‘ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা’ পৃথিবীর বড় বইমেলা। এ বইমেলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রচার ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বন্ধনের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা। এখানে খুচরা বিক্রয় হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু প্রচার করার জন্য বিভিন্ন কারণে মেলা আয়োজন সম্ভব নয়। সপ্তাহে একদিন বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আলোচনা ও প্রজেক্টরের মাধ্যমে সে আলোচনা দেখানোর ব্যবস্থা করা যায়। রাশান-সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এটার জন্য একদিন রাখা যায়। ইউরোপ-সাহিত্য, আমেরিকান-সাহিত্য বা দক্ষিণ-আমেরিকার সাহিত্য বিভক্ত করে আলোচনা করা দরকার। ভালো অনুবাদক এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। কলকাতার বইমেলায় প্রতিদিন আলাদা দেশের থিম নির্ধারণ করা হয়। এটাও আপাতত আমাদের দেশে সম্ভব নয়। তবে মহাদেশভিত্তিক ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে এমন সব পরিকল্পনা চালু করা যেতে পারে।
প্রতি বইমেলায় পশ্চিমবাংলা ও আমন্ত্রিত কবি-সাহিত্যিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কয়েক দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন করা যায়। আমাদের দেশের অনেক সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। শুধু অনুবাদের অভাবে। আর যা অনুবাদ হয় তার বেশিরভাগই উন্নতমানের অনুবাদ হয় না। ফলে বাংলা একাডেমি এমন সব পরিকল্পনা করতেই পারে। এতে করে উৎসাহিত হয়ে অনেক ভালোমানের অনুবাদক পেতে পারি। বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন প্রবণতা সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। পরে ভালো পাঠক থেকে ভালো লেখক সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে। বইমেলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রদর্শনী। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন নির্মাণের কাজ করতে পারে এই বইমেলা। জীবনানন্দ দাশ বিশ্বসাহিত্যে আলাদা সংযুক্তি হতে পারে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়। বর্তমানের অনেক সাহিত্যিককে বিশ্বপাঠকের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। এজন্য দরকার শক্তিশালী ‘অনুবাদ উইং’।
বইমেলাতে আলাদা তাগিদ দিয়ে সৃজনশীল পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা ভালো ফল পেতে পারি। এজন্য প্রণোদনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক। বইমেলায় বিশ্বসাহিত্য কর্নার করা যায়। এটার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে অনুবাদ কর্নার। লিটলম্যাগ চত্বরের পাশাপাশি হতে পারে। লিটলম্যাগ চত্বর ও ম্যাগ-কর্তৃপক্ষের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। লিটলম্যাগ রক্তক্ষরণের এক নাম; একটি আন্দোলনের নাম। লিটলম্যাগ চত্বরকে গুরুত্বপূর্ণস্থানে রাখতে হবে। এ অংশকে যতটা উন্নয়ন করা যাবে, সাহিত্যের জন্য ততই মঙ্গলকর হবে।
বাংলা একাডেমি থেকে ভালো বইয়ের জন্য (যদিও এটি আপেক্ষিক হতে পারে) সনদপত্রের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। এতে পাঠকদের জন্য বই বাছাই করার কাজটা সহজ হয়ে যায়। মেলায় বড় একটি বা দুটি স্ক্রিনে নতুন আসা বইয়ের প্রচ্ছদ ও বিস্তারিত দেখানো গেলে ভালো হবে।
প্রতিদিন নতুন স্লোগান নিয়ে অথবা একটি থিম নিয়ে এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। লেখকদের আড্ডার জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা যায়। টিকিটের সঙ্গে অন্তত একটা বইয়ের দাম ধরে নেয়া হোক। বই কেনাসাপেক্ষে সেটা ফেরতযোগ্য হতে পারে। এতে বই কেনা বাড়তে পারে। অযথা মেলায় প্রবেশ করে নিরাপত্তা ও বিশৃঙ্খলার হুমকি কমানো যেতে পারে।
শিশুদের প্রোগ্রাম আরও বাড়ানো দরকার। পাঠকদের জন্য আড্ডার ও বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা দরকার। এক্ষেত্রে সামান্য প্রবেশ ফি নেয়ার চিন্তা করা যায়। বাংলা একাডেমিকে ঠিক করে দিতে হবে একটি বিষয়। যেমন, শিশুকর্নারের খবর থাকবে বা হাইলাইটস হবে অমুক দিন, লিটলচত্বরের মিডিয়াকাভার পাবে অমুক দিন...। এখানে কিছুটা সুষম প্রচার ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে অবহেলিত অংশগুলোও আলোরমুখ বা গুরুত্ব পেতে পারে।
বইমেলায় বইটাই আসল। প্রচারের পাশাপাশি বইয়ের কেনাকাটা হলে তবেই মেলা বাঁচবে। এতে প্রকাশক, লেখক, ছাপাখানা, রিকশাচালক বাঁচবে; একটা জাতি বাঁচবে। তেমন বইমেলা চাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক; উপপরিচালক (কুষ্টিয়া), বিআরডিবি ।