এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত সত্য যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল লক্ষ্য। সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পঞ্চাশের দশকেই ৬ দফার মতো কর্মসূচি দেয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব বাংলার অসহায়ত্ব সেই সুযোগ করে দেয়। ৬ দফা দেয়ার পর শেখ মুজিব বলেছিলেন ওপারে (স্বাধীনতা) যাওয়ার জন্য সাঁকো দিলাম মাত্র। বাংলাদেশের নামকরণ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা সবকিছু তিনিই নির্ধারণ করে দেন। স্বাধীনতার জন্যই যে তিনি জাতির সামনে ৬ দফা পেশ করেছিলেন, এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ৬ দফার সংগ্রামে রাজপথে নেতৃত্বদানকারী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক ‘রাজনীতির তিন কাল’ গ্রন্থে (৮৭ পৃষ্ঠা) এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।
৬ দফা সংগ্রাম চলাকালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা আপস করার লক্ষ্যে আইয়ুব খানের পুত্র গওহর আইয়ুব ও প্রখ্যাত সাংবাদিক জেড এ সুলেরি সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ঢাকায় আসেন। তারা ঢাকায় বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেন। গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে কারাগারে থেকেই খন্দকার মোশতাক আপসরফার একটা খসড়া তৈরি করেন। খসড়াটির ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর মতামত নেয়ার জন্য জেলে অন্তরীণ মিজান চৌধুরী ও শাহ মোয়াজ্জেমকে দায়িত্ব দেয়া হয়। অনেক কৌশল করে একদিন দুপুরের নির্জন মধ্যাহ্নে এই দুই নেতা ঢাকা জেলে নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। খসড়াটি (যা দুই নেতার জন্য দেখা নিষিদ্ধ ছিল) তারা নেতার হাতে দিলে বঙ্গবন্ধু মনোযোগের সঙ্গে সেটা পাঠ করে বলেছিলেন- ‘এ ধরনের আপস করলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দূরের কথা ৬ দফাও আদায় হবে না।’ মিজান চৌধুরী (প্রয়াত) তার গ্রন্থে লিখেছেন-
‘আজ বঙ্গবন্ধু নেই। আমি আর শাহ মোয়াজ্জেম ছাড়া সে ঘটনার আর কোনো সাক্ষীও নেই। এখানেই মুজিব ভাইয়ের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির উজ্জ্বল প্রমাণ।’
১৯৭০ সালে ঢাকাস্থ মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডকে শেখ মুজিব বলেন, ‘I will proclaim independence and call for guerilla action if the army tries to stop me.’ অর্থাৎ সামরিক বাহিনী যদি আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেরিলাযুদ্ধের ডাক দেব।’
১৯৬৯-এর ৭ নভেম্বর পাকিস্তানে আমেরিকান দূতাবাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মুজিব প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাট।’ মার্কিন অবমুক্ত গোপন দলিলে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই মুজিবের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা পায় যে, তার দাবি পূরণ না হলে তিনি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং সে ক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামকে তার কালজয়ী নেতৃত্বে ১৯৭১-এর মার্চে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে আসেন। তিনি পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন যে, ওই সময় তারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যান। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং গুল হাসান তাদের গ্রন্থে লিখেছেন, মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয় এবং ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পরই পূর্ব পাকিস্তান বলতে গেলে স্বাধীন হয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাতে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এর বর্ণনাও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার গ্রন্থে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঝন্টু নামের এক যুবক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। যুবকের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওর কথাইতো আমি ভাবছি।’ যুবক বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মুজিব ভাই, আর্মি আপনাকে মারতে আসছে। আপনি এক্ষুনি বাসা থেকে চলে যান।’ যুবকের কাছে আর্মির হত্যা পরিকল্পনার কথা শুনে ড. ওয়াজেদকে শেখ হাসিনা, রেহানা ও জেলীকে নিয়ে তখনই ভাড়া ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু এ সময় বললেন, আমার এখন অন্যত্র চলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তারা আমাকে মারতে চাইলে এ বাসাতেই মারতে হবে।
বাঙালি জাতির সৌভাগ্য শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন অসাধারণ নেতা পেয়েছিল। সাহস-শৌর্য-বীর্য-দূরদর্শিতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেমে যার কোনো তুলনা হয় না। পাকিস্তানের ২৩ বছরে বহুবার তিনি জেলে গেছেন। আজকের দিনের রাজনীতিকদের মতো তিনি পালিয়ে বেড়ানোর রাজনীতি করতেন না। সত্যিকার অর্থেই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন শেখ মুজিব। বাংলার মানুষ ভালোবেসে তাকে উপাধি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক পেগি ডারডিন মার্চের সেই উন্মাতাল দিনগুলোর বর্ণনায় লিখেছেন-
‘একজন রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশাবলি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছে। এই নির্দেশাবালি প্রয়োগের জন্য এই নেতার কোনো বাহিনী বা প্রশাসন ছিল না। এই স্বতঃস্ফূর্ত নির্দেশ মানার পেছনে ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বাঙালি জাতি ও নেতার মধ্যে একটি অলিখিত অথচ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠার অঙ্গীকার।’ (সোহরাব হাসানের ‘মুজিব-ভুট্টো-মুক্তিযুদ্ধ’, পৃষ্ঠা ১৭৫)
৮ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে : ‘মনে হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’
১৫ মার্চ ১৯৭১ বিখ্যাত ‘টাইম’ সাময়িকী লিখেছে, ‘আসন্ন বিভক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন, তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিব। গত সপ্তাহে ঢাকায় টাইম-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে মুজিব বলেন, “পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনো আশা নেই।”’
৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের আলোচনা টিমের অন্যতম সদস্য অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান যথার্থই বলেছেন-
‘আমার ধারণায় ১৯৭১ সালের পয়লা থেকে ২৫ মার্চ এই পঁচিশ দিনই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে, কখন স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল বা কে তা ঘোষণা করেছিলেন এই প্রশ্নটি অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতা অগ্রাহ্য করার যে মূঢ়তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে গ্রাস করেছে এটা তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত। মার্চ-জুড়ে বঙ্গবন্ধু যা এবং যতটা সাধন করেছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনো ইতিহাসে অন্য কোনো নেতাই সে রকমটি করতে পারেননি। ইডেন বিল্ডিং (সরকারের সচিবালয়) পরিণত হয়েছে এক অপহৃত অসাড় সমাধিতে- সেখানে শেখ মুজিবের বাসভবন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে প্রশাসনে জেগে উঠেছে এক প্রাণচাঞ্চল্যে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও বলেছেন একই কথা। ৭ মার্চের ভাষণের পর রাতে ৩২ নম্বরের বাসভবনে সিঁড়িতে বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। এখন জনগণের কাজ স্বাধীনতাকে রক্ষা করা।’ আসলে ১ মার্চের পরই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হয়ে যায়। ৯ মাসের যুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে বাঙালি জাতি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। শেখ মুজিবের অমর কীর্তি স্বাধীন বাংলাদেশ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক