বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গৌরবের একাত্তর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা

  •    
  • ২৬ মার্চ, ২০২১ ১৬:০৫

আমাদের ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চের কথা মনে আছে। ওই দিনটিতে পূর্ণ হয়েছিল স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি এ দিনে তো নয়ই, গোটা বছরেও ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর রজতজয়ন্তী পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাপক কর্মসূচি নেয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গৌরবের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে আমি অংশগ্রহণ করেছি। আমার দুই ভাই এবং বড় বোনের স্বামীও ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। এ কারণে বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা আমার মা রেণুকা দাশগুপ্তাকে সম্মান দিতেন ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’ হিসেবে। ২৬ মার্চ, ২০২১- স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি সক্রিয় কর্মজীবনে থেকে, সুস্থ দেহ-মনে। এ যে পরম পাওয়া!

গত বছর আমরা পালন করেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। বাংলাদেশ সরকার ২০২০ এবং ২০২১ সালকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। করোনা মহামারিকালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষ জনপরিসরে পালন করতে পারিনি। কিন্তু এ স্মরণীয় সময়ে যেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, বিভিন্ন দেশের যেসব নেতা অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করেছেন, তারা একবাক্যে বলেছেন- বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সুবর্ণজয়ন্তীর দশ দিনব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন- এখন সময় এগিয়ে যাবার। আমি মনে করি, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অর্জনই সুবর্ণজয়ন্তীর সবচেয়ে বড় উপহার।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানে মুক্ত এ দেশে তখন কেবল ‘নাই আর নাই’। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিাজার্ভের পরিমাণ কত- সংশ্লিষ্ট ঘরে লেখা ‘শূন্য’। ১৯৭০ সালে এক কোটি টনের মতো চাল ও গম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বছর উৎপাদন অনেক কমে গিয়েছিল। সড়ক ও রেল যোগাযোগ বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তান আমলে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হতো কেন্দ্রীয়ভাবে, যার অনুমোদন দেয়া হতো রাজধানী রাওয়ালপিণ্ডি থেকে। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে কে বাণিজ্য করবে? শিল্প বলতে ছিল কয়েকটি পাট ও বস্ত্র কারখানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ ছিল। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরতে শুরু করে। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থী ফিরে আসে। তাদের বেশিরভাগের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর-রাজকাররা জ্বালিয়ে দিয়েছে, না হয় লুট করেছে। দেশের ভেতরেও অন্তত দুই কোটি নারী-পুরুষ মুক্তিযুদ্ধকালে জীবন কাটিয়েছে উদ্বাস্তুর মতো।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা ছিল পাকিস্তানের পাশে। তাদের ধারণা ছিল- এ দেশটি টিকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার উপহাস করে বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। পাকিস্তানের পারভেজ হুদভয় নামের এক কলামিস্ট ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ‘ডন’ পত্রিকায় ‘কেন বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে’ শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছিলেন-

“পাকিস্তানের অনেক নাগরিকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে টিকবে না এবং শেষ পর্যন্ত কেঁদেকেটে হাতে-পায়ে ধরে বলবে- অনুগ্রহ করে আমাদের আবার পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।”

বাস্তবে আমরা দেখছি বিপরীত চিত্র। এখন বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে ৭ম, ফল উৎপাদনে ষষ্ঠ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর সারিতে। আমাদের পোশাক শিল্প উন্নত বিশ্বকে বিস্মিত করছে। হতদরিদ্র নারীরাই তাদের শ্রমে-ঘামে এ শিল্প এমনকি করোনাকালেও স্বাভাবিক উৎপাদন চালিয়ে যেতে পেরেছে। ওষুধ ও চামড়া শিল্প ভালো করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি নানা পেশায় নিয়োজিত। বিশেষজ্ঞ নামধারী একটি মহলের পূর্বাভাস ছিল- লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে কাজ হারিয়ে ফেরত আসবে। রেমিট্যান্স আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামবে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমরা মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ থেকে এগিয়ে। প্রায় পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারছে। করোনাকালে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ পেরেছে এবং সেটা অন্যদের কাছে বলছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এ স্মরণীয় বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যারা অতিথি হয়ে এসেছেন তারা সবাই বলছেন বাংলাদেশের এ অর্জনের কথা।

আমাদের ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চের কথা মনে আছে। ওই দিনটিতে পূর্ণ হয়েছিল স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি এ দিনে তো নয়ই, গোটা বছরেও ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর রজতজয়ন্তী পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাপক কর্মসূচি নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের অনন্যসাধারণ নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী সুলেমান ডেমিরেল এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তারা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বড় ধরনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, যেখানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছি, রণাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করেছি- নিজেদের কিছু পাওয়ার কথা ভাবিনি। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম ২১ দিন। সেটা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানো নামের একটি স্থানে। গভীর বনে ২১ দিনের ট্রেনিং শেষে দিনে ১ টাকা করে আমাদের ১৭শ’ জনকে দেওয়া হয় ২১ টাকা করে। পালাটানা থেকে যাই মেলাঘরে। সেখান থেকে সাতক্ষীরার ইছামতি নদীর তীরে বাগুনদিয়া ক্যাম্প হয়ে যাই বরিশাল, নিজ এলাকায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে থেকেছি গৈলা দাশের বাড়ি, নিজ বাড়িতে। কী যে আনন্দ ও তৃপ্তির দিনটি ছিল! ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি গৌরনদী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে পাই ৫০ টাকা। ট্রেনিং শেষে ২১ টাকা এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ৫০ টাকা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমার আয় ছিল মোট ৭১ টাকা! কাকতালীয় বটে!

এই ৫০ টাকা নিয়েই ঢাকা আসি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শ্র্রেণিকক্ষ ছেড়ে অংশ নিই মুক্তিযুদ্ধে। ৮ ফেব্রুয়ারি ফিরে যাই সেই ক্লাসে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে এবং তার পরের কয়েকটি দিনে আমার ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ড. জিসি দেব, ড. জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে এবং জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্র ও কর্মচারীকে তারা হত্যা করে। এদের সমাধি হয় জগন্নাথ হলের মাঠের এক প্রান্তে। ১৯৭২ সালের মে মাসে আমি জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সংসদের সহসভাপতি বিধান বিশ্বাস, ছাত্রনেতা কার্ত্তিক চ্যাটার্জি, মৃণাল সরকার, সুরেশ দত্ত, সুবীর হোম রায় এবং আরও অনেকের উদ্যোগে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রস হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে রক্ত বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে নির্মাণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহিদ স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ। শহিদের রক্তঋণ শোধ করা যায় না। আমরা রক্ত বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছি। আজ বাংলাদেশ যে অবস্থায় এসেছে, তার পেছনে অনন্যসাধারণ অবদান ত্রিশ লাখ শহিদের। লাখ লাখ তরুণ পরিবার-স্বজনকে ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। এ সব বীরদের খাবার জোটেনি, থাকার স্থান ছিল না। আমি নিজে এবং অগণিত যোদ্ধা বর্ষায় বনের মধ্যে ভূমিশয্যায় এবং শীতে ধানের খড় বিছিয়ে থেকেছি। এক থালায় রুটি ও ডাল দিয়ে খেয়েছি ৫-৭ জন। এ জীবনে কষ্ট ছিল না। বরং প্রতি মুহূর্তে ছিল আনন্দ-উৎসাহ। একাত্তরের রণাঙ্গনের যোদ্ধারা এখন একে একে বিদায় নিচ্ছেন। কয়েক বছরের মধ্যে আমরা সবাই হয়ে যাব ইতিহাস। বই বা সংবাদপত্রের পাতা ঘেঁটে জানতে হবে আমাদের কথা। তখন কেউ হয়ত বলবে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের তারা হয়ে জ্বল জ্বল করছি, ফুটছি নানা রঙের ফুল হয়ে। কেউ বলবে আমরা মিশে আছি বাংলার সবুজ প্রান্তর আর ধূলিকণার সঙ্গে। কেউবা বলবে অসংখ্য নদনদী আর বঙ্গোপসাগরের ঊর্মিমালা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সময়ের সন্তানদের স্মরণ করেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আছড়ে পড়ছে কূলে কূলে।

মানুষের পুনর্জন্ম হয় কি না, জানা নেই। যদি হয়, ফের একাত্তরের গৌরবের সময়টা ফিরে পেতে চাই।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, কলাম লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর