বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্বাধীনতা অমূল্য

  • মামুনুর রশীদ   
  • ২৬ মার্চ, ২০২১ ১৩:৪৭

২৭ মার্চ সকালে কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য শিথিল করে, কোনো মানবিক কারণে নয়। কতটা ধ্বংসযজ্ঞ, কতটা গণহত্যা করেছে তা দেখাবার জন্য। গ্রিনরোড থেকে বেরিয়ে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার, নীলক্ষেত পেট্রোল পাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে লাশ দেখতে দেখতে শহীদমিনারে এসে দেখি প্রতীকী স্তম্ভগুলো ভেঙে দিয়ে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘মসজিদ’।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ, সারাদিন ঘুমোবার উপায় ছিল না। অবিশ্রান্ত গোলাগুলি, মাঝে মাঝে মানুষের অন্তিম আর্তনাদ, সারারাত ট্যাঙ্কের শব্দ, মানুষবিধ্বংসী কনভয় ঘুরছে বাড়ির সামনে দিয়ে। গ্রিন রোডের মূল সড়কের পাশে সামাদ ভাইয়ের বাসায় আটকে পড়েছিলাম।

২৬ মার্চ ভোরবেলায় যখন আজান হচ্ছিল তখন ভেবেছি এই বুঝি গোলাগুলি থামবে। কারণ ওরা তো ইসলামের নামেই মানুষ মারতে নেমেছে। কিন্তু আজান যেন এক ধরনের নতুন করে নির্দেশ দিলো। আবার শুরু হলো গোলাগুলি। এদিকে বুঝতে পারছিলাম পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। কিন্তু ইপিআর-পুলিশ, ছাত্র জীবনপণ করে একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অবরুদ্ধ সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আমাদের ক্ষুধা, নিদ্রা সবই উবে গেছে। দিনের আলো বাড়ছে আর আমাদের অনিশ্চয়তা বাড়ছে। ফোনগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। কোনো যোগাযোগ করার উপায় নেই। বাড়ির ভেতরে শুধু একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছি। গুলির শব্দ, কনভয়ের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু বিকেলের দিকে তা-ও আর শোনা গেল না। আবার আরেকটি রাত। হিংসায় উন্মত্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরামহীন গণহত্যা চলছেই। এর মধ্যেই বিনিদ্র ক্ষুধাক্লান্ত শরীরটার ভেতরের হৃদপিণ্ডটা একপ্রকার প্রতিরোধের জানান দিয়ে যায়।

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় টেলিভিশনে আবির্ভূত হয় ইয়াহিয়া। জানিয়ে দেয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিব can not go unpunished ও কণ্ঠে মাতালের ঔদ্ধত্য নিয়ে বাঙালি জাতি নিধনের এক নির্দেশ দিয়ে দেয়। দেখতে পাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে একাকী শেখ মুজিব তার গ্রেপ্তারের সংবাদটাও জানিয়ে দেয়।

২৭ মার্চ সকালে কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য শিথিল করে, কোনো মানবিক কারণে নয়। কতটা ধ্বংসযজ্ঞ, কতটা গণহত্যা করেছে তা দেখাবার জন্য। গ্রিনরোড থেকে বেরিয়ে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার, নীলক্ষেত পেট্রোল পাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে লাশ দেখতে দেখতে শহীদমিনারে এসে দেখি প্রতীকী স্তম্ভগুলো ভেঙে দিয়ে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘মসজিদ’।

২৫ মার্চের রাত থেকে ২৭ মার্চের সকাল পর্যন্ত ঘরে ঘরে মানুষের মনে তখন দুর্গ গড়া হয়ে গেছে। দুর্গের সৈনিকরা তখন যুদ্ধের সূচনার জন্য প্রহর গুনছে।

এসব কথা নতুন নয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে যারা ঢাকার অধিবাসী ছিলেন তাদের আরও স্মৃতি আছে। কিন্তু সেই স্মৃতি নিয়ে যখন ঢাকার বাইরে কোনো গ্রামাঞ্চলে গিয়েছি মানুষের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। একদল মানুষ এসব সত্যকে অস্বীকার করে পালটা গল্প তৈরি করেছে।

নয় মাস পরে যখন পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হলো এবং আত্মসমর্পণ করল, তখনও নতুন ধরনের এক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের লেবাসে আবির্ভূত হলো। এদের নাম হলো সিক্সটিন ডিভিশন। যুদ্ধ শেষে ঢাকায় এসে তাদের দেখতেও গেলাম। জনগণকে বিভ্রান্ত করার মধ্য দিয়ে একটা নতুন ষড়যন্ত্রের সূচনা।

পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরেও তা চলতে থাকে নভেম্বর পর্যন্ত। সেনাবাহিনী রাষ্ট্র দখল করে আরেক নতুন পাকিস্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু একুশের আন্দোলনের মতোই ছাত্র-জনতা ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিরন্তর সংগ্রামে পাশে এসে দাঁড়ায় রাজনৈতিক দল। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভেতরেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। স্বৈরাচারী সেনাশাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু একাত্তরের সেই পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররাও ঢুকে যায় গণতান্ত্রিক লেবাস নিয়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও সেই অপচ্ছায়া নানাভাবে শক্তি সঞ্চয় করে গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতি প্রথম ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বশাসনের অধিকার পেয়েছিল। এর আগের শাসকরা কেউ বাংলা ভাষায় কথাও বলেনি। এ দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্যই ছিল না। সুবে বাংলার রাজধানী যখন ঢাকায় তখন থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ইতিহাসে কোনো বাঙালি সার্বভৌম শাসকের কথা জানা যায় না। নানাভাবে ইতিহাসের নানাস্তরে বাঙালির আত্মদান অত্যন্ত গৌরবের। এত কষ্ট, এত রক্তদানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস মহাকালের কাছে এক অণুকাহিনি মাত্র। স্বাধীনতার অর্থ শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতা মানে অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আবার স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছাচারও নয়। অন্যের অধিকার হরণ করাও নয়। অতি স্বাধীনতা যেন পরাধীনতার শৃঙ্খল না হয়। কোনো কালাকানুন নয়। বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে না কাঁদে। আমাদের মনে রাখা উচিত “দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারোর দানে পাওয়া নয়”।

লেখক : নাট্যজন, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এ বিভাগের আরো খবর