১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,’-এর পর পূর্ব-পাকিস্তান কার্যত পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠিত করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত সেই হত্যাযজ্ঞে একরাতেই ঢাকাসহ সারা দেশে শহিদ হন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল আতঙ্কের এক জনপদে। মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম এই গণহত্যার ইতিহাস আন্তর্জাতিকভাবে এখনও স্বীকৃত নয়। আমরা স্বাধীনতার ‘৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী’ উদযাপন করছি, এখন সময়ের দাবি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঘটে যাওয়া গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বর্ণনা দিয়ে ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত রয়টার্সের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং লিখেছেন-
“আমরা দেখলাম, দুই দিন পরও পুড়িয়ে দেয়া কক্ষগুলোতে ছাত্রদের মৃতদেহ একটু একটু করে পুড়ছিল। অনেক মৃতদেহ বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, অবশ্য হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরেই বেশিরভাগ মৃতদেহ ভেসে ছিল। চারুকলার একজন ছাত্রের মৃতদেহ পড়ে ছিল, তার ইজেলের পাশেই হাত-পা ছড়িয়ে। সাতজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। বাইরের ঘরে লুকিয়ে থাকা ১২ সদস্যের এক পরিবারের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। সৈনিকরা অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। ইকবাল হলে এখনো ৩০টি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে।”
সেদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয় বিদেশি সাংবাদিকদের; যাতে করে কেউ গণহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে না পারেন। ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত সে হামলায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে সমগ্র ঢাকা শহর। ধর্মের নামে বর্বর হানাদার বাহিনী একরাতে প্রায় অর্ধলক্ষ ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হানাদারবাহিনীর মেশিনগানের গুলি, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলা আর আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কথোপকথন থেকেই জানা যায়, শুধু রোকেয়া হলেই আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সে রাতে হত্যা করা হয়েছিল।
গণহত্যা মানে জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত মানুষজনকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার ইচ্ছাকৃত কাজ অর্থাৎ গণহত্যা হলো কোনো গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজনকে মেরে ফেলা। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এর মতে, ‘গণহত্যা হলো সেই হত্যাকাণ্ড যখন কোনো একটা ঘটনায় চার বা তার অধিক সংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের মাঝে কোনো বিরতি থাকে না। গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অন্যদের মেরে ফেলে।’
United states Holocaust Memorial Museum গণহত্যার সংজ্ঞায় বলেছে, ÔGenocide is an internationally recognized crime where acts are committed with the intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnic, racial, or religious group. These acts fall into five categories: (1) Killing members of the group, (2) Causing serious bodily or mental harm to members of the group (3) Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part (4) Imposing measures intended to prevent births within the group & (5) Forcibly transferring children of the group to another group.Õ এই বর্ণনার সবকটি অপরাধই সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাত্রি স্মরণ করে আর্চার ব্লাড ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন-
‘সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছিল।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণ করা ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে, আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে। ঢাকার অলিগলিতে, বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিনদিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লাখ লাখ নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও নিধনযজ্ঞের কাহিনি। যে হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতা এবং নির্মমতা ইহুদি নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) বা রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অতিক্রম করেছে।
মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ করেছিলেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্ত করা দলিলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড বা গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ দশম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনে ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক’ প্রস্তাবটি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় উত্থাপন করেন সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার। সেদিনই দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাবটি পাস হয়। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন।
জাতিসংঘ আর্মেনিয়ার গণহত্যার নির্মমতার স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করার স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের পক্ষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় কঠিন। সেজন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ সারা দেশে যে গণহত্যা হয়েছিল, তাকে আগে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করতে হবে, এ কাজটা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে হলেই স্বীকৃতি আদায় সহজ হবে।
কয়েকটি গণহত্যা
আর্মেনীয় গণহত্যা (১৯১৫-১৯২৩): তুরস্কের অটোম্যান শাসনামলে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা সংগঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে তুরস্ক শুধু ১৮ লক্ষের অধিক আর্মেনীয় এবং অ-তুর্কীদের হত্যা এবং দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল।
রাশিয়ার গণহত্যা (১৯২৯-১৯৫৩): জোসেফ স্ট্যালিনকে মনে করা হয় বিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুর গণহত্যাকারী হিসেবে। স্ট্যালিনের শাসনামলে কত মানুষকে হত্যা করা হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয়, স্ট্যালিনের বর্বরতার শিকার হয়েছিল প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ। স্ট্যালিনের মৃত্যুতে এই গণহত্যাযজ্ঞের অবসান হয়।
দ্য হলোকস্ট (১৯৩৯-১৯৪৫): অ্যাডলফ হিটলারের ইহুদি নিদনযজ্ঞ হলোকাস্ট নামে পরিচিত। ইতিহাসের সবচেয়ে নিন্দিত এবং পরিকল্পিত গণহত্যা এটি। হিটলার যুগে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিল।
হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যা (১৯৪৫): ইতিহাসের ভয়ংকরতম মানবসৃষ্ট প্রলয়কাণ্ড এটি। ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে দুঃখজনক দুটি দিন ওই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও পরিকল্পিত জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহর দুটি সম্পূর্ণ ধংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমা শহরে ফেলা হয়েছিল প্রথম আণবিক বোমা। এ বিস্ফোরণে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ৯ আগস্ট নাগাসাকির একটি শিপইয়ার্ডে ফেলা আণবিক বোমায় প্রায় ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।
কম্বোডিয়ান গণহত্যা (১৯৭৫-১৯৭৮): ১৯৭৫ সালে খেমাররুজ বাহিনী কম্বোডিয়ার সরকার উৎখাতের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে। খেমাররুজরা ক্ষমতাচ্যুত শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালায়। এ গণহত্যায় হতাহতের শিকার হয়েছিলেন দুই মিলিয়ন মানুষ।
সার্বিয়ান গণহত্যা (১৯৯২-১৯৯৫): ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্রের বসনিয়া-হার্জেগোভিনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পর সার্ববাহিনী বসনিয়ার বেসামরিক বসনিয়াক মুসলিম এবং ক্রোয়েশীয় নাগরিকদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে, এতে প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত হয়। সার্বিয়ানরা শুধু হত্যাযজ্ঞই চালায়নি, তাদের দ্বারা ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী ও শিশু।
রুয়ান্ডা গণহত্যা (১৯৯৪): উপজাতীয় বিভেদের ফলে সৃষ্ট হুতো ও তুসি সম্প্রদায়ের জাতিগত দাঙ্গার কারণেই সংগঠিত হয় রুয়ান্ডা জঘন্য গণহত্যা। এ গণহত্যার শিকার হয়েছেন পাঁচ লাখের অধিক মানুষ। এ গণহত্যা সরাসরি রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর মদদে হুতু মিলিশিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়।
জাতীয়ভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। আন্তর্জাতিকভাবে দিনটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরও ৫০ বছর পেরিয়ে গেলে, তা ইতিহাস থেকেই হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম জানতেই পারবে না, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমাদের ঘুমন্ত পূর্বপুরুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল আপন ভূখণ্ড।
লেখক : প্রাবন্ধিক-গবেষক, শিক্ষক