বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাহিত্য থেকে সিনেমা

  • জাহীদ রেজা নূর   
  • ৩০ মার্চ, ২০২১ ১৭:১০

সাহিত্য তো দেশবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মেধা, রুচি যখন রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজকে একসূত্রে গাঁথে, তখন সামগ্রিকভাবেই ঋদ্ধ হয় দেশ। একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়ে যায় সমাজের নানা অংশের মানুষ। কিন্তু রাজনীতি যখন সংস্কৃতির হাত ছেড়ে দেয়, সংস্কৃতি যখন নিজ সমাজ থেকে দূরে সরে যায়, তখন নান্দনিক কিছু নির্মাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

একটা দারুণ কথা বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। র‌্যাডিসন হোটেলে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এখন সাহিত্যধর্মী ছবিই তো কমে গেছে। এরপর আমাকে তিনি কিছু উদাহরণ দিয়েছিলেন।

অনেকেই হয়তো সৌমিত্রের সঙ্গে একমত হবেন না। বলবেন, সাহিত্য দূরে থাক, এখন চিত্রনাট্য লেখারও প্রয়োজন নেই। সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেয়া যায়। ওতেই তৈরি হয় নতুন যুগের সিনেমা-নাটক। কিন্তু সৌমিত্রের মতো জাত অভিনয়শিল্পীরা একটা স্বপ্নের চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করেন। যেমন, তার ইচ্ছে ছিল কিং লিয়রের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। সে ইচ্ছে তার পূরণ হয়েছিল। একই ইচ্ছে ছিল আমাদের হুমায়ুন ফরীদির। কিন্তু ফরীদি তার ইচ্ছেপূরণ করে যেতে পারেননি।

ভালো গল্প থেকে ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হওয়ার নজির আমাদের ভাষায় যেমন, অন্য ভাষায়ও আছে। আমরা তো ‘পথের পাঁচালী’র নাম দিয়েই আলোচনা শুরু করতে পারি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ রায়—দুজনই বুঝি নতুন দুটি ‘পথের পাঁচালী’র জন্মদাতা!

আলোচনার স্বার্থেই বই আর চলচ্চিত্রের সম্পর্ক নিয়ে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। হাতের কাছে যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে, শুধু সেগুলো নিয়েই খোশগল্প হবে। এর বাইরে আরও অনেক উদাহরণ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আমরা সফল উপন্যাসের সফল চিত্রায়ণ নিয়েই কথা বলব। উপন্যাস থেকে বাজে ছবি তৈরি হয়েছে—এমন উদাহরণগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখব।

পাতা ওল্টানোর শব্দ আর নতুন বইয়ে প্রেসের মনকাড়া গন্ধ অনেককেই মুগ্ধ করতে পারে। তাই দুই মলাটে বন্দি বই-ই হয়ে উঠতে পারে প্রিয়। আবার কেউ কেউ সিনেমা হলের ঠাণ্ডা ঘরে বসে সিনেমাটা দেখেই পেতে পারেন সেরা আনন্দ। বই তাকে না-ও টানতে পারে। আবার কখনও কখনও বইটি এবং চলচ্চিত্রটি হয়ে ওঠে একে অন্যের পরিপূরক।

এ কথা প্রমাণের জন্য প্রথমেই মার্গারেট মিচেলের লেখা ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ উপন্যাসটির কথা বলা যেতে পারে। ১৯৩৯ সালে তিনি লিখেছিলেন উপন্যাসটি। যিনি পড়েছেন, তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে ‘কাল আমি এ বিষয়ে ভাবব’—সংলাপটি। দশ বছর সময় নিয়ে মিচেল লিখেছিলেন উপন্যাসটি। রেট বাটলার, অ্যাশলি উইলকস, মেলানি আর অবশ্যই স্কারলেট ওহারাকে নিয়ে গড়ে ওঠা এই উপন্যাস পড়ে কাঁপেনি মন—এমন একজন পাঠককেও কি পাওয়া যাবে? মিচেল ভাবতেও পারেননি তার লেখা উপন্যাসটি এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্যজগতে এ ছিল এক বিরাট বিস্ময়।

কোনো একজন পরিচালক ছবিটি একা পরিচালনা করার কথা ভাবেননি। স্যাম উড, ভিক্টর ফ্লেমিং ও জর্জ কিউকোর মিলে নির্মাণ করেছিলেন এই ছবি। অভিনয়ের জন্য তারা পছন্দ করেছিলেন ভিভিয়ান লি (স্কারলেট ওহারা) ও কার্ক গ্যাবেলের (রেট বাটলার) মতো অসাধারণ অভিনয়শিল্পীদের। তাদের এই জুটি নিয়ে এখনও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। একই নামের এই ছবিটি জিতে নিয়েছিল আটটি অস্কার। অপরদিকে উপন্যাসটির জন্য মার্গারেট মিচেল পেয়েছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার।

‘ফ্রম হেয়ার টু এটারনিটি’ বিংশ শতাব্দির সেরা ১০০টি উপন্যাসের তালিকায় ঢুকে গেছে সেই কবে। উপন্যাসে রবার্ট লি প্রিউটকে ঘিরে ঘটে চলে কাহিনি। সাধারণ একজন যুবক সে। সেনাবাহিনী থেকে উদ্ধারের পথ খোঁজে, কিন্তু সে এমন সব প্রতিকূলতা, নৃশংসতা ও অমানবিকতার মুখোমুখি হয় যে, শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় এক বিদ্রোহী যুবকে। সেই ট্র্যাজেডি নিয়েই উপন্যাসটি। সেইসঙ্গে আছেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাজিও, সার্জেন্ট মিল্প টার্বার। তারাও তাদের মতো করে সামরিক বাহিনীর অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।

এটি ছিল উপন্যাসিক জেমস জোনসের প্রথম উপন্যাস।

ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। পরিচালক ফ্রেড সিনেম্যান উপন্যাসের নামেই রাখলেন ছবির নাম । ছবির কাহিনিতেও তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আনলেন না। তবে ছবির চরিত্রগুলোকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তুললেন। এই ছবিটিও পেল মোট ৮টি অস্কার। বইটির মতোই জনপ্রিয় হলো ছবিটি।

পিয়ের বুলের ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’ লেখকের চীন, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই। তিনি সেখানে জাপানিদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং একসময় পালাতে পেরেছিলেন। পশ্চিমা জগতের একজন সৈন্যের চোখে এশিয়ার মাটিতে সংঘটিত যুদ্ধের এ রকম বর্ণনা আজতক আর কোথাও পাওয়া যায় না।

গল্পে দেখা যায় কর্নেল নিকোলসন ও তার সেনাদল জাপানিদের হাতে বন্দি হয়। কাওয়াই নদীর ওপর একটি কৌশলগত সেতু বানানোর কাজে তাদের লাগিয়ে দেয়া হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে তৈরি করতে হবে সেতু। সাইতো নামের জাপানি কর্নেলের উগ্রতা, নৃশংসতার মধ্যেই কাজ করে যেতে হচ্ছিল নিকোলসনদের। সাইতোর মনস্তত্ত্বও তো বুঝতে হবে। সময়মতো সেতু নির্মাণ করা না হলে তাকে হারিকুরির মাধ্যমে আত্মহত্যা করতে হবে। এই সময় ব্রিটেনের সেনাবাহিনী সেতুটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করতে শুরু করে।

বইটি পড়ার পর কিংবা ছবিটি দেখার পর সেখানে ইতিবাচক আর নেতিবাচক চরিত্র খুঁজে বের করা খুবই কঠিন কাজ। প্রত্যেকে তার জন্য বরাদ্দ রাখা সেরা কাজটাই করার চেষ্টা করছে। হয়তো একে অন্যের জন্য সেটা হয়ে উঠছে মারাত্মক।

ডেভিড লিনের তৈরি করা ছবিটি শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক ঋদ্ধতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ১০০টি ছবির মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে। পিয়ের বুল যেভাবে উপন্যাসের চরিত্রগুলো এঁকেছেন, ঠিক সেভাবেই তার চলচ্চিত্রায়ন করেছেন ডেভিড লিন। গত শতাব্দির পঞ্চাশের দশকে ‘কী দেখানো যাবে আর কী দেখানো যাবে না’, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও ডেভিড লিন উপন্যাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ছবিটি তৈরি করেছেন। আর হ্যাঁ, ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৭ সালে। জিতে নিয়েছিল ৭টি অস্কার।

আরেকটি চলচ্চিত্রের কথা বলেই থামব আজ। লিউ ওয়ালেসের লেখা ‘বেন–হার’ বইটি থেকে উইলিয়াম ওয়াইলার যখন একই নামের ছবিটি নির্মাণ করলেন, তখন প্রথমবারের মতো কোনো ছবি ১১টি অস্কার পেল। এরপর অবশ্য ১১টি করে অস্কার পেয়েছে পিটার জ্যাকসনের ‘লর্ড অব দ্য রিং: রিটার্ন অব দ্য কিং’ এবং জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’।

যিশুখ্রিস্টের সমসায়মিক বেন–হার নামে একজন ইহুদি তার কাছের বন্ধু মেসালার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে ক্রীতদাসের ঘানি টানেন। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির পরিকল্পনা করেন; এবং অনেক অমানবিক পরিশ্রম করে ফিরে আসেন জেরুজালেমে। তারপর তিনি বুঝতে চান কেন তিনি বেঁচে আছেন!

এরপর চাইলে টমাস কেনিলির ‘দ্য সিন্ডলার লিস্ট’ বইটির কথা বলা যায়। বলা যায় মাইকেল অনডাচের লেখা ‘ইংলিশ পেশেন্ট’ উপন্যাসটির কথা। প্রথম ছবিটি নির্মাণ করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ, দ্বিতীয়টি আন্টনি মিনঘেলা। এ রকম করে খুঁজলে আরও অনেকগুলো ছবি নিয়ে আলোচনা করা যায়।

কিন্তু উদ্দেশ্য শুধু কিছু তথ্য দেয়া নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে সাহিত্যের মধ্য থেকে ভালো কাহিনি খুঁজছিলেন, তাতে কোনো ভুল ছিল কি না, সেটা খুঁজে বের করাও একটা কাজ। রুচিশীল সাহিত্য গড়ে উঠলে তা থেকে রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও মাথায় আসে। সাহিত্য তো দেশবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মেধা, রুচি যখন রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজকে একসূত্রে গাঁথে, তখন সামগ্রিকভাবেই ঋদ্ধ হয় দেশ। একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়ে যায় সমাজের নানা অংশের মানুষ। কিন্তু রাজনীতি যখন সংস্কৃতির হাত ছেড়ে দেয়, সংস্কৃতি যখন নিজ সমাজ থেকে দূরে সরে যায়, তখন নান্দনিক কিছু নির্মাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ভালো গল্প থেকে ভালো চলচ্চিত্র আমাদের দেশে কি আদৌ হয়েছে? হলে সংখ্যায় তা কত? সিনেমা দেখার চলই উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অবশ্য এ প্রবণতার জন্য আরও অনেকগুলো বিষয় ক্রিয়াশীল। এখানে সে আলোচনা নয়। শুধু একটা বিষয় স্পর্শ করে যাওয়া ভালো, যারা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, তাদের বিশাল একটা অংশের মধ্যে কি গভীরতার অভাব দেখা যাচ্ছে, আর গভীরতা যার আছে, তিনি কি এদেরই হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছেন?

লেখক: গবেষক-কলাম লেখক, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর