বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে কিছু কথা

  • মাজহারুল ইসলাম   
  • ২৮ মার্চ, ২০২১ ১৬:০১

একেবারে নিরক্ষর মানুষও পরিবার, সমাজে চলতে বা চালাতে যে স্বাভাবিক বুদ্ধি লাগে তা জানে– অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত লোকের থেকে বেশিই থাকে। এই বুদ্ধিমত্তা আসে জন্মের মাধ্যমে। বুদ্ধিমত্তা যখন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংমিশ্রত হয়, তখন তা জ্ঞানের জন্ম দেয়। অভিজ্ঞতা তার নিজের জীবন-পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা, পড়াশোনার মাধ্যমে বা অন্যের কাছ থেকে আসতে পারে।

সাধারণ মানুষের মুখে অনেক সময় বলতে শোনা যায় - তার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই। যারা একটু আধুনিক তার বলেন– তার মাথায় জ্ঞান-বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। কবি সাহিত্যিকেরা বলেন,‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। এই বাক্য থেকে জ্ঞান আর বুদ্ধি’র মাঝে পার্থক্যটা আসলে কী, তা না বুঝলেও এটা বোঝা যায়, জ্ঞান আর বুদ্ধি’র মধ্যে পার্থক্য যে আছে তা নিশ্চিত।

উনিশ শতকের বিশের দশকে মুসলমানদের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন হয়েছিল। কারণ তখন নাকি মুসলমানরা জ্ঞান-বুদ্ধিতে পিছিয়ে পড়েছিল; কারণ ব্রিটিশরা জেঁকে বসেছিল দেশ পরিচালনার গদিতে।

এর প্রায় একশ’ বছর আগে সমাজ-সংস্কারে জেগে উঠেছিলো উপমহাদেশের হিন্দুরা। তাদের নেতৃত্ব দেন রাজা রামমোহন রায়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে উপমহাদেশের মুসলিমরা। তখনকার সামাজিক-ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অশিক্ষা থেকে রেহাই দেয়া এবং মানুষকে চিন্তার জগতে বিচরণের সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে মুসলিম সাহিত্য সমাজের ‘শিখা’ পত্রিকায় জ্ঞান বিষয়ে নানাকথা লেখা থাকত তাদের পত্রিকাটির সম্পাদকের নামের পরেই।

‘জ্ঞানই শক্তি’ নামে একটা শক্তির কথা আমরা তখন থেকেই জেনেছি যখন আমাদের কোনো শক্তিই ছিল না। এই শক্তির কথা নাকি প্রথম বলেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস বেকন যিনি একজন ইংরেজ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, কূটনীতিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক– যদিও বলা হয় বেকনের ইংরেজি বা লাতিন রচনায় এই সুনির্দিষ্ট বাক্যাংশের কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘সায়েন্টিয়া পেন্টিয়েনা এস্ট’ শব্দটি একটি লাতিন আফোরিজম যার অর্থ ‘knowledge is power’; এই শক্তির বলেই হয়তো তিনি আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের প্রবক্তা এবং জ্ঞানান্ধতা ও গোঁড়ামিবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হন।

বুদ্ধি বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। থর্নডাইকের মতে, অনুষঙ্গ বা বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সংযোগ সাধনের ক্ষমতাই বুদ্ধি। স্পিয়ারম্যানের মতে, বুদ্ধি হলো নিজের মনের প্রতিক্রিয়াগুলোকে লক্ষ করার ক্ষমতা, জ্ঞানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্বন্ধ আবিষ্কারের ক্ষমতা। বুদ্ধি মানুষ জন্মগতভাবেই লাভ করে। জ্ঞান পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকে অর্জন করতে হয়। জন্মের পরই শিশু খাবার খেতে হবে সে জানে, মায়ের স্তনের কাছে নিলেই সে বোঝে এখানে তার খাদ্য আছে, ক্ষুধা পেলে কান্না করতে হবে সে জানে– এগুলো তার বুদ্ধি জন্মগতভাবেই পেয়েছে। এমনকি অন্য প্রাণীর মধ্যেও বুদ্ধি আছে – বাঘ জানে শিকার করতে কোথায় কামড়ে ধরলে তার জন্য সহজ হবে, আত্মরক্ষা কীভাবে করতে হবে সেটা সব প্রাণীই বোঝে, আত্মরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে চলতে হবে সেটা বন্য প্রাণীরাও জানে– এটা জন্মগতভাবে সব প্রাণীরই থাকে– কম বা বেশি। এটাকে আরবিতে ‘আক্বল’ বলে, আমরা আক্কেল-বুদ্ধি বলি।

একেবারে নিরক্ষর মানুষও পরিবার, সমাজে চলতে বা চালাতে যে স্বাভাবিক বুদ্ধি লাগে তা জানে– অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত লোকের থেকে বেশিই থাকে। এই বুদ্ধিমত্তা আসে জন্মের মাধ্যমে। বুদ্ধিমত্তা যখন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংমিশ্রত হয়, তখন তা জ্ঞানের জন্ম দেয়। অভিজ্ঞতা তার নিজের জীবন-পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা, পড়াশোনার মাধ্যমে বা অন্যের কাছ থেকে আসতে পারে। কোরআন মাজিদ অবতীর্ণ হওয়ার শুরুতেই জ্ঞানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ‘পড় (হে নবী), তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন… মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানত না’ (সুরা আল-আলাক ১-৫)। সুরা যুমার ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(হে নবী!) বলুন, যারা মূর্খ ও যারা বিদ্বান তারা কি সমান?

বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।

জ্ঞান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিশেষ নিয়ামত– যা অন্য প্রাণী থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। জ্ঞানীরা বলেন- এটা যত বণ্টন করা যায়, তত বাড়ে। চুরি হয় না, কেউ ছিনতাই করতেও পারে না, ছেড়ে যায় না কখনও, মৃত্যু পর্যন্ত এটা সঙ্গী থাকে।

পবিত্র কোরআনে ‘জ্ঞান’ এবং ‘হিকমত’ (প্রজ্ঞা) উভয়ের অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া যায়। গভীর জ্ঞান ও যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে মহাসত্যকে উপলব্ধি করার নাম হচ্ছে হিকমত। যাবতীয় বিষয়বস্তুকে সঠিক জ্ঞান দ্বারা জানাকে হিকমাত বলে। সংক্ষেপে প্রজ্ঞা, মনীষা, বুদ্ধিমত্তা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, অন্বেষা, বহুদর্শিতা ইত্যাদিকেও হিকমাতের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কোনো ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে বা সহজেই কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারে। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সেই একই ঘটনার বিভিন্ন দিক দেখতে পারেন, এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারেন। অর্জিত জ্ঞান সঠিকভাবে কাজে লাগানোর বিশেষ জ্ঞানকে প্রজ্ঞা বলে। সহজে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- তরকারি রান্না করতে কী কী উপাদান লাগে তা জানা হলো জ্ঞান; আর কোন উপাদান কী পরিমাণে লাগে তা জানা প্রজ্ঞা। জীবনে চলতে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা উভয়েই প্রয়োজন। যাদের মধ্যে দুটিই আছে তারাই সেরা মানুষ হয়, বেঁচে থাকে মরার পরেও।

আল্লাহ নবীদেরকে হিকমত বা প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। যেমন, সুরা লোকমানের ১২ নং আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেন, “এবং আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসুল প্রেরণ করুন, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদের কিতাব ও ‘হিকমাত’ শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (সুরা বাক্বারাহ ১২৯)। এই আয়াতে কারীমায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর দোয়াকে তুলে ধরা হয়েছে। কাবাগৃহ নির্মাণের পর তিনি এই দোয়া করেছিলেন।

সুরা আল ইমরানের ৪৮ নং আয়াতে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তিনি তাকে (ঈসা আঃ) কিতাব, হিকমত - তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিবেন। দাউদ (আঃ)কেও হিকমত দান করা হয়েছিল- “... পরে আল্লাহ দাউদ (আঃ) কে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন এবং তাকে যা চাইলেন তাই শেখালেন…। (সুরা বাক্বারাহ ২৫১)।

জ্ঞান এবং হিকমত সবাইকে সমান হারে দেয়া হয় না। আল্লাহ যাকে খুশি তাকে বেশি দান করেন। সুরা আল বাক্বারাহ’র ২৬৯ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞানদান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞানদান করা হয়…”।

লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর