ভারতের সঙ্গে এ ভূখণ্ডের মানুষের রয়েছে এক ঐতিহাসিক আত্মার সম্পর্ক। প্রায় ১৯০ বছর আমাদের পূর্বসূরিরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, জীবন দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের ইতিহাসের, ভাষার, সংস্কৃতির, মন-মানসিকতার গভীর সমন্বয়। বেশিদিন আগের কথা নয়, আমদের বাপ-দাদারাইতো ভারতীয় ছিলেন। আর আমাদের পূর্বসূরিদের লড়াইটা ছিল অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য। অশুভ রাজনীতি আমদের ১৯৪৭-এ ভাগ করে দিয়েছে। সীমানা দিলেই কি সব কিছু আলাদা হয়ে যায়? ইতিহাস-সম্পর্ক কি ভাগ করা যায়, না আলাদা করা যায়? অখণ্ড ভারতের অধিকাংশ মানুষ দেশভাগ চায়নি, তারা চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা। দেশভাগের নির্মম অভিজ্ঞতা, ভাই থেকে ভাইকে আলাদা করার কষ্ট-যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়ায় ভারতবাসী। পাকিস্তানের স্বপ্ন ভাঙতে আমদের ৭ মাসও লাগেনি। আবার লড়াই-সংগ্রাম, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা অবশেষে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ভাই দাঁড়িয়েছে ভাইয়ের পাশে, বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুর সহযোগিতার হাত।
সর্ববৃহৎ সহযোগিতার ইতিহাস আমাদের গৌরবের একাত্তর। ভারত খুলে দিয়েছে অকাতরে হৃদয়ের সকল অলিন্দ, শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমদের স্বাধীনতার জন্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি নরপশু সেনাবাহিনী। মানুষ প্রাণের ভয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়। তৎকালীন ইন্দিরা সরকার মানবিক কারনে সীমান্ত খুলে দেয়। প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় যাদের খাদ্য, নিরাপত্তা,চিকিতসার ব্যবস্থাও করে ভারত সরকার। ইন্দিরা সরকার দেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনার সুযোগ করে দেয় এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি খেতে হয়েছে। তিনি জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য। ব্যবস্থা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের, সহযোগিতা করেছেন অস্ত্র সাহায্য দিয়ে।
অবশেষে ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে এবং গঠন করে যৌথ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। আমদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ভারতের সহযোগিতায়। আমাদের স্বাধীনতার জন্য শহিদ হন ভারতের প্রায় ১৫,০০০ সেনাসদস্য। ভারতের জনগণের সহযোগিতা কোনো দিন ভুলবার নয়। ভারতের সহযোগিতা ছাড়া আমদের স্বাধীনতা অর্জন সহজ হতো না– এটা বাংলাদেশের মানুষ সকল সময় স্মরণ করে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আবেগ ও আদর্শিক অবস্থানের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ভারত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে নিতে দেরি করেনি। বিনিময়ে বাংলাদেশও তার প্রতিদান দিতে কার্পণ্য দেখায়নি।
১৯৭৪-এর ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বলা হয়েছে- ‘এই চুক্তিটি দুই দেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আন্তরিক মনোভাব ও পারস্পরিক বিশ্বাস, আর সবার উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- এ মহান দুজন রাষ্ট্রনায়কের শান্তি ও সম্প্রীতির অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক’। এই চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার স্থল-সীমানা নির্ধারণ সম্পন্ন করা।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য সাফল্য সূচিত হয় দীর্ঘকাল অমীমাংসিত গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথবাক্য পাঠের অনুষ্ঠানে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশে তার প্রথম আন্তর্জাতিক সফর করেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভিসা, বিদ্যুৎ, মৈত্রী এক্সপ্রেস, বাস চলালচলসহ ৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তিতে ২০০ কোটি টাকার ঋণ-বিষয়ক সমঝোতা, ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণা, ৩ হাজার মেগাওয়াটের এলএনজি-ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র স্থাপনে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ, ১৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ রয়েছে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সহযোগিতা, মানব পাচার ও জাল মুদ্রা রোধ। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে।
২০১৮ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ উদ্বোধন করেন যার মাধ্যমে ভারত থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে হাসিনা-মোদির বৈঠকে ৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় এবং ৩টি প্রকল্প উদ্বোধন হয়।
২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে ভারতের সঙ্গে ৭ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ ৭টি বিষয়ে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। সেদিন ভার্চুয়াল বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন ভারতের জনগণ যখন ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশের জনগণও তখন ভ্যাকসিন পাবে। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ জানুয়ারিতেই ভ্যাকসিন পায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারতের সেরাম ইন্সিটিউটের প্রস্তুত করা অক্সফোর্ড-আস্ত্রাজেনিকার ২০ লাখ ডোজ উপহারসহ ৯০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর আরও ১২ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে পাবে।
২৬ ডিসেম্বর মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় এসেছেন। এ সফর দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে এক নতুন অধ্যায়। এটি সহযোগিতার এক মাইলফলক, যা অন্য সব দেশের জন্য অনুকরণীয়– এ কথা বলেছেন গত বুধবার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সন্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন তিস্তা নদীর এই দুই সরকারের আমলে হয়ে যাবে বলে নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর বাংলাদেশের মানুষের আস্থা আছে। আমরা আশা করি অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
গত ২২ মার্চ ভারত সরকার বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা করে ্টবেং তা ২৬ মার্চ বঙ্গগবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার হাতে তুলে দেন নরেন্দ্র মোদী। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা েঅনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন সম্মানে দেশের মানুষও সন্মান বোধ করছে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার দেয়ায় বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমরা আশা করি এ সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আরও গভীর হবে- তাতে দুই দেশের মানুষই ভালো থাকবে। বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক দুই দেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। কোনো ষড়যন্ত্র বা ভুল বোঝাবুঝি যেন দুই দেশের সম্পর্ক দুর্বল না করতে পারে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়