বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

একটি মহলের গাত্রদাহের কারণ বোধগম্য

  •    
  • ৩১ মার্চ, ২০২১ ১৫:৪৭

ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। পক্ষ-বিপক্ষের শক্তির ভূমিকা আলোচনায় আসুক, সেটা একটি মহল চায়নি। গত কিছুদিন ধরে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির কারণে দিনটি কাঙ্ক্ষিতভাবে উদযাপন করা যায়নি। জাতীয়পর্যায়ের অনুষ্ঠান হয়েছে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে, সীমিতসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে। আমন্ত্রিত হয়েছেন যারা, নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেছেন- যদিও এ জন্য করোনা পরীক্ষাসহ বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে।

কেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার অনুষ্ঠান সব মানুষকে নিয়ে উদযাপন করা গেল না, এ প্রশ্নের উত্তর সহজ- করোনার ভয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোটি কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ফল। সরাসরি অস্ত্রহাতে নিয়েছিল লাখ দুয়েক মানুষ। একপর্যায়ে ভারতীয় সেনা-বিমান ও নৌ বাহিনী যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। তাদের অনেকের রণাঙ্গনে জীবন দেয়। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পেছনে মূল ভূমিকা বা অবদান রেখেছিল কোটি কোটি নিরস্ত্র নারী-পুরুষ। ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মেজর জেনারেল জ্যাকব। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের সদর দফতর ফোর্ট উইলিয়ামে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আমাদের একটি দলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৯ মাস ধরে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষ পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর শক্তিক্ষয় করেছিল যেভাবে, তাতে ডিসেম্বরের অভিযান অনেক সহজ হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকামুক্ত করার পথে এগিয়ে গেছে জনগণের সহযোগিতায়। তারা সহজ পথ দেখিয়েছে, খাবার দিয়েছে এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা পরাজিত হয়ে পালাতে গেলে সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়েছে। অথচ করোনার কারণে এই মানুষকে নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা গেল না।

যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের যে বড় কষ্ট! তাদের ন্যূনতম বয়স ৭০ বছরের আশপাশে। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর খবর পাই। ৫-১০ বছর পর আর কোনো সহযোদ্ধা বেঁচে থাকবেন বলে মনে হয় না। অথচ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনের মতো স্মরণীয় বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তারা থেকেও নেই। করোনা বিদায় নিলে তাদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা উচিত বলে আমি মনে করি। শহর-বন্দর-গ্রাম, সর্বত্র আয়োজন হবে এ অনুষ্ঠানের।

এখন যেকোনো সরকারি অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে থাকে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ। এর পক্ষে অনেক যুক্তি দেয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনক যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের অস্তিত্ব আর নেই। দলাদলি-রেষারেষি কী সর্বনাশ করেছে, সেটা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধিতে আসবে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখেছি, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বীর যোদ্ধারা ভেতরে প্রবেশের জন্য আনসার বাহিনীর সদস্যদের কাছে কাকুতি-মিনতি করছেন। কেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করতে পারবেন না, এ প্রশ্ন করে তুলে লাঠির আঘাত পেতেও দেখেছি। ভেতরে প্রবেশ করার ভাগ্য অর্জন করার পর তরুণ সেকসন অফিসার তাদের গালমন্দ করছেন, এমন ভয়ংকর অপরাধের সাক্ষীও যে হতে হয়েছে! জেলা-উপজেলায় অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একটু সময়ের জন্য সাক্ষাৎ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। তাদের ভাতা পেতে সমস্যা। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্ব যারা দিতে চান, তারা কি আত্মশুদ্ধি করতে পারবেন? কেন স্বাধীনতার জন্য বীরের মতো লড়েও তারা নিজেদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেললেন?

বাংলাদশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি পুনর্গঠন-পুনর্বাসনের কাজ শেষ করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন- লক্ষ্য ছিল কৃষি-শিল্প খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার বিষয়টিও তিনি সামনে আনেন। তাকে এ কারণেই হত্যা করা হয়েছিল।

আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের ৫০ বছরের প্রায় ৩০ বছর ক্ষমতা জবরদখল করে ছিল এমন শক্তি, যারা স্বাধীনতা চায়নি। ক্ষমতার বাইরে যখন, তখনও নানাভাবে এই অপশক্তি দেশের অগ্রগতি ব্যাহত করার কাজ করেছে মহা উৎসাহে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বর্বরতার খবর যে আলোচনায় না আসে সে জন্য তারা সচেতনভাবে অগ্রসর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। জাতিসংঘেও এ দুটি দেশ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।

অপরদিকে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। পক্ষ-বিপক্ষের শক্তির ভূমিকা আলোচনায় আসুক, সেটা একটি মহল চায়নি। গত কিছুদিন ধরে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সৈন্য ও অস্ত্র-গেলাবারুদ আনার জন্য শ্রীলঙ্কার বিমান বন্দর ও অন্যান্য সুবিধা ব্যবহার করেছে। শ্রীলঙ্কার সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার কথা ভালোভাবেই অবহিত ছিল। তারা বলতে পারত- গণহত্যার জন্য তাদের দেশের বিমানবন্দর সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু সেটা তারা করেনি। কেন মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের পরও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অতিথি, সে প্রশ্ন এ মহল তোলেনি। চীনের প্রেসিডেন্ট কেন সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভিডিওতে বক্তব্য রাখার সম্মান পেলেন, সে প্রশ্ন এ মহল সযতনে এড়িয়ে গেছে।

সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমজনতার অংশগ্রহণ কার্যত ছিল না, এতে সন্দেহ নেই। অথচ এই জনতার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী মর্যাদার আসনে। বিশ্বনেতারা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে যেসব অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন, তাতে অর্থনীতি এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনকল্যাণ খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে। বেশিরভাগ বার্তাতেই দেখা গেছে- কূটনীতির সৌজন্যমূলক ভাষার বাইরেও বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত রাষ্ট্রনায়ক, সেটা আবার প্রমাণিত হলো।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ভালো কাজ করেছে। এ সব সাফল্য একটি মহলের গাত্রদাহের কারণ, সন্দেহ নেই। ২৬ ও ২৭ মার্চ বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে অস্থিরতা সৃষ্টি এ গাত্রদাহেরই ফল। মুক্তিযুদ্ধ তাদের আক্রমণের টার্গেট হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টার্গেট হয়েছে। স্বাধীনতার মূল্যবোধ টার্গেট হয়েছে। এ শক্তিকে মোকাবিলার জন্য আগামীতে কী কৌশল অনুসরণ করা যায়, সে বিষয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের সকলকে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এ জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমজনতার কাছে যাওয়া।

বরিশালে মুজিব শতবর্ষের লোগো ফুটিয়ে তুলতে দশ হাজারের বেশি মানুষ মাসের পর মাস পরিশ্রম করেছে। তাদের অভিনন্দন। এই চমৎকার উদ্যোগের জন্য সংশ্লিষ্টদেরও অভিনন্দন। আশা করব- বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার কথা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য এভাবে অনেক অনেক সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ছড়িয়ে পড়বেন। কেবল বরিশাল নয়, সর্বত্রই চাই এমন আয়োজন। মনে রাখা চাই, মুক্তিযুদ্ধের সুফল যারা নস্যাৎ করতে চায় তারা কিন্তু আরও ছোবল দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, কলাম লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর