শিশুতোষ বই নিয়ে হাপিত্যেশ করতে দেখা যায় প্রতি বইমেলাতেই। হাপিত্যেশের মূল কারণ হচ্ছে শিশুদের জন্য এত এত বই প্রকাশিত হচ্ছে, বইগুলো কি শিশুতোষ? এ বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখাও হচ্ছে। কখনও কলাম, কখনও প্রতিবেদন।
বইমেলায় শিশুদের বইয়ের ভুবন একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক।
এবার করোনাকালে অনুষ্ঠিত বইমেলার পরিসর বেড়েছে গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ৫৪০টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৮৩৪টি স্টল। সঙ্গে প্যাভিলিয়ন আছে ৩৩টি। কিছু সরকারি ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় প্রত্যেক প্রকাশনীর স্টলে শিশুদের বই আছে। অর্থাৎ বইমেলায় শিশুদের বইয়ের কমতি নেই। তার ওপর রয়েছে শিশু চত্বর। সেখানে স্টল রয়েছে ৯৭টি। ওখানে সবই শিশুদের বই। তার মানে বইমেলায় শিশুদের বইয়ের প্রাচুর্য অনেক। যদিও সব বই তালিকাভুক্ত হয় না। এই তালিকাভুক্ত না হওয়া বইয়ের মধ্যে শিশুদের জন্য প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সব বই কেন তালিকাভুক্ত হয় না। বিষয়টা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
সে যাহোক, শিশুতোষ জন্য প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু বই প্রকাশিত হচ্ছে মেলাকে ঘিরে।
শিশুতোষ বই বলতে একেবারে শিশুদের বই তো আছেই, কিশোর পাঠক উপযোগী বইকেও ধরা হয়। শিশু-কিশোরদের বইয়ের মধ্যে যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি বই পাওয়া যায়, তা হচ্ছে ভূত-পেতনি বিষয়ক বই। তারপর রয়েছে রূপকথা, গোয়েন্দা, কল্পবিজ্ঞান, নীতিকথা ও শিক্ষামূলক, বিজ্ঞান ও মহাকাশ-বিষয়ক, প্রাণিবিষয়ক বই।
বিষয় বৈচিত্র্য কম নয়। তবে বেশিরভাগ শিশু তার নিজের পছন্দে বই কেনে না বা কিনতে পারে না। অভিভাবকরাই মূলত শিশুদের বই নির্বাচন করে দেন। কারণ বই কেনার টাকা দেন অভিভাবক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অভিভাবকরা কী বই বাছাই করছেন?
নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দেয়াটা মানবচরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে অভিভাবক যে বিষয় পছন্দ করেন, তিনি ঠিক সেই বিষয়ের বই পছন্দ করেন তার শিশুর জন্য। আর এই সুযোগটা কাজে লাগান আমাদের শিশুগ্রন্থ প্রকাশকরা। তাদের বেশিরভাগই এমন বই প্রকাশ করেন, যেগুলোর লেখকস্বত্ব নেই। পয়সাঅলা প্রকাশকরা একটু বেশি টাকা খরচ করে জমকালো রঙিন ছবি দিয়ে ওসব বই সাজিয়ে তোলেন। যাতে শিশুরা আকৃষ্ট হয়। অভিভাবকরাও সেসব বইয়ের দিকে বেশি ঝোঁকেন। কারণ?
কারণ নস্টালজিয়া। ছোটবেলায় যেসব বই পড়ে তার বড় হয়েছেন, তারা চান তাদের সন্তানরাও সেসব বই পড়ুক। অথচ দুনিয়া কিন্তু বদলে গেছে অনেক। বড়রা তাদের ছোটবেলায় মোবাইল ফোন পাননি, প্রযুক্তির এত ব্যাপকতা উপভোগ করতে পারেননি। কিন্তু তাদের শিশুরা এসব পাচ্ছে ও উপভোগ করছে। বদলে গেছে জীবনধারা। আগে বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা, পোশাক-আশাক, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মকানুনের এত কড়াকড়ি ছিল না। জিপিএ নিয়ে এত লড়াই ছিল না। অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও ছিল না। কিন্তু বই নির্বাচনের বেলায় অভিভাবকরা সাধারণত এসব বিষয় ভাবেন না। তারা নস্টালজিয়াকেই প্রাধান্য দেন। অথচ ছোটবেলায় তারা বৃষ্টি হলেই মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটতেন। স্কুল পালানো ছিল অ্যাডভেঞ্চার। এ গাছে ও গাছে হানা দিয়ে ফলমূল খাওয়া ছিল আনন্দের বিষয়।
এখনকার শিশুরা কি এসব কিছু পায়? শহুরে শিশুদের কাছে এসব একেবারেই কল্পনা। গ্রামের শিশুরাও এখন এসব থেকে বঞ্চিত। বলা যায় পুরো দেশের শিশুরা এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে, এসব ভাবারও সময় তাদের নেই। করা তো দূরের কথা।
এখনকার অভিভাবকরা আরেকটা বিষয়কে খুব বেশি প্রাধান্য দেন। নীতিকথা ও শিক্ষামূলক গল্প। দুনিয়াজুড়ে নীতিকথামূলক গল্পের অভাব নেই। কাজেই এ ধরনের বইয়েরও অভাব নেই। কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবইতে নীতিকথা, ঘরে-বাইরে সব জায়গায় নীতিকথা শুনতে শুনতে ত্যক্ত-বিরক্ত শিশুরা নীতিকথামূলক বইয়ে কতখানি আগ্রহ পাবে, সেটা কি আমরা ভেবেছি?
তাহলে শিশুদের জন্য বই বাছাই হবে কীভাবে?
আমি এক অভিভাবককে দারুণ এক কৌশলে বই বাছাই করতে দেখেছি তার সন্তানের জন্য। তিনি তার দু’ সন্তান নিয়ে মেলায় এসে বললেন, তোমরা বই বাছাই কর। তোমাদের নোটখাতায় পছন্দের বইয়ের নাম, লেখকের নাম ও প্রকাশনীর নাম লিখে রাখ।
ওরা বাবার কথামতো সেটাই করল। তারপর উনি প্রত্যেকটা স্টলে গিয়ে সন্তানদের বাছাই করা বইগুলো উলটে-পালটে দেখলেন, পড়লেন; এবং তার কাছে যেটা মানসম্মত মনে হয়েছে, তার শিশুর উপযোগী মনে হয়েছে, যেটা পাইরেটেড নয় সেটা কিনে দিলেন।
সন্তানদের জন্য ওই অভিভাবকের বই বাছাই করার প্রক্রিয়াটা দারুণ লেগেছিল।
আর এই বই বাছাই করতে গিয়ে সে অভিভাবক সেদিন অনেক কিছুই টের পেলেন। শিশুদের বইয়ের নামে রীতিমতো অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। একটা বইয়ের নাম দেখলেন ‘গলাকাটা দানো’। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই তার গা গুলিয়ে উঠল। একটা দানোর কাটা মাথা ধরে আছে এক তরবারিঅলা মানুষ। দানোর শরীরবিচ্ছিন্ন মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। বই দেখে তিনি এতটাই চমকে গেলেন যে, বুঝে উঠতে পারলেন না এটা শিশু বা কিশোরদের বই হয় কী করে? আরেকটা বই দেখলেন নামি এক লেখকের। বইয়ের নাম ‘তমুক মামার গার্লফ্রেন্ড’। এটাও শিশুতোষ বই!
এরকম অবাক কিন্তু সব অভিভাবক হন না। কারণ সবাই ঠিক জানেন না, কোনটা তার শিশুর উপযোগী।
বইমেলায় গেলে প্রকাশকরা প্রায়ই বলেন, দিন দিন পাঠক কমে যাচ্ছে।
কথাটা মোটেও ভুল নয়। আগে প্রচুর বইপড়ুয়া চোখে পড়ত। এখন শোনাও যায় না। পাঠকের এত আকাল কেন?
পাঠকের আকালের কথা তুললেই সবাই চোখে আঙুল দিয়ে মোবাইল বা টেকনোলজিকে ইঙ্গিত করে। আসলেই কি তাই? পশ্চিমা বিশ্বে কিন্তু বইপড়ুয়াদের সংখ্যা কমেনি। বরং বেড়েছে। টেকনোলজি তো ওখান থেকেই আমদানি হয়। তাহলে?
আমাদের দেশে বই পড়ুয়ার সংখ্যা কেন কমে যাচ্ছে, মূল জায়গাটায় যাওয়া জরুরি। এর অনেক কারণ আছে। আমরা শিশুদের হাতে যে বই তুলে দেই, সে বই কতখানি সেই শিশুর বয়স, বুদ্ধি ও পড়ার গতির সঙ্গে মানানসই- সেটা না ভেবেই দেই। বিষয়টা এরকম অসুখ করেছে তো যেকোনো ওষুধ খাও।
শিশুদের বই দিতে হয় বয়স অনুযায়ী। তাহলে বইয়ের প্রতি শিশুর আগ্রহ জন্মায়। পড়া ও জানার প্রতি কৌতূহল তৈরি হয়। শিশুদের জন্য যারা বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত, সেটা লেখক কিংবা প্রকাশক-যিনিই হন না কেন, তাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে বইটা কোন বয়সি শিশুদের জন্য? বড়দের বই আর শিশু-কিশোরদের বইয়ে পার্থক্য আছে। বড়দের বইয়ে যেমন শব্দ, বাক্য, কাহিনি- এসবের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু শিশু-কিশোরদের বইয়ে এসব জরুরি বিষয় থাকতে হয়।
একটা বই হাতে নিলেই বোঝা যায়, ওই বইয়ের প্রতি কার যত্ন কতখানি। শিশুদের বইয়ে অতিরিক্ত যত্ন থাকতে হয়। যেমন অতিরিক্ত যত্ন করতে হয় শিশুদের বইয়ের বেলায়। বই হাতে নিয়ে একটু মাথা খাটালেই যেকোনো অভিভাবক বুঝতে পারবেন কোন বইতে যত্ন আছে, কোন বইতে নেই। প্রত্যেকটা শিশুতোষ বইতে যত্নবান থাকতে হয় লেখক, আঁকিয়ে, প্রকাশক-সবাইকে।
শিশুদের বইয়ে বানান ভুল থাকা তো অমার্জনীয় অপরাধ। অথচ ভুল বানানের বইতে মেলা থই থই। তারপর রয়েছে লেখকের যত্নের অভাব। অনেক বিখ্যাত লেখক বড়দের জন্য লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ব্যস, সেই খ্যাতিকে পুঁজি করে ছোটদের জন্য লিখতে শুরু করলেন। প্রকাশকও ওই পুঁজিতেই বই প্রকাশ করলেন। অনেক অভিভাবক ওই খ্যাতির কারণেই খ্যাতিমান লেখকের বই কিনে দিচ্ছেন শিশুকে। কিন্তু বইয়ের মূল পাঠক সে বই থেকে আনন্দ নিতে পারছে না। বইয়ের প্রতি তার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এই অনাগ্রহ থেকে একসময় বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। তাহলে দোষটা কি পাঠকের?
একদিন হুট করে সদ্য কৈশোরে পা দেয়া এক কিশোরকে গালিগালাজ করতে শুনলাম। কিন্তু আমি জানি ও বইপড়ুয়া। তাহলে বইপড়ুয়া কোনো মানুষ তো এমন হওয়ার কথা নয়। ঘটনা কী!
ঘটনা জানা গেল- ওই কিশোর ইদানিং এমন কিছু লেখকের বই পড়েছে, যেগুলোতে গালিগালাজ আছে। ওই বইগুলো শিশু-কিশোরদের জন্যই লেখা।
অনেক সময় এসব বিষয় লেখকের অবচেতন মনে ঢুকে পড়ে। লেখক নিজেও লেখার সময় সতর্ক থাকেন না তিনি আসলে কোন পাঠকদের জন্য লিখছেন। বইমেলার তাড়ায় আর প্রকাশকের চাপে তিনি কেবল লিখেছেন। আর সম্পাদনা? ওরে বাপরে! এত বড় লেখকদের বই সম্পাদনা করার কথা মুখে আনার সাহস আছে কার!
আরেকজন বিখ্যাত লেখক। খুবই জনপ্রিয় কিশোরদের কাছে। কিশোরদের জন্য লেখা তার বইয়ের এক জায়গায় আছে- টেলিভিশন থেকে একটা ভূত বেরিয়ে কিশোরীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
অনেক অভিভাবক শুধু লেখকের নাম দেখেই বই কিনে দেন। লেখা দেখেন না। আর সে কারণেই শিশু-কিশোরদের অনুপযোগী বই ঢুকে পড়ছে মেলায়। চলে যাচ্ছে ঘরে ঘরে।
এরকম আরও অনেক আছে। এসব নিয়ে কেউ ঘাঁটায় না।
আরেক ধরনের বইয়ের দেখা মেলে মেলায়। কাটপেস্ট ধরনের বই। এসব কাটপেস্ট বই বেশিরভাগই শিশু-কিশোরদের জন্য। ওসব বইতে বাক্য, বানান, শব্দ, বিষয়- কিছুই ঠিক থাকে না। ভুল তো পাতায় পাতায়। কেবল প্রচ্ছদটাই থাকে চকচকে। আর তাতেই বিক্রি হয়ে যায় ওসব বই।
আর এসব বই পড়ে পাঠক এক সময় বই-অনুরাগী না হয়ে বই-বিরাগী হতে বাধ্য।
তবে আশার কথা হচ্ছে কিছু প্রকাশক ও লেখক দায়িত্বটা নিয়েছেন। শিশুদের বয়স উপযোগী, চিন্তা-চেতনা উপযোগী ও নির্ভুল বই প্রকাশ করছেন। এদের সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই যাচ্ছে।
এবারের বইমেলা এমনিতেই অনেক ঝক্কির। মেলায় পাঠকের আনাগোনা নেই। শিশুদের জন্য শিশুচত্বর আছে ঠিকই, তবে সেটা নিতান্ত অবহেলায় এমনভাবে করা হয়েছে, শিশুদের বইমেলার প্রতিই আগ্রহ কতখানি জন্মাবে চিন্তার বিষয়।
শিশুদের বইমুখী করতে হলে কিন্তু অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আর শিশুদের বইমুখী করতে না পারলে, জাতি কী করে বইমুখী হবে?
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক।