সম্প্রতি এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। স্বীকৃতিটা এমন সময় এলো, যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি, যা জাতি হিসেবে গর্বের এবং ঐতিহাসিক ঘটনা।
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ দেশের উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে; সেই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথ সহজ করবে।
সব ঠিক থাকলে পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকাল শেষে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাবে। আর এই উত্তরণ যেন টেকসই হয় তার জন্য পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। অন্যথায়, স্বল্পোন্নত বাণিজ্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জসমূহের ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি যত বেশি আলোচনা হয়; কিন্তু ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার-সম্পর্কিত বাণিজ্য চুক্তি (Agreement on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights’ (TRIPS/ট্রিপস) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নমনীয়তা বা সুবিধা বাতিল হলে বাংলাদেশ যে ধরনের চ্যালেঞ্জসমূহের সম্মুখীন হতে পারে সে বিষয়টি ততটা প্রাধান্য পায় না।
অথচ বর্তমান জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের পরিবর্তে জ্ঞানভিত্তিক সম্পদকে টেকসই উন্নয়নের প্রাথমিক উৎস বলে বিবেচনা করা হয়। এই প্রেক্ষিতে সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির বিষয়টিকে গতিশীল ও জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে সরকার ২০১৮-২০২৮ কে ‘উদ্ভাবন দশক’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।
বাংলাদেশ বর্তমান ট্রিপস চুক্তির অধীন যেসব শিথিলতা উপভোগ করে সেগুলো বাতিল হলে এবং চুক্তির সকল বাধ্যবাধকতা পরিপালন করতে হলে– দেশের অর্থনীতির ওপর যেমন প্রভাব পড়বে তেমনই প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির আইনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। তাই ট্রিপস চুক্তি বাস্তবায়নের প্রভাবসমূহ বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বর্তমান ট্রিপস চুক্তির অধীন বাংলাদেশ দুই ধরনের পরিবর্তনের সময় (ট্রানজিশন পিরিয়ড) থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে– একটি সাধারণ ট্রানজিশন পিরিয়ড এবং ওষুধশিল্পের জন্য একটি বিশেষ ট্রানজিশন পিরিয়ড।
এক. সাধারণ ট্রানজিশন পিরিয়ডের সময়ে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে ট্রিপস চুক্তির মূল অ-বৈষম্যমূলক মূলনীতি (core non-discrimination principles) ব্যতীত অন্য নীতিসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে, যা ২০২১-এর ১ জুলাই পর্যন্ত থাকবে। এই সময়ের মধ্যে, একটি সঠিক এবং টেকসই প্রযুক্তিগত ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম করার উদ্দেশ্যে এবং চুক্তিটির বাস্তবায়নের সুবিধার্থে স্বল্পোন্নত দেশের ‘উদ্যোগ এবং সংস্থাগুলোকে (enterprises and institutions)’ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য উন্নত দেশ কর্তৃক প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা প্রদানের নির্দেশনা ছিল।
যদি এই সময় বাড়ানো না হয়, তবে বাংলাদেশ জুলাই মাসের পর থেকে বাংলাদেশ আর উন্নত দেশ থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য প্রণোদনা পাবে না; তাই ট্রিপস চুক্তির পরিপালন ব্যয়বহুল হবে।
দুই. বিশেষ ট্রানজিশন পিরিয়ডের সময়ে এলডিসিভুক্ত দেশের ওষুধশিল্পের তথা ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের ক্ষেত্রে পেটেন্ট এবং অঘোষিত তথ্য (ট্রেড সিক্রেট) সুরক্ষা থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে, যা ২০৩৩-এর ১ জানুয়ারি শেষে অথবা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ– যেটি আগে ঘটবে; তত দিন বলবৎ থাকবে।
পেটেন্ট-সম্পর্কিত বিধিনিষেধ মওকুফের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এখন কম ব্যয়ে তথাকথিত জেনারিক বা নন-ব্র্যান্ডযুক্ত ওষুধ তৈরি করতে পারে এবং চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে পারে।
সব ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে পেটেন্ট এবং ট্রেড সিক্রেট সুরক্ষা থেকে ছাড় সংক্রান্ত নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার সাত বছর আগেই (২০২৬ সালে) পেটেন্ট সম্পর্কিত মওকুফের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
অর্থাৎ ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধার সময় বাড়ানো না হলে ২০২৬ সালের পর থেকে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব আইন কার্যকর করতে হবে। ওষুধশিল্প পেটেন্ট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হলে ওষুধ উত্পাদন খরচ বেড়ে যেতে পারে– ফলে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে– বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করা হয় স্থানীয় বাজারে শুধু ইনুসলিনের দাম ৮ গুণ বাড়তে পারে। এমনকি কোম্পানিগুলো রপ্তানি ব্যবসা হারাতে পারে।
তিন. বিশেষ ট্রানজিশন পিরিয়ডের সুবিধার পাশাপাশি জেনারেল কাউন্সিল এলডিসিভুক্ত দেশকে– মেইলবক্সের প্রয়োজনীয়তা এবং একচেটিয়া বিপণনের অধিকারগুলো থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে– যা ২০৩৩-এর ১ জানুয়ারি পর্যন্ত, তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২৬ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
মেইলবক্সের বাধ্যবাধকতার অধীন প্রয়োজনীয়তা বাতিল হলে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের পেটেন্ট আবেদন যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট প্রশাসনিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন হতে পারে যার জন্য স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হতে পারে।
চার. ট্রিপস চুক্তির সকল বাধ্যবাধকতা পরিপালন নিশ্চিত করতে হলে দেশের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সংশোধন ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। যেসব আইন সংশোধন করতে হবে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– পেটেন্ট আইন ১৯১১ সংশোধন করতে হবে কারণ এই বেশকিছু বিধান ট্রিপস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিদ্যমান আইনে কেবল ১৬ বছরের জন্য পেটেন্ট সুরক্ষার বিধান আছে, যা ২০ বছর পর্যন্ত বাড়াতে হবে। তদুপরি, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য এবং প্রক্রিয়ার পেটেন্টের বিধান প্রণয়ন, প্রাণী এবং উদ্ভিদের জাত এর পেটেন্ট সুরক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। যদিও আইনটি সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে নতুন পেটেন্ট আইনের খসড়া ২০১৪ সালে করা হয়েছে কিন্তু উদ্যোগটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
এছাড়াও, ট্রেড সিক্রেটস সুরক্ষার জন্য ট্রেড সিক্রেটস আইন এবং লে-আউট ডিজাইনের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (ইলেক্ট্রনিক সার্কিটের ডিজাইন বা চিপস) আইন প্রণয়ন করতে হবে। মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়ন বা সংশোধন সম্পর্কিত তথ্য ট্রিপস কাউন্সিলের নিকট জমা দিতে হবে এবং বাৎসরিক ভিত্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সম্পর্কিত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে– যা কাউন্সিল পর্যালোচনা করবে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মেধাস্বত্ব আইন অবহিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখিয়েছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিসহ পরিষেবার মান উন্নত করার লক্ষ্যে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। ট্রিপস চুক্তির আওতাভুক্ত সকল বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সম্পর্কিত আইন বা অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রয়োগ পদ্ধতি এবং প্রতিরোধমূলক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এর জন্য সারা দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (আইপিআর) আদালত প্রতিষ্ঠা, মেধাস্বত্ব সম্পত্তি রক্ষায় টাস্কফোর্স গঠন, জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও শুল্কসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা এজেন্সিগুলোতে সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার সম্পর্কিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সব কিছু মিলিয়ে আগামী পাঁচ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসডিজি বাস্তবায়ন এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রবেশের ক্ষেত্রে মেধাসম্পদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে অবদান রাখবে।
লেখক: আইনজীবী এবং কলাম লেখক।