বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কথাগুলো ভাবা দরকার

  • জাহীদ রেজা নূর   
  • ২৩ মার্চ, ২০২১ ১৮:১৭

খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় এ রকম কত শত্রু ঘাপটি মেরে বসে ছিল, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারছি আমরা, এ বড় আনন্দ সংবাদ। ছোট ছিলাম, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। সেই আমি এই স্বাধীন দেশে কাটিয়ে দিলাম পঞ্চাশটি বছর। কত ধরনের রাজনৈতিক উত্থান–পতন দেখলাম। এর সবকিছুর হিসাব–নিকাশ করার মতো বড় পরিসর নেই। কিন্তু অল্পকিছু বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতেই পারি। এ কথাগুলো বলছি নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের জন্য। এর অনেক কিছু্ই তারা জানে, কিন্তু একসঙ্গে থিসিস আকারে এই ঘটনাগুলোর দিকে চোখ গেলে তারা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার একটা পথসন্ধান করতে পারবে।

১. দেশ স্বাধীন হলো যখন, তখন দেশ পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনবল ছিল খুব কম। ফলে শাসন কাঠামোর নানা জায়গায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তা সামাল দেওয়া ছিল কঠিন। বঙ্গবন্ধুর একাধিক ভাষণে এই ভাষ্যের সমর্থন পাওয়া যায়।

২. শুধু ইসলামপন্থি জামায়াত বা তাদের মতো কিছু দলই পাকিস্তানের দালালি করেনি, চীনপন্থি উগ্র বামরাও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতার পর সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশটি জাসদ নামের একটি দল তৈরি করে সরাসরি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে থাকে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বৃদ্ধি পায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। এই চতুর্মুখী বিরোধিতার মধ্যে দেশের হাল ঠিক রেখে এগিয়ে যাওয়া ছিল কঠিন।

৩. যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। সৌদী আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগই পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরও তারা তাদের সেই সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ, তা কাটিয়ে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু দেশি–বিদেশি চক্রান্ত তাকে তার চলার পথ বার বার বাধাগ্রস্ত করেছে।

৪. সরকার কাঠামোয় এমন কিছু ব্যক্তির প্রতি বঙ্গবন্ধু আস্থা রেখেছিলেন, যারা একাত্তরেও সন্দেহজনক কাজ করেছে। খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় এ রকম কত শত্রু ঘাপটি মেরে বসে ছিল, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

৫. বাকশাল নিয়ে শুধু সমালোচনাই শোনা যায়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাকশাল গঠন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না, তা নিয়ে খুব একটা নিরপেক্ষ আলোচনা শোনা যায়নি। অনেকেই বাকশালের তাত্ত্বিক দিকটি না জেনেই একে খারাপ একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। এ নিয়েও গবেষণা হওয়া জরুরি।

৬. প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি দেশ কীভাবে একটু একটু করে মেরুদণ্ডে ভর করে উঠে দাঁড়ালো, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোয় দেশে কিছুই নেই, সে কথা পরিষ্কার করেছেন তিনি। তেমনি তিনি আস্থা রেখেছেন দেশের জনগণের ওপরেই, তারও প্রমাণ আমরা পাই তার ভাষণে।

৭. বঙ্গবন্ধু–হত্যাকাণ্ড কিছু সেনাকর্মকর্তার আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এ ছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। খুনিরা দম্ভভরে তাদের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছে। কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক মদদদাতাদের নিয়ে অনুসন্ধান হয়নি। আমরা তো দেখেছি, পরবর্তীকালে লিবিয়ার মোয়াম্মার গাদ্দাফি কীভাবে খুনিদের পৃষ্ঠপোষণা করেছেন। সৌদি আরব, পাকিস্তানের অর্থও তারা কতটা পেয়েছে, মার্কিনিরাইবা সে সময় তাদের মদদ দিয়েছে কি না, তা নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার।

৮. মুজিব–হত্যার পর পরই খুনিরা ঘোষণা করেছিল এ দেশের নাম হবে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। অর্থাৎ ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’কে পরিবর্তন করে আবার পাকিস্তানের মতো ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেছিল তারা। এ থেকে ষ্পষ্ট হয়, কাদের ক্রীড়নক ছিল এই খুনিবাহিনী!

১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ দেশের উপপ্রধান সামরিক আইনপ্রশাসক এমএজি তাওয়াব জাতীয় সংগীত ও পতাকা পরিবর্তনের আহ্বান জানান। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ। স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ উধাও হয়ে যায় দেশ থেকে। দেশ পরিণত হতে থাকে মিনি পাকিস্তানে। জিয়াউর রহমান নৃশংসতার সঙ্গে দেশশাসন করেছেন। বিভিন্ন অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছেন। সে সময় থেকে বিভ্রান্তির শুরু। শেখ মুজিবুর রহমান নামটিকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।

৯. জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমানাধিকার আছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার কারণে মুসলিমরা নিজেদের বিশেষ ক্ষমতাধর ভাবতেই পারে। তারা যে তা ভাবছে, সেটা বোঝা যায় বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা চালানোর ঘটনায়।

১০. জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে সব জায়গা থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। যার প্রেরণায় এবং নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে, যিনি নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, তাকেই নির্বাসন দেওয়া হলো এই দেশ থেকে। তবে এই অপপ্রচার চিরস্থায়ী হয়নি। অনেক তরুণ দেশের ইতিহাস–সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজের পথেই এগিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারণে নিজেরাই খুঁজে নিয়েছে অনেক প্রশ্নের উত্তর।

১১. ইতিহাস পাঠের সময় মনে রাখা জরুরি, এমন কিছু তথ্য ওপরে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আরও অনেক তথ্য আছে, প্রতিটি তথ্যের বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। সে কাজটা করবে সেই তরুণ, যে সত্যিই দেশপ্রেমী। যে আমাদের মুক্তি ও এগিয়ে চলার পথটি দেখতে পায় এবং সে পথে নিজে চলতে পারে।

আমাদের জানা মতে, কিংবা অজান্তে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা নিয়েও ভাবতে হবে। যেমন, আমাদের লোকজ সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে যাত্রা, আলকাপ কবিগান, মেলা ইত্যাদি লোকজ অনুষ্ঠানগুলো এখন খুব একটা দেখা যায় না। সামরিক শাসকদের আমল থেকেই তো প্রিন্সেসদের অর্ধউলঙ্গ নৃত্য ঢুকিয়ে যাত্রাপালার মহা সর্বনাশ করা হয়েছে। যাত্রাকে অশ্লীল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গ্রাম-বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক তৃষ্ণা মেটানোর সবচেয়ে উপযোগী এই যাত্রাপালাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অথচ আর কিছু না বলে আমরা যাত্রা সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাসের নাম স্মরণ করেই বলতে পারি, যাত্রার মাধ্যমে মানবতা, দেশপ্রেম, মানুষকে ভালোবাসার যে শিক্ষা পাওয়া যেত, তার সমূল–বিনাশ ঘটে গেছে। তার জায়গায় এসে জুটেছে ওয়াজ মাহফিল। অনেক ওয়াজ মাহফিলেই নারীদের যে ভাষায় কটাক্ষ করা হয় কিংবা ভিন–ধর্মের মানুষের প্রতি এমনভাবে আক্রমণ করা হয়, যা বাড়াবাড়ি। ধর্মে বাড়াবাড়ির কোনো স্থান নেই জানা সত্ত্বেও সুকৌশলে এ ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন কিছু মতলবি মানুষ। এই ব্যাপারটি প্রতিহত করা না হলে চিন্তাজগতেই এক ধরনের বর্বরতা ঠাঁই করে নেবে। শান্তির ধর্মকে অশান্ত করে তোলার মতলব করছে যারা, তাদের সতর্ক করে দেয়া এখন সময়ের দাবি।

১২. শহুরে সংস্কৃতি চলে গেছে করপোরেটদের দখলে। তারাই পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় নান্দনিকতাও তাদের রুচিমাফিক নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে শিল্পী হয়ে গেছে তাদের আদেশ মান্য করা মানুষ। করপোরেট হাউজগুলো যদি সত্যিই রুচিশীল মানুষের ওপর সংস্কৃতি বিকাশের ভার ছেড়ে দিত, তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অশ্লীল আয়োজনগুলো সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়েয় পাঠাচ্ছে।

টেলিভিশন নাটকগুলোর বাজেট কমে গেছে, শর্ত দেয়া হচ্ছে অমুক অমুককে নিতে হবে নাটকে, আর কোনো চরিত্র থাকল কি না থাকল, নাটকে সত্যিই কোনো গল্প থাকল কি না থাকল, তাতে কিছু আসে যায় না। এই পরিস্থিতি থেকে কী করে বের হয়ে আসা যায়, তা এখনও কেউ জানে না। শিল্পী তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না তাকে পৃষ্ঠপোষণা না দিলে। একসময় সে দায়িত্ব ছিল রাজ দরবারের। এখন কে তা নিয়ন্ত্রণ করে, কার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, নাকি নিয়ন্ত্রণ নয়, একটা কিছু করার ভাবনা ও অর্থ দিয়ে শিল্পীদের হাতেই বিষয়টি ছেড়ে দেয়া উচিত, তা ঠিক করতে হবে।

১৩. হতাশার কথাই বলা হলো কেবল। এবার আশার কথা বলি। কোন ফাঁকে ১৬ কোটি মানুষের দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল, সেটা আমরা টেরই পেলাম না। খামারিরা মাছের চাষ করছেন যত্ন করে। বাজারে গেলে যেকোনো ধরনের মাছই পাওয়া যাবে। মাছ আর ব্রয়লার মুরগির মাধ্যেম দেশবাসীর আমিষের প্রয়োজন মিটছে, এ খুব বড় অর্জন আমাদের! ডিমও পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ ডিম খেতে পারছে।

১৪. তৈরি পোশাকশিল্পে নানা ধরনের অনিয়ম থাকলেও তারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। যে দেশেই যাই না কেন, মেড ইন বাংলাদেশ দেখলে মন ভরে যায়। তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও পোশাক তৈরির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পেয়েছে সাফল্য। রাস্তা–ঘাট, গ্রাম–গঞ্জেও এখন তালি মারা গেঞ্জি পরা বা ছেঁড়া লুঙ্গি পরা মানুষ প্রায় দেখা-ই যায় না।

১৫. শেষ করি সবচেয়ে বড় তিনটি অর্জনের কথা বলে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে এই বাংলায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে এই বাংলায়। বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে এই বাংলায়। সুতরাং সাফল্য বা গর্বের কথা কৃতজ্ঞতা সহকারেই স্বীকার করে নিতে হয়। আর নতুন নতুন সাফল্যের জন্য, অর্জনের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় নতুন প্রজন্মের দিকে। এরা ইতিবাচক দিকেই ঘুরিয়ে দেবে ইতিহাসের মোড়।

লেখক: গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর