সেই আদিমকাল থেকেই অভিনয় বা কৃত্যশিল্প আসলে মানুষকে অন্য প্রজাতি থেকে ভিন্নতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যে প্রজাতি বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে গল্প রচনা করেছে, নিজেকে আবিষ্কার করেছে নতুন প্রক্রিয়াতে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে। এরই নান্দনিক প্রতিফলন ঘটেছে কৃত্যশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্র মানুষকে মানুষ হওয়ার গভীর অর্থ অনুধাবনের বোধ যেমন দেয়, তেমনি অন্য মানুষ কেমন বা যাকে এই আধুনিক যুগে ‘অন্যরা’ বলা হচ্ছে তা বুঝতে সাহায্য করে। নিজেকে আবিষ্কার করে বৃহত্তর মানব প্রজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আর এভাবে নিজেক আবিষ্কার করাটা এক গভীর অস্তিত্ববাদী দর্শন। নাটক ঠিক এই অস্তিত্ববাদী দর্শনকেই মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই গুণই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে হাজার বছর ধরে।
কৃত্যশিল্প, যার মধ্যে অন্যতম নৃত্য এবং নাট্য, আসলে মানুষের ভাষাকে দৃশ্যময় করে কারণ প্রত্যেকটি ভাষা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের প্রতীকী-সংশ্রয় বা সাইন-সিসটেম, বিখ্যাত সুইডীয় ভাষাবিদ ফার্ডিনান্ড সসো যার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সিগনিফায়ার-সিগনিফাইড তত্ত্বের মাধ্যমে। আমরা যখন কোনো শব্দ বা শব্দমালা উচ্চারণ করি কিছু বোঝাবার জন্য তখন যে বা যারা সেটা শোনে তার বা তাদের মনের ভেতর ওই শব্দ বা শব্দমালা একটি মানসিক ধারণা বা কনসেপ্ট সৃষ্টি করে যেটি দর্শনেন্দ্রীয় উদ্দীপক মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। যেমন আমি যখন বলি পেয়ারা বা তরমুজ—শব্দটি শোনামাত্র, আমি যদি শ্রোতার কাছে দৃশ্যমানও না হই, শ্রোতার মনে পেয়ারা বা তরমুজের একটি প্রতিরূপ মানসপটে প্রস্তুত হবে। সসো এটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন স্কিমা বা পরিলেখ বলে। তবে এই পরিলেখ সেসব ব্যক্তির মানসপটে সৃষ্টি হবে যাদের ওই ভাষা জানা আছে। এটি বিমূর্ত শব্দাবলির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য তবে সেটি বিমূর্ত পরিলেখ প্রস্তুত করবে, যেমন ভালবাসা, রাগ, প্রশান্তি, উৎফুল্লতা— এসব কিছুরই কৃত্যশিল্পে দৃষ্টিনন্দন প্রকাশভঙ্গী বা অভিব্যক্তি আছে— বিশেষ করে ভরত মুণির নাট্যশাস্ত্রে। সসো পেয়ারা বা তরমুজের ভাষ্যিক উচ্চারণকে সিগনিফায়ার এবং ওই ভাষিক উচ্চারণের দর্শনেন্দ্রীয়-প্রসূত দৃশ্যকে সিগনিফাইড বলেছেন।
মজার ব্যাপার হলো- কৃত্যশিল্প, বিশেষ করে নৃত্য এবং অনেক ক্ষেত্রে নাটকও ভাষাশ্রয়ী হয় না এবং এখানেই মানুষের অন্তর্গত নান্দনিক চেতনার বিশেষত্ব— অর্থাৎ মানুষ এমনই এক প্রাণী যে ভাষার মাধ্যমে এবং ভাষার বাইরে উভয়ভাবেই— যে জিনিসটি অপরাপর প্রাণীর ভেতর আছে বলে এখনও পর্যন্ত জানা নেই— অনেক কিছু অন্যকে অবহিত করতে চায় এবং পারে আর কৃত্যশিল্প বা নাটকের উত্থান সেখান থেকেই তা সে পাশ্চাত্যেই হোক বা প্রাচ্যে, তবে তফাৎ আছে, এবং সেটি সেমিওটিক্স-এ বা ইঙ্গিতে। কারণ বিমূর্ত কিছুকে দৃষ্টিনির্ভরভাবে বা অভিব্যাক্তিতে প্রকাশ করার ভেতর সমাজে সমাজে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে, সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে, এমনকি ভাষাতে ভাষাতে ওই সেমিওটিক্স-এর বা ইঙ্গিতের বৈচিত্র্যের কারণে তারতম্য থাকবেই। কৃত্যশিল্প এই তারতম্য বা বৈষম্যকে তার শিল্পচেতনাতে ধারণ করতে সক্ষম।
মানব ইতিহাস বলে নাটক আসলে মানুষের মৌলিক ক্রিয়াকর্মের অংশ। নাটক সারা বিশ্বের মানবমনস্তত্ত্বকে ধারণ করতে সক্ষম কারণ নাটকের উৎসমূল সারা বিশ্বে একই মানসিকতা প্রসূত। একেশ্বরবাদ, বিজ্ঞান এবং উপযোগবাদের উত্থানের পরও মানুষ, পেইগান বা পৌত্তলিক আচার-আচরণ, পৌরাণিক কাহিনি, রহস্য, প্রহেলিকা, অলৌকিকতা, জাদুবাস্তবতা, গল্পসূত্র, মানব চরিত্রের বৈচিত্র্য, প্রখর কল্পনা শক্তি এবং সর্বোপরি দ্বৈতবাদী কাঙ্ক্ষা যাকে বলা যায় নিজেকে অন্য মানুষরূপে আবিষ্কার করা এবং সময়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে অদ্বৈত হয়ে যাওয়া—এর কোনোটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
নাটকের সংকট
নাটকের যাত্রাপথ এখন আর মসৃণ নয়, যেমনটা ছিল আদিমকালে। আদিমকালে পেইগান রিচুয়াল বা ধর্মীয় আচার-আচরণ দুটি জিনিসে বিশ্বাস করত: পৌরাণিক গাথায় এবং জাদুতে। তখন যে সমাজ রাজনীতি এবং বিজ্ঞান ছিল, সে যে প্রক্রিয়াতেই থাকুক না কেন, তা ওই পৌরাণিক গাথায় এবং জাদুতেই বিশ্লেষিত হতো। ফলে কৃত্যশিল্পের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ছিল না— কৃত্যশিল্প বা অভিনয়, সমাজ-রাজনীতি, বিজ্ঞান, পুরাণ এবং জাদু সব একইসঙ্গে গ্রথিত ছিল। কারণ তখনকার বিশ্বাস ছিল যে, রিচুয়াল বা আচার-আচরণ জ্ঞান আহরণ, নীতিশিক্ষা, প্রভাব বিস্তার, মহিমান্বিত হওয়া এবং বিনোদিত হওয়া ও বিনোদন দেয়ার মাধ্যম। তখনকার সকল আচার-আচরণকেই পৌত্তলিক ধর্মের অন্তর্গত কৃত্য বলে ধরা হতো। সময়ে মানুষ তার নিজের শক্তির উপরে গভীর আস্থাবান হয়ে ওঠে যার অন্যতম কারণ বিজ্ঞানের উন্নতি এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে জাদুবাস্তবতার প্রায় সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যুক্ত হয় চার প্রকাশিত ধর্মবিশ্বাস (রিভিল্ড রিলিজিওন) যার সঙ্গে পুরানো বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের ক্ষমতায়নে বাধে এক টানাপোড়ন। মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে, নতুন মেরুপ্রবণতার জন্ম হয়। ফলে নাটককে দুটি প্রধান মেরুকরণের জাঁতাকলের পেষণে পড়তে হয়—ধর্ম ও রাজনীতি।
যদিও বলা হয়ে থাকে আধুনিক উপনিবেশবাদের শুরু পনেরো শতাব্দীতে, উপনিবেশবাদ তার অনেক আগে থেকেই অন্যরূপে বিরাজমান ছিল। উপনিবেশবাদের চরম বিকাশ— যে উপনিবেশবাদকে আমরাও প্রত্যক্ষ করেছি— আসলে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কারণে ওই পনেরো শতাব্দীতে যে সময়টাকে চিহ্নিত করা হয় আবিষ্কারের যুগ হিসেবে। আমরা তো জানি নাটকের ওপর বাধানিষেধ সবচাইতে বেশি অরোপিত হয়েছে উপনিবেশিক যুগেই যার ভার উত্তরাধিকারসূত্রে ভারতবর্ষ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশকেও বইতে হয়েছে— বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ আমরা এই কালাকানুন থেকে এখন অব্যাহতি পেয়েছি।
আসলে সরকার এবং নাটকের একটি যোগসূত্র আছে আর সেটি হলো দুটোই ক্ষমতার উপাদানে সমৃদ্ধ—যার উদাহরণ মেলে উপনিবেশ যুগে নীল দর্পণ নাটকের প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ইংরেজদের অপছন্দ করা, এবং পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সামরিকশাসন যুগে একাধিক নাটক প্রদর্শন নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে। ক্ষমতার
উপাদানে সমৃদ্ধ দুটি প্রতিষ্ঠানে বিরোধ বাধাটাই স্বাভাবিক।
যদিও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় উপনিবেশ যুগেই নাটকের ওপর এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ঔপনিবেশকরা মূলত খড়্গহস্ত ছিল, তারা তাদের নিজ নিজ দেশেও নাটকের ব্যাপারে অনেক সময়ই তেমন উদারতা দেখাতে পারেনি। যেমন জানা যায়, যুক্তরাজ্যে সতেরো শতাব্দীতে এলিজাবেথীয় এবং জ্যাকেবীয় যুগে রাজনৈতিক অসন্তোষের আশঙ্কায় নাট্যশালাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়- জানা যায়, ইউরোপের একাধিক দেশে নাটকের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক বাধানিষেধ বলবৎ ছিল বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ে ফাসিস্ত ইতালিতে, জাপানে এবং জার্মানিতে নাটক করার ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ হয়েছে।
১৯৩৪ সালে তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক শিল্পীদের ওপর সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নিয়মশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেয় যার অন্যতম ভুক্তভোগী নাট্যচর্চা। ১৯৩৫ সালে ব্রেখট, যদিও বিশ্বাসে সমাজতান্ত্রিকই ছিলেন, বিষয়টাকে ব্যঙ্গ করে একটা কবিতা লিখেছিলেন: এক নাট্যকারের কাছে চিঠি ( লেটার টু দ্য প্লেরাইট) যেখানে তিনি বাস্তবতাকে স্বীকার করে বলছেন: কমরেড, আপনার প্যারাডাইস লস্ট নাটকের শেষ দৃশ্যে/আপনি দেখিয়েছেন শোষক পরিবার/সমূলে ধ্বংস হয়েছে।/কিন্তু এ দিয়ে কী বোঝাতে চান আপনি? যদিও মাক্সিম গোর্কি স্বয়ং এই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার প্রবক্তা ছিলেন পরবর্তীকালে তিনি তার বিরোধিতা করে শাস্তিভোগ করেছেন সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হয়ে।
যুক্তরাজ্যে অলিভার ক্রমওয়েল, একজন পিউরিটান সেনাপ্রধান, ক্ষমতা দখল করেছিল তখনকার রাজা প্রথম চার্লসকে হত্যা করে ১৬৫৩ সালে। ক্রমওয়েল ক্ষমতায় ছিল পাঁচ বছর যে পাঁচ বছর যুক্তরাজ্য শাসিত হয়েছিল কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে এবং নাটকের বিরুদ্ধে ক্রমওয়েল এবং তার অনুসারীদের অবস্থান রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উভয় কারণেই ছিল।
পিউরিটান পরিচালিত পার্লামেন্ট লন্ডন থিয়েটার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছিল মঞ্চনাটককে কামোদ্দীপক উল্লাস এবং লঘু বিনোদনের স্থানরূপে চিহ্নিত করে। এর অবসান হয়েছিল ১৬৬০ সালে রাজশাসন পুনঃস্থাপনের পর যদিও ধর্মীয় গোঁড়ামি নাটকের বিরোধিতা সব সময়ই করে এসেছে— প্রমাণ আছে সেক্সপীয়রের যুগে চার্চের পুরোহিতরা গ্লোব থিয়েটারের সামনে নাটকবিরোধী চিরকুট বিতরণ করত। আমরা এও জানি পনেরো ও ষোলো শতাব্দীতে যুক্তরাজ্যে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে খ্রিস্টীয় গোঁড়ামির কারণে নাটক নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বাড়াবাড়ির কারণে চার্চ অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়লে চার্চের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির উপায় হিসেবে পর্যায়ক্রমে মিরাকল এবং মোরালিটি প্লে নামে দুই ধরনর নাট্যাভিনয়ের প্রচলন করা হয়েছিল চার্চ কর্তৃপক্ষ থেকেই। মানুষের শোণিতে যে নাটকের স্পন্দন সেই আদি থেকেই ছিল তার প্রমাণ এই মিরাকল এবং মোরালিটি প্লে— অলৌকিক নাট্য এবং নীতিনাট্য।
মিশর ছাড়া— কারণ মিশরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইসলাম-পূর্ব যুগের— আরব দেশে নাট্যাভিনয়ের উত্থান বিলম্বিত হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ ধর্মীয়। আরও একাটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। যেহেতু আরব দেশ যাযাবর আচরণের দেশ সেখানে ইসলাম আসার আগে পেইগান আচার-আচরনের তেমন কোনো প্রচলন ছিল না যেমনটা ছিল ভারতবর্ষে এবং গ্রিসে।
ইসলাম আসার অনেক পরে (কারণ ইসলাম ভূমিকা-অভিনয় বা ইম্পারসনেশনে বিশ্বাস করে না—অবশ্য একেশ্বরবাদী কোনো ধর্মই করে না) আধুনিক যুগে আরব দেশে নাট্যচর্চার পত্তন। ফলে সেখানে কৃত্যশিল্পের ঐতিহ্য ঐতিহাসিকভাবে প্রস্তুত হয়নি। ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন সেভাবে নাটকের বিরুদ্ধে প্রকট না হওয়ার পেছনে আমি মনে করি
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব। তবে মানতেই হবে বর্তমান সময়ে এই ধর্মনিরপেক্ষতার মনোভাবের সন্ধিক্ষণ চলছে। বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতার আলামত আছে তার সবচাইতে বড় এবং প্রথম প্রমাণ অমরা পেয়েছি রমনা বটমূলের জঙ্গি হামলার মাধ্যমে। যারা শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা করেন তারা জানেন নাটক প্রদর্শনীতে দর্শকের অপ্রতুলতা দিন দিন চিন্তনীয়ভাবে বেড়েই চলেছে। ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা এখন অশনিসংকেতের মতো ঊর্ধ্বমুখী এবং সেটা গ্রাম থেকেই শুরু হওয়াতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে কারণ আমাদের সব সংস্কৃতির আধার লোকজ ধর্মনিরেপেক্ষভিত্তিক।
নাটকের শত্রু শুধু রাজনীতি বা ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়। নাটকের আরও দুটি বড় শত্রু হলো যুদ্ধ এবং মহামারি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারা বিশ্বেই নাট্যচর্চাকে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাহত করেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে নাট্যচর্চা এবং মহামারি বারংবার অস্বস্তিকর মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
নাটক চারিত্রিকভাবেই একটি সামাজিক সমাবেশের অনুষ্ঠান, বিচ্ছিন্নতার নয়, অপরদিকে মহামারি বা অতিমারি সামাজিক সমাবেশের কারণেই দ্রুত সংক্রামিত হয় ফলে তার দমনে প্রয়োজন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
নাটকের ইতিহাস বলে মহামারি বা অতিমারি আক্রমণে বিশ্বে বহুবারই নাট্যগৃহগুলো বন্ধ থেকেছে। প্লেগ, ১৬০৩ থেকে ১৬১২ পর্যন্ত সর্বমোট ৭৮ মাস নাট্যচর্চা বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছিল ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মহামারি কখনই সৃষ্টিধর্মী মনকে ভীত করতে পারেনি।
সফোক্লিসের যুগেও মাহামারির কথা আমরা পড়ি তার ইডিপাস নাটকে। সেক্সপীয়র মহামারির কথা বলেছেন তার একাধিক নাটকে: টেম্পেস্ট-এ, টুয়েলফথ নাইট-এ, ম্যাকবেথ-এ এবং কোয়ারেনটিনের কথা বলেছেন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ। যতদূর জানি ড্যানিয়েল ডেফো তার জার্নাল অব দ্য প্লেগ লিখেছিলেন লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালের গ্রেট প্লেগ নিয়ে। আর আমরা তো এ-ও জানি ১৯৪৮ সালে আলবেয়ার কামু প্লেগ নামে এক উপন্যাস লিখে অমর হয়ে আছেন যার নাট্যরূপ দিয়ে যুক্তরাজ্যের মঞ্চে এনেছিলেন নীল বার্টলেট ২০১৬ সালে।
১৭৭০-৭২ সালে রাশান প্লেগ লম্বা সময়ের জন্য মস্কো থিয়েটার বন্ধ করে দেয়। ১৭৯৩ সালে ইয়োলো ফিভারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে, ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর জন্য মিশিগান শহরের নাট্যগৃহগুলো বন্ধ থেকেছে। ২০০৩ সালে বেইজিংয়ে নাটক বন্ধ ছিলসারস মহামারির জন্য।
২০২০ সাল, অনন্য সাল, যার তুলনা সে নিজেই। এই সালে যে মহামারি বা অতিমারির সঙ্গে বিশ্বের মানুষের পরিচয় হয়েছে তা এযাবৎকালে নজিরবিহীন। প্লেগ, ইয়োলো ফিভার, স্প্যানিশ ফ্লু, ইবোলা, এবং সারস, এর কোনোটাই পৃথিবীর সবগুলো দেশকে একাধারে আক্রান্ত করতে পারেনি যা করেছে কোভিড-১৯। আমরা এই উপমহাদেশে প্লেগ মহামারি নিয়ে কখনই উদ্বিগ্ন হইনি। কিন্তু কোভিড-১৯ বিশ্বের কোনো সীমারেখার তোয়াক্কা না করে প্রতিটি দেশকে প্রায় সমভাবে আতঙ্কিত করেছে। ফলে নাটকই তার সবচাইতে বড় জীবন্ত বলি হয়েছে। পৃথিবীর সব মঞ্চনাট্যপ্রেমিক, মঞ্চাভিনেতা, মঞ্চনির্দেশক, মঞ্চকলাকুশলী, নাট্যলেখক, এবং মঞ্চনাট্যদর্শক দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি অভূতপুর্ব হতাশা ও নৈরাশ্যে সময় কাটাচ্ছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে নাট্যগৃহ আপাতত বন্ধ।
অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে বিকল্প কোনো নাট্যমাধ্যমের কথা—এই বাংলাদেশেও, যেখানে মঞ্চনাটক এখনও মূলত সৌখিনই রয়ে গেছে, পেশাদারত্বে পৌঁছায়নি, সেখানেও অনেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে ঝোঁকার কথা ভাবছে— ভাবছে নতুন স্বাভাবিকের যুগে কৃত্যশিল্প এমনটাই হয়ে যাবে। তবে সম্প্রতি সীমিত আকারে মঞ্চ দর্শকের উপস্থিতিতে মঞ্চাভিনয় শুরু হয়েছে যা দেখে একথা স্পষ্ট হয় বটে যে, মঞ্চ নাটক আমাদের অন্তর্গত গভীর, গভীরতর আসুখ যে অসুখ কোভিড-১৯-এর চাইতে অনেক তীব্র, এবং যাকে কোভিড-১৯ কখনই হার মানাতে পারবে না। এই অসুখ আমরা প্রজন্ম পরম্পরায় পেয়েছি আমাদের সেই পৌরাণিক ও লোকজ আচার-আচরণ এবং জাদুবাস্তবতার উত্তরাধিকারসূত্রে। এ থেকে আমরা যেমন পরিত্রাণ পাব না তেমনি, আমি মনে করি, কোভিডের কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তি-প্রবণতাও সময়ে সরাসরি (লাইভ) মঞ্চাভিনয়ের কাছে পরাভূত হবে—অবশ্য একথাও ঠিক ডিজিটাল প্রযুক্তি সরাসরি মঞ্চাভিনয়ের সহায়ক ও পরিপূরক হিসেবেই কাজ করবে যেমন অপরাপর প্রযুক্তি এ যাবৎ করে এসেছে।
নাটকের অবিনশ্বরতা
নাটক মানুষের সঙ্গে জন্মেছে মানুষের সঙ্গেই ধ্বংস হবে— অর্থাৎ নাটকের নশ্বরতা মানুষের নশ্বরতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত। জীবন্ত দর্শকের উপস্থিতিতে জীবন্ত অভিনয় মানব প্রজন্মের মৌলিক উপজ্ঞা কারণ এভাবেই দর্শক এবং অভিনয়কারীর ভেতর এক অনবদ্য মিথস্ক্রিয়া যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুত হয়ে এসেছে যা সম্পূর্ণভাবে মননির্ভর এবং যা ডিজিটাল মাধ্যম কখনই সৃষ্টি করতে পারবে না।
নাটক দেখার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটি একটি অতি পুরাতন মানব স্বভাব কিন্তু আবর্তমানভাবে নতুন। সবাইকে ২০২১ সালের বিশ্ব নাট্য দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, নাট্যসমালোচক, শিক্ষাবিদ ।