দেশে সাম্প্রতিক যেসব অপরাধ ঘটছে, আর যারা ঘটাচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, এদের বড় একটা অংশ কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ। অপরাধগুলোর মধ্যে যৌনতাকেন্দ্রিক অপরাধের সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে ও-লেভেলের এক ছাত্রীর তার সহপাঠী ছেলেবন্ধুর সঙ্গে দৈহিক মিলনে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। কলাবাগানের এই ঘটনার মতো ঘটনা, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা দুনিয়াতেই ঘটছে। আর তাই এ রকম মৃত্যু ও সম্পর্ক এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে কিশোর- কিশোরীদের অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা টিন অ্যাবনর্মাল সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার।
প্রতিদিন প্রচারমাধ্যমে যেসব অপরাধের ঘটনা ছাপা হচ্ছে বা প্রচার হচ্ছে, এর প্রায় প্রতিটির সঙ্গে কিশোর-কিশোরী, তরুণ, যৌনতা ও মাদক জড়িত। সমাজের সবস্তরে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা একই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অশ্লীল মন্তব্য, বিভিন্ন কায়দায় সেক্স করা, বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা, পর্ননায়িকার মতো করে মেয়ে বান্ধবীর কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার চেষ্টা, এসবই ঘটছে কিশোর-কিশোরীদের অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা টিন অ্যাবনর্মাল সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের কারণে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাদক ও পর্নগ্রাফি। রাস্তার চটি ও পর্নগ্রাফি বা ইন্টারনেটের যৌনশিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল জিনিস শেখায়।
আমাদের অনেকের ধারণা যৌনতা একটি পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির বিষয় এবং কিশোর-কিশোরীদের এর চর্চা করা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তেমনটা নয়। একটি লেখায় পড়লাম, ১০০ বছর আগে কিশোর-কিশোরীদের যৌবনের শুরু হতো গড়ে ১৬ বছর বয়সে। এখন সেটা নেমে এসেছে ১০ বছরে। এর মানে মানুষের যৌনচিন্তা ও শারীরিক প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আগেভাগেই।
অপরদিকে আর্থসামাজিক কারণে বিয়ের বয়স যাচ্ছে পিছিয়ে। যার ফলে কিশোর-কিশোরীরা কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছে না। এতে বাড়ছে যৌন হতাশা। যার ফল হলো অস্বাভাবিক যৌনচিন্তা।
কিশোর-কিশোরীদের অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা টিন অ্যাবনর্মাল সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের সঙ্গে সম্পর্কিত হচ্ছে টিন ডেটিং ভায়োলেন্স। এই ভায়োলেন্স শুধু যে যৌনসঙ্গীর সঙ্গে হতে পারে তাই নয়, এটি নিজের শরীরের ওপরও হতে পারে। যৌনক্রিয়ায় কোনটা স্বাভাবিক ও কোনটা অস্বাভাবিক এই বোধটা ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে না কিশোর-কিশোরীর মধ্যে। সুস্থ যৌনক্রিয়া কী সেই শিক্ষা পাওয়ার আগেই তারা পেয়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ার শিক্ষা।
এর পাশাপাশি শহর ও গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন সব এনিমেশন বা গেইম দেখছে, যা মনকে ধর্ষকামী করে তোলে। কিশোর-কিশোরীরা যখন এসব চরিত্রকে আদর্শ মনে করে নিজেদের তাদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে, তখন তারা না জেনে, না বুঝে জড়িয়ে পড়ে ক্ষতিকর ও অস্বাভাবিক যৌন আচরণে।
বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীদের যৌন জ্ঞান ও প্রজননস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ সময়টাতেই কিশোর-কিশোরীদের মনে রোমান্টিকতা ও যৌন আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যেহেতু যৌনজীবন ও প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে জানা তাদের অধিকার, কাজেই অভিভাবককে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। নতুবা সন্তান ভুল তথ্য নিয়ে ভুল পথে যেতে পারে।
বিশ্ব জটিল হচ্ছে এবং কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এদের সঠিক পথে চালানোর জন্য শুধু নীতি পুলিশিং না করে, বয়ঃসন্ধিকালের প্রজননস্বাস্থ্য ও যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে।
স্কুলগুলো হতে পারে এই জ্ঞান দেয়ার ক্ষেত্রে মূল স্থান। তাহলে সব ধরনের ছেলেমেয়েদের কাছে যৌনতা এবং এ-সম্পর্কিত পারস্পরিক অন্তরঙ্গতার বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে তথ্য পৌঁছানো সহজ হবে। তথ্য দেয়ার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতা, যৌনশিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও ধারণা দেয়া যাবে।
এখনও পরিবার, সমাজ ও স্কুল পর্যায়ে প্রজননস্বাস্থ্য ও যৌনশিক্ষা নিয়ে কথা বলাটা ট্যাবুই রয়ে গেছে। অথচ দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে কিশোর-কিশোরীরা অপ্রাপ্ত বয়সেই অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। তারাই সবচেয়ে বেশি অঘটন ঘটাচ্ছে। আমরা এখনও মনে করছি আমাদের হয়তো সন্তানরা যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে না। সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে আমরা তাদের এই চর্চা থেকে সরিয়ে রাখতে পারছি।
বাস্তবে আসলেই কি তা পারছি? পরিচিত একজন গাইনির চিকিৎসক প্রায় ১০-১২ বছর আগে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, অবিবাহিত কিশোরীদের বাবা-মা বা কিশোরীরা নিজেই তার প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়, অ্যাবরশন বা গর্ভপাত ঘটানোর জন্য। যেহেতু অ্যাবরশন বৈধ নয়, তাই এরা গোপনে এমন জায়গায় গর্ভপাত করায়, যা পরবর্তী সময়ে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। বেশ কিছু বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরী তাদের কাছে এসেছে, যারা অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে এখন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।
মানুষ একটি সমস্যায় ভুগে থাকে, যাকে বলে হাইপার সেক্সুয়ালিটি বা কম্পালসিভ সেক্সুয়াল ডিস-অর্ডার। এই সমস্যার লক্ষণ শিশুদের ১০ বছর বয়স থেকেই দেখা যেতে পারে। লক্ষণগুলো হচ্ছে যৌন বিষয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ এবং পরিণত বয়সের আগে থেকেই যৌন চাহিদা তৈরি হতে পারে। এদের প্রকৃত নির্দেশনা, শিক্ষা ও সহযোগিতা দেয়া দরকার। তা না করে বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের দায়ী করা মানে, একধরনের নির্বুদ্ধিতা।
কিশোর-কিশোরীদের অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা টিন অ্যাবনর্মাল সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা দেখেছেন বর্তমানের কিশোর-কিশোরীদের বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর যৌন আচরণে যুক্ত হওয়ার হার বেড়ে গেছে। এই হার বৃদ্ধির কারণে কিশোর-কিশোরীদের স্বাভাবিক যৌনমিলনের হার কমছে। কিশোর-কিশোরীদের একটি অংশের মধ্যে অগ্রিম যৌন আগ্রহ দেখা দেয় এবং এগুলো রিলিফের জন্য তারা বিপজ্জনক অনেক কিছুই করতে পারে। কারণ এটা তাদের জন্য জেনেটিক বা প্রাকৃতিক। এক্ষেত্রে তারা কীভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে বিষয়ে তাদের সঠিক প্রজনন ও যৌনশিক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার এসব কথাকে মাথায় রেখে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবার ওপর গুরুত্ব দিলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না, শুধু সচেতনতার অভাবে। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার’-এর ওপর করা সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরেও কেন এমনটা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, ২০১৭-২০২২ কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত অপারেশন প্ল্যানে বয়ঃসন্ধিকালের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও, বাবা-মা, অভিভাবক, স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় গুরু, সমাজকর্মী, স্থানীয় মোড়ল ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। অথচ এ বিষয়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়ার কথা বলা হচ্ছে বার বার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৮) সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ কিশোর-কিশোরী। অথচ কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রের সেবা সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই বা তাদের সেভাবে জানানোও হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অভাব রয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা সেবা গ্রহণের সময় সেবাদানকারীর কক্ষের বাইরে অযাচিতভাবে মানুষ উঁকিঝুঁকি দেয়। যত্ন নিয়ে বা গুরুত্ব দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ করে কিশোর ও অবিবাহিতা কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলা হয় না।
কৈশোরকালে মন ও দেহের যে বৃদ্ধি ঘটে, সেই পরিবর্তনের সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো শিশু-কিশোরদের মনো-দৈহিক ও মনো-সামাজিক, আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালে শিশু-কিশোরদের নিজের দেহ ও মন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকে। আর এই প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে বিভ্রান্তি থেকে নানারকম ক্ষতি হতে পারে। একজন শিশু যখন বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখন সেই শিশুর জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন।
সমীক্ষাটি উপস্থাপনের সময় অনেক শিশু-কিশোররা বলেছে যে, তারা এমন একটা কমিউনিটি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করে, যারা সনাতনি ধ্যানধারণা বিশ্বাস ও চর্চা করে।
পরিবার ও সমাজ যৌনজীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনাকে গ্রহণ করে না। বরং এই বিষয়ক আলোচনাকে ঘরে-বাইরে, এলাকায়, স্কুলে এখনও ঠেকানোর চেষ্টা করে থাকে।
যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা কিন্তু শুধু যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা নয়, এ শিক্ষা শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য, আবেগ, মানসিক এবং সামাজিক শিক্ষা, যা মানুষের সারাজীবন প্রভাব রাখে। অথচ আমাদের সমাজে বয়ঃসন্ধিকালের শিশু-কিশোরদের এসব নিয়ে কথা বলাটা এখনও একধরনের প্রাচীন ধারার মধ্যে রয়ে গেছে। ফলে যা জানা তাদের জন্য জরুরি, তারা তা জানতে পারছে না। প্রচলিত ধারণা ও বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কথাবার্তার কারণে বয়ঃসন্ধিকালের স্বাস্থ্য ইস্যুগুলো নিয়ে কথাই বলা যায় না। অথচ সমাজে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে নেতিবাচক ঘটনা ঘটেই চলেছে। যেমন বাল্য বয়সে গর্ভধারণ, অনিারপদ গর্ভপাত, যৌনরোগ সংক্রমণ, যৌনতা-বিষয়ক সহিংসতা।
আমাদের মতো দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে বয়ঃসন্ধিকালের শিশু-কিশোরদের যৌনতা-বিষয়ক শিক্ষা দিলে তারা নষ্ট হয়ে যাবে, যৌন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। অথচ এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই শিক্ষার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা সাধারণ জীবন দক্ষতা, যোগাযোগ, কথা বলা ও শোনার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমঝোতা করা, কোথা থেকে কীভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। জানতে পারবে, কোন কোন অজানা বিষয়ে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থেকে তাদের উপদেশ নেয়া দরকার। তারা এ-ও শিখবে যে বন্ধু-বান্ধবদের অন্যায় পরামর্শ ও চাপকে কীভাবে অগ্রাহ্য করা সম্ভব? এ-ও বুঝবে যে সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে এবং এ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আমরা আরও চাই প্রচার ও সামাজিক মাধ্যমগুলো এগিয়ে আসুক। কিশোর-তরুণদের জন্য তাদের বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যাগুলো নিয়ে এমন বার্তা প্রচার করুক, যা তারা জানে না বা ভুল জানে। কারণ অধিকাংশ বাবা-মা মনেই করেন না যে, এই ইস্যুতে সন্তানের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন