সময়টা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। সেদিন বিকালের দিকে বন্ধু তিথি-যুথীদের বাসায় চুড়িভাঙা খেলছিলাম আমি। আমার বয়স তখন ৬ বছর। হঠাৎ দেখলাম হোসেনের মা আমাকে ডাকতে এসেছে। আম্মা পাঠিয়েছে আমাকে এখনি বাড়ি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু কেন এত তাড়াতাড়ি আমাকে বাসায় যেতে হবে, কিছু ভেবে পেলাম না। রহিমের মা জানাল- জরুরি দরকার, তাই তোমারে লইতে আইছি। সেইসময় আমরা থাকতাম ভূতের গলিতে।
বাসায় এসে জানতে পারলাম আমার চাচা এসে জানিয়েছেন শহরের অবস্থা খারাপ। আব্বা নাকি বলেছেন আমাদের সবাইকে বাসায় থাকতে। আব্বা তখন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) তে কাজ করতেন। স্বাধীনতার পর এটাই হয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ( বাসস)।
আব্বা সাংবাদিক বলে অনেক খবরই আগেভাগে পাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চ কালরাতে কী ঘটতে চলেছে, তা বোঝার সাধ্য কারোরই ছিল না। কিন্তু শহরে সবাই ফিস ফিস করে কথা বলা, সন্ধ্যা নামার আগেই ঢাকা শহর চুপ করে যাওয়া, আমাদের কোথাও বেড়াতে না যাওয়ার ব্যাপারটা আমার শিশুমনেও এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করে। স্কুলও তেমনভাবে চলছিল না।
দেশ-রাজনীতি বোঝার বয়স আমার হয়নি তখনও। শুধু লক্ষ করতাম সন্ধ্যা নামার পর পরই কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা চারদিকে। আব্বা, নজলু চাচা, কলিম ভাই, টুনু খালু এবং পাড়ার দু’একজন মুরব্বি এক জায়গায় হয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতেন। মাঝেমাঝে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচি (জাহানারা ইমাম) বাসায় যেতেন আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য ।
সকাল-সন্ধ্যায় শুধু বিবিসি আর ভোয়া শুনতো সবাই। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। তাই হয়তো আমিও সেরাতের অনেক ঘটনা এখনও মনে করতে পারি। সেই একটি রাত শিশু আমাকে অনেকটাই পরিণত করে তুলেছিল। এমনকি সেদিন আম্মা আমাকে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘি ও আলুভাজি দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছিল, সেকথাও মনে আছে।
২৫ মার্চের কালরাত এমনই এক ভয়াবহ রাত, যা আমি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। যতদিন বাঁচব এই স্মৃতির কথা আমি বলে যেতে চাই। রাতে হঠাৎ চারদিক থেকে গুলি, মেশিনগান এবং আরও অনেক শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। শব্দ এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, আমাদের টিনশেডের বাসাটা মনে হলো এখনি ভেঙে পড়বে। আমাদের কাছে ছিল কিছু বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আমার ছোট দুইটা পুতুল নিয়ে খাটের নিচে ঢুকেছিলাম। ভেবেছিলাম যদি দুষ্ট লোকেরা আসে, তাহলে তো আমার পুতুল দুটি নিয়ে যাবে । সেদিন ভাবিনি, ওই হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য এই রাতে বর্বর হামলা চালিয়েছিল।
আমি সেই রাতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আব্বা কী হচ্ছে চারদিকে? এত গুলির শব্দ, এত আগুনের আলো কেন দেখা যাচ্ছে? কারা করছে এমন? ওরা কি আমাদের মেরে ফেলবে?’ কী ভয়ংকর ট্রমা হয়েছিল তখন, তা আমি এখনও কল্পনা করতে পারি না।
আব্বা ফিস ফিস করে শুধু বলেছিলেন, ‘মা পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে, ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনিস নাই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছেন সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হও।’ আব্বা বলেছিল, ‘কাঁদিস না মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।’
আম্মা আমাকে বুকে চেপে ধরে শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছিলেন। চারদিকে ঘোর অন্ধকার আর প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ আগুনের ঝলকানি দেখে মনে হয়েছিল এখনি হয়তো একটা আগুনের গোলা এসে পড়বে আমাদের অন্ধকার ঘরে। নিশ্চুপ একটা রাতে শুধু বোমা আর গুলির শব্দ শুনে আমি ভয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলাম।
আমার মনে হয়েছিল ওরা মনে হয় মানুষ না, ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে পড়া সেই দানোর দল, যাদের মুখ থেকে আগুন বের হয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা আসলে সেই দানবই ছিল। এরপর যে কখন আম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
ভোর হলো। আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। রাতের আঁধার কেটে যাওয়াতে আমি শান্তি পেলাম কিন্তু তখনও জানি না বাংলাদেশের জন্য কেবল অশান্তি শুরু হলো। আব্বা কাজে বেরিয়ে গেলেন। আম্মাকে বলে গেলেন, আমাকে যেন কোথাও না যেতে দেয়। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছু চাল-ডাল, আলু-তেল, লবণ, মোমবাতি আর ম্যাচ কিনে রাখতে বলল পাড়ার দোকান থেকে।
তখন পুরো মহল্লায় একটাই ফোন ছিল, সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ চাচার বাসায়। দুপুরে আব্বাকে ফোন করে জানলাম যে, শহরের অবস্থা খুব খারাপ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গতরাতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। পুলিশ, ছাত্রছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেছে। আম্মা ফোন রেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে এল।
বড় হয়ে ইতিহাসে পড়েছি, জেনেছি যে, ১৯৭১-এর সেই রাতটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার একটা রাত। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলি ভুট্টো, পাকিস্তানের কসাই টিক্কা খান। শুধু মুসলমান হিসেবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, সেই জন্মের সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধিতা করেছিল। তারাই চেয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে দমড়ে মুচড়ে ধ্বংস করে দিতে।
আর তাই শুরুতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে ধরে আমাদের নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতের এই নৃসংশ পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিল রাও ফরমান আলী এবং খাদিম হোসেন রাজার। তারা আলোচনায় আমাদের ব্যস্ত রেখে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে করে লাখ লাখ আর্মি আর অস্ত্র এনে হাজির করেছিল ঢাকাতে। আমাদের যখন গণহারে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানের টপ বসরা বসে অপারেশন সার্চলাইট এনজয় করছিল।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ শুনলাম আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। তখনও আমি বুঝিনি ব্যাপারটা কী। পাড়ায় পাড়ায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কেউ বাসা থেকে বের হবে না। আমরা আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। ‘কারফিউ’ শব্দটাও সেবার প্রথম শুনেছিলাম।
আব্বা সেদিন বাসায় এসে বলেছিলেন, ‘মা আজ থেকে আমরা স্বাধীন দেশ। স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নতুন দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। আমরা আজ থেকে যে যেভাবে পারি যুদ্ধ করব পাকিস্তানি দৈত্যদের বিরুদ্ধে। সেই বয়সে আমাকে বোঝানোর জন্য দৈত্যটাই সবচেয়ে সঠিক শব্দ ছিল। আব্বা সেদিন পাকিস্তানি পতাকাটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশ হবে।’
২৫ মার্চের কালরাত বিশ্বাসঘাতকতার রাত। আমাদের এই ক্ষতি কোনো কালে পূরণ হবার নয়। তবে একথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বাসঘাতকদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। জয়বাংলা!
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন