয়ালরূপ ধারণ করেছে। বিশ্বজুড়ে এই মহামারির তাণ্ডব চরম আকার ধারণ করলেও বাংলাদেশ ছিল মোটামুটি স্বস্তিকর অবস্থায়। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারও ছিল অত্যন্ত কম এবং অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। গতবছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনা মহামারি প্রতিরোধে সরকার লকডাউন কর্মসূচিসহ ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, দলীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, ইমামসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি জেনে করণীয় নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। ব্যবসা বাণিজ্যসহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছেন। কর্মহীন মানুষকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশের সরকারপ্রধান এভাবে সারা দেশের তথা তৃণমূল মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে করোনা মহামারি-সৃষ্ট সংকট নিরসনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন কি না আমাদের জানা নেই।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং উদ্দীপনায় উদ্যমী হয়েছে গোটা প্রশাসন। তারা করোনার সংক্রমণরোধে যেমন সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, তেমনই করোনায় সৃষ্ট দরিদ্র কর্মহীন মানুষকে সরাসরি সহায়তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, করোনাকালীন ত্রাণ সহায়তা আত্মসাৎ করার মতো মানুষ নামের কিছু কীটেরও সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি গত বছর । জনপ্রতিনিধি হয়ে এরা দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি ত্রাণ সহায়তা আত্মসাৎ করে জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদাকেই হেয় করেছে। অনেক চেয়ারম্যান-মেম্বার দেশের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এসব রিলিফ চোরদের আবারও ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে! প্রশ্ন জাগে এরা নমিনেশন পায় কী করে! স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ কি এদের কুকীর্তির খবর জানতেন না?

যা-ই হোক যে কথা বলার জন্য প্রসঙ্গের এই বিস্তৃতি, তা হলো- এত বড় বিশ্বজোড়া দুর্যোগে বিশ্বের বহু দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বিপুল হলেও ১৭ কোটি মানুষের এই ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার অনেক নিচের স্তরে ছিল। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যে বিপুলসংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যু, সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক স্বস্তিকর অবস্থানে ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণের বছরান্তে (এই মার্চের শুরু থেকেই ) সেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করেছে। ক্রমাগত সংক্রমণ হার বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুহারও। গত এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুপরিস্থিতি ভয়াবহ! যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বাধিক। গত ২৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি।

মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। আজ ৩১ মার্চ এ লেখা পর্যন্ত সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। এই চিত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও প্রলম্বিত করা হয়েছে। আসন্ন রোজা এবং ঈদের পরে খোলার কথা বলা হলেও পরিস্থিতি যদি এমনই থাকে, তাহলে জুনেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কি না বলা মুশকিল।

কিন্তু জনসাধারণ সচেতন না হলে আইনি বিধি-নিষেধ আরোপ করেও করোনার এই ভয়াল সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে না । এক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি বাধ্যতামূলকভাবে মানানো না গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ অকল্পনীয় ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এখনই হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য বেড পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আইসিইউ তো সোনার হরিণ!

এখন চিকিৎসার চেয়ে জনসাধারণকে সংক্রমণমুক্ত রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। এমন সংকটময় অবস্থায় যে হারে করোনা রোগী প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে চিকিৎসা ছাড়াই মানুষকে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। সুতরাং যেখানে আমাদের চিকিৎসা-সুবিধা সীমিত, সেখানে প্রধান অবলম্বন হতে পারে জনসাধারণকে সংক্রমণমুক্ত রাখা। আগেই বলেছি আইন প্রয়োগ করে সব সময় সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। করোনাকালীন বিধিনিষেধ মানছে না

অধিকাংশ মানুষ। মাস্ক পরার জন্য বেতার-টেলিভিশনে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বার বার বলা হলেও কর্ণপাত করছেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। আপনি যেকোনো বাজারে গেলে জুমার দিনে মসজিদে গেলে এই অবস্থা কত ভয়াবহ তা উপলব্ধি করতে পারবেন। অধিকাংশ মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। এমনকি যত্রতত্র সবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন! বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য। যেকোনো নদীতীরে খেয়াঘাটে দেখা যাবে গাদাগাদি করে নৌকায় মানুষ পারাপার হচ্ছে, অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নেই। পিকনিক, বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে উপচেপড়া ভিড় এখনও দৃশ্যমান।

বিয়েসহ নানারকম সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, বিক্ষোভ প্রতিবদ, রাজপথে সমাবেশ সর্বত্রই ভয়াবহ উদাসীনতা করোনা বিষয়ে। স্বাস্থ্যবিধি তো কেউ মানছেই না, বরং তার বিপরীত চিত্রটাই বেশি করে চোখে পড়ে সর্বত্রই! মনে করি সেই শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ,ইউনিয়নের মেম্বার এরকম শ্রেণির মানুষও করোনা সচেতনতায় অত্যন্ত উদাসীন। বাংলাদেশের যেকোনো একটি গ্রামে গেলে এর সত্যতা মিলবে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গেলেও এই ভয়ংকর চিত্র দেখা যাবে। আর ঘনবসতিপূর্ণ এই রাজধানী ঢাকায়, গণপরিবহন বলুন বাজার বলুন আপনি যেখানেই যাবেন উদাসীনতার ভয়ংকর চিত্র দেখতে পাবেন।

ভাবি এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিতে পারি না। আমি মনে করি পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠছে তাতে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

এ ব্যাপারে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে হবে না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তৃণমূলপর্যায় পর্যন্ত কর্মীদের দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করবার মতো ক্যাম্পেইন এবং মাস্ক বিতরণসহ করোনা বিষয়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দলই নিজেদের জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলবার জন্যে এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।

করোনা আজ আমাদের জাতীয় দুর্যোগের পর্যায়ে পৌঁছাতে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, যুব ক্লাব, ক্রীড়া সংগঠন, এনজিওসহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকে বাঁচাতে, দেশকে বাঁচাতে।

জাতীয় দুর্যোগের কথা শুনে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন। না বাড়াবাড়ি নয়, বাস্তবেই ভয়ংকর আশঙ্কার দিকে যাচ্ছি আমরা।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যা ইতোমধ্যেই যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

তিনি এবারের কোভিডের ব্যতিক্রমী চিত্র তথা ভয়ংকর পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে।

‘‘১. কোভিড স্যাম্পল (RT-PCR) যেটাই আসুক এইচ আর সিটিস্ক্যানে (HR CT Scan of Chest) ১০-৭০% পর্যন্ত ফুসফুস ইতোমধ্যে আক্রান্ত৷

২. রোগীর শ্বাসকষ্ট বাহ্যিকভাবে বেশ কম, কিন্তু সেচুরেশন (১SpO2) অস্বাভাবিকভাবে অনেক কম৷

৩. অনেক রোগী মাত্র ১৫ মিনিট ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে আকস্মিকভাবে খারাপ হয়ে যাচ্ছেন এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যাচ্ছেন৷

৪. ডায়েরিয়া এবং বমি অস্বাভাবিকভাবে বেশি, সঙ্গে প্রচণ্ড শারীরিক দূর্বলতা৷

৫. কেউ কেউ এতই এলোমেলো আচরণ করছেন যে, অক্সিজেন মাস্কও রাখতে চাচ্ছেন না।

৬. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এবারের অধিকাংশ রোগীই বয়সে তরুণ, আগে যারা জটিল রোগমুক্ত ছিলেন।

আমাদের হাসপাতালের পাঁচটি তলার ৩২৪টি বেড প্রায় পূর্ণ হওয়ার পথে, সামনে কেউ ওয়ার্ডেও ভর্তি হতে পারবেন না, আইসিইউ তো প্রায় অসম্ভব।

ইতোমধ্যে আমাদের ডাক্তার ভাই-বোনদেরকে ভর্তি দেওয়াও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আমি গতকাল এবং আজ (৩০ও ৩১ মার্চ) ২টি মৃত্যু ডিক্লেয়ার করেছি, সময় পেয়েছি ৩০ মিনিট, আরও একটি মৃত্যু অপেক্ষায় ছিল, এছাড়া প্রতি শিফটিং ডিউটিতে ৮/১০টি রোগীর জন্যে আইসিইউর জন্যে রেফার করছি, কিন্তু তাদের অধিকাংশই আইসিইউ সিট পাচ্ছেন না।’

তিনি আরও লিখেছেন:

‘হঠাৎ কেমন জানি অস্বস্তিকর ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রতিফলন কিছুটা নিজের মাঝেও টের পাচ্ছি। একেকটি ডিউটি শেষ করে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। তাই সবাই স্বাস্থ্য সচেতন হোন।’

‘এবারে কোভিডের সিনারিও অত্যন্ত ভয়াবহ। গতবছরের শুরুর দিক থেকেও আপাতদৃষ্টিতে অধিকতর ভয়াবহ মনে হচ্ছে৷ তাই দয়া করে যারা পার্টি করছেন, বিভিন্ন জায়গায় মাস্তির ছবি দিচ্ছেন, দয়া করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টিকর্তার দোহাই দিয়ে বলছি এগুলো বন্ধ করেন।

ডা: সৈয়দ অলী মোঃ রাসেল ।

সহকারী সার্জন

মুগদা ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট কোভিড হাসপাতাল।”

একজন চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা এককথায় ভয়াবহ, আশঙ্কাজনক। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সামান্য উদাসীনতারও আর সুযোগ নেই। আসুন সবাই মিলে সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগে জনগণকে সচেতন করি, নিজেরা সচেতন হই, করোনার মহামারির থাবায় মৃত্যুর মুখে নিজেদের ঠেলে না দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আরও কিছুকাল এই রূপ-রস, গন্ধময় পৃথিবীতে অপেক্ষা করি।

লেখক : কবি, সিনিয়র সাংবাদিক-কলাম লেখক, সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর