স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই আন্দোলনের দিনগুলো, মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো আবার বিজয়ের সেই উচ্ছ্বাসভরা দিনগুলো এখনও ষাটোর্ধ সকল বাঙালির চোখের সামনে ভাসে। মনে হয়, এই তো সেদিন। এর ভেতর নিজের বয়স বেড়ে গেছে, তা শরীর বলে দেয়। কিন্তু দেশের বয়স হয়েছে তা কখনই মনে হয় না। বাস্তবে দেশের বয়স বোঝার তো কোনো পথ নেই। দেশ চির নতুন, চিরকালের। দেশের বয়স বুঝতে হলে কেবল হিসাব করা যেতে পারে কতটা এগুলো দেশ। যে সংগ্রামী চেতনা, যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, যে চেতনায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সেই চেতনায় যদি ধারাবাহিকভাবে দেশ এগুতে পারত, তাহলে এই পঞ্চাশ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত।
কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন মূলত সূর্যের মতো। তাকে ঘিরে বড় ও ছোট আকারের অনেক গ্রহ ও উপগ্রহ মিলে তৈরি হয়েছিল মুজিবসৌরমণ্ডল বা মুজিবমণ্ডল। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের মতো নেতারা ছিলেন। আবার ছাত্র যুব নেতাদের ভেতর ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুস কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহাজাহান সিরাজ প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এরা একেক সময় একেক জন জোতিষ্ক হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের পরে ছয় দফার আন্দোলনের তরুণ যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি উজ্জ্বল আলোয় আসেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের ভেতর দিয়ে ছাত্রনেতা থেকে এক প্রকার জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন তোফায়েল আহমেদ। আবার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ জারি ও তা মনিটরিংয়ের ভেতর দিয়ে সামনে চলে আসেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে তিনি মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীখ্যাত হন শেখ মুজিবুর রহমানের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে, যেমনটি মাওয়ের সঙ্গে চৌ এন লাই, লেনিনের সঙ্গে স্ট্যালিন। আবার মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাঙালির বীর যোদ্ধা হিসেবে বের হন মুজিবের যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বা টাইগার সিদ্দিকী।
বঙ্গবন্ধু তার আদর্শ এবং তার কাজের ধারা প্রবাহিত করেছিলেন তার এই নিজস্ব সৌরমণ্ডলীর ভেতর। এবং এই সৌরমণ্ডলী বা মুজিবমণ্ডলী নিয়েই তার এগিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু শুরুতে বাদ সাধেন সিরাজুল আলম খান। তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট তরুণ নেতৃত্বে ভাঙ্গণ ধরে স্বাধীনতার পর পরই। সৃষ্টি হয় তাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল, যার সভাপতি হন সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় অসততার দায়ে যুদ্ধ থেকে উইথড্র হওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য মেজর জলিল। মুজিবমণ্ডলীতে এই ভাঙ্গণে তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি – তারা একটা রাজনৈতিক শেল্টার পায়। এর পরে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীর যে চরিত্র হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। বরং তাদের অনেকে এবং পাকিস্তান ফেরত সৈন্যরা মিলে পাকিস্তানি ধারা ভেতরে ভেতরে বজায় রাখে। বঙ্গবন্ধু যখনই এসব কিছু সংস্কারে হাত দেন, তখনই তার দলের ভেতর থাকা উচ্চাভিলাষী ও পাকিস্তানি চর মোশতাকের নেতৃত্বে এই পাকিস্তানি ধারার সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য তাকে হত্যা করে। তারপরে টানা ২৬ বছর তাদের শাসন।
এই টানা ২৬ বছর তাদের শাসনের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও চেতনা দিয়ে শুরু হলেও ছাব্বিশ বছর যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে এসেছিল, ওই পাকিস্তানি ধারায় দেশ চলতে থাকে। পাকিস্তান মানেই একটি আদর্শহীন রাষ্ট্র, তাই তাদের পরামর্শে চললে কোনো দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। সামনে এগুতে পারে না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি চরদের ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল পাকিস্তানের উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা যে সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি, তার মূল কারণ রাজপথের রাজনৈতিক আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিবাদ যেমন হয়, তেমনি ছাত্র তরুণেরা রাজনৈতিক আন্দেলন গড়ে তুলতে থাকে। বিশেষ করে ছাত্রদের ভেতর তখন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ছিল অনেক জনপ্রিয়।
এরপরে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তরুণ নেত্রী শেখ হাসিনা রাজপথের এই আন্দোলনের হাল ধরেন। কখনও এককভাবে, কখনও জোটবদ্ধভাবে তার নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণাবলীতে যেমন বঙ্গবন্ধুর সবটুকু খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় বাঙালির সর্বভারতীয় প্রজ্ঞাবান নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের গুণাবলী। অর্থাৎ, যেখানে যতটুকু পারা যায়, আন্দোলন সেখানে নিয়ে যেতে হবে। শেখ হাসিনা তাই তাকে নির্বাচনে জোর করে পরাজিত করানো হবে জেনেও বার বার নির্বাচনে গিয়েছেন। বিরোধী দলের নেত্রী হয়েছেন। এমনি করেই তিনি পাড়ি দিয়েছেন ১৯৮১ থেকে ’৯৬ অবধি। ’৯৬ সালে যখন তিনি প্রথম ক্ষমতায় যান, তখন তিনি কোনো নতুন নেতা বা নেত্রী নন। তিনি রাজপথ ও সংসদে বেড়ে ওঠা এক নেত্রী। কারণ ততদিনে তার আন্দোলনের ঝুলি যেমন দীর্ঘ, তেমনি দুই বার সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী তিনি।
তারপরেও বার বার এসেছে তার জীবনের ওপর হামলা। এই সকল হামলা মোকাবিলা করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারচুপির নির্বাচনে পরাজিত হয়েও তিনি দমে যাননি। যার ফলে ২০০৯-এ যখন তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এক নেত্রী। শুধু বাংলাদেশ কেন, দক্ষিণ এশিয়াতেও কোনো নেতা ছিলেন না অভিজ্ঞতায় তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। এই অভিজ্ঞ নেত্রীর হাত ধরে গত ১২ বছর চলছে দেশ। তার দেশ চালানোর পদ্ধতি দেখে বলা যায়, তিনি আগে সংসারকে অভাবমুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতেই তিনি মনোযোগী বেশি। আর কূটনীতির ক্ষেত্রে তিনি অভাবনীয় এক ভারসাম্যের কূটনীতি রক্ষা করে চলেছেন। তাই সত্যি অর্থে ১২ বছরের উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। তারপরেও বাংলাদেশ বিশ্বের এ মুহূর্তের উন্নয়নের একটি রোল মডেল। দ্রুত উন্নত হচ্ছে এমন ৯টি দেশের একটি বাংলাদেশ। আর এই ১২ বছরের উন্নয়ন মানুষকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, তারা এর ভেতরই পঞ্চাশ বছরের উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছে। তবে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ধারাবাহিকভাবে আজকের এই পঞ্চাশ বছরে দেশ পা রাখতে পারত, নিঃসন্দেহে একটি উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারত।
তবে শুধু এই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ায়, অন্যদিকে মনোযোগী অতটা না হতে পারায় দেশে এখনও পাকিস্তানি ধারার মৌলবাদীরা বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। তারা সংকুচিত করছে স্বাধীনতার সকল মৌলিক চেতনাকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাই স্বাভাবিকই বড় প্রশ্ন সামনে আসে: কতদিনে সম্ভব হবে অর্থনীতির মতো সামাজিক সকল ক্ষেত্র এগিয়ে নেবার?