বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাকিব কি সব কিছুর ঊর্ধ্বে?

  • প্রভাষ আমিন   
  • ২২ মার্চ, ২০২১ ২১:০৮

পারফরমেন্স আর সেই সূত্রে পাওয়া বিপুল জনপ্রিয়তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সাকিব দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছেন। জুয়ারির সাথে যোগাযোগের অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে শাস্তি পাওয়ার পরও নিজেকে শোধরাননি তিনি। সাকিবের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

আবারও বোমা ফাটালেন সাকিব আল হাসান। নিউজিল্যান্ডে যখন বাংলাদেশ দল নাস্তানাবুদ, তখন ছুটিতে থাকা সাকিব একাই কেড়ে নিয়েছেন ক্রিকেটের সব মনোযোগ। দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট না খেলে সাকিবের আইপিএল খেলতে যাওয়া নিয়ে বিতর্কটা চলছিল অনেক দিন ধরেই। সেই বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে তিনি নিয়েছেন পাল্টা আক্রমণের কৌশল।

সাকিবের এই কৌশলটা অবশ্য পুরোনো। জুয়ারিদের সাথে যোগাযোগের কারণে আইসিসির শাস্তি আসছে, এটা জানার পর বোর্ডের বিরুদ্ধে খেলোয়াড়দের উসকে দিয়ে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন সাকিব। কারণ শাস্তির খবরটি তিনি ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। দীর্ঘ তদন্ত শেষেই আইসিসি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু খেলোয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে সাকিব এমন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিলেন যে, বিদ্রোহ করেছেন বলেই তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অথচ আইসিসির শাস্তির ব্যাপারে বোর্ডের কিছুই করার ছিল না। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, বিদ্রোহ করায় বোর্ড প্রতিশোধ হিসেবে সাকিবকে নিষিদ্ধ করেছিল।

এবারও তিনি একই কৌশল নিয়েছেন। দেশের হয়ে না খেলে আইপিএল খেলতে যাওয়ার ‘অপরাধ’ ঢাকতে তিনি এবার বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উগড়ে দিলেন ক্ষোভ।

দৃশ্যত সবকিছু ঠিকঠাক। সাকিব আইপিএল খেলার জন্য ছুটি চেয়েছেন। বোর্ড তার ছুটি অনুমোদন করেছে। সাকিব খেলতে যাচ্ছেন। কিন্তু দেখতে যতটা সরল, বিষয়টা আসলে ততটা সরল নয়। সাকিব বিসিবির সিইওকে ফোন করে আইপিএল খেলতে না দিলে দেশের হয়ে না খেলার হুমকি দিয়েছিলেন। তাই বোর্ড ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে তাকে ছুটি দিয়েছে।

সেই ছুটি প্রসঙ্গে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তখন কী বলেছিলেন, একটু মনে করি আসি চলুন। তিনি বলেন: ‘আমরা চাই যারা খেলাটাকে ভালোবাসে, তারাই খেলুক। জোর করে আমি খেলাতে চাই না। সাকিব তো আরও তিন বছর আগেই টেস্টে খেলতে চায়নি। ও তো এমনিতেই টেস্টের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। তখন তো ওকে টেস্ট অধিনায়ক করে দেওয়া হলো। জোর করে তো চেষ্টা করলাম। কিন্তু আসলে জোর করে খেলানোর মানে হয় না। আমার মনে হয় তাতে করে আমরা ভবিষ্যতে আগাতে পারব না। আমরা যখন জানব, এই কয়জন প্লেয়ার টেস্ট খেলতে চায় না, তখন তো তাদের বিকল্প নিয়ে চিন্তা করতে পারব। হয়তো সময় লাগবে। লাগুক। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আমাদেরই ভালো হবে। ওরা সবাই (সিনিয়র) যদি লিখে দেয়, আমরা কেউ জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চাই না, আমি এখনই রাজি। তবে আমাকে অবশ্যই জানতে হবে। ট্যুরের আগে যেয়ে বললে হবে না। হঠাৎ করে সিরিজের আগে আওয়াজ শুনি একটা, এগুলো চাচ্ছি না। খেলতে না চাইলে আগেই বলতে হবে, সিরিজের আগে না। ওরা না খেললে আমাদের সময় লাগবে, আমি একটা বছর সময় চাই। এক বছর পরে কাউকে লাগবেও না, কোনো অসুবিধা নেই।

‘সাকিবের সিদ্ধান্তে যে হতাশ হয়েছি, এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। এর আগেও এমন হয়েছে। কেউ যদি খেলতে না চায়, তাহলে সে খেলবে না। আমরা চাই নিজেদের সিদ্ধান্ত ওরা নিজেরা নিক।

‘একজন খেলোয়াড়ের পেছনে আমাদের বিনিয়োগ তো কম নয়। সব কিছু মিলিয়ে একজন খেলোয়াড়ের পেছনে যা ব্যয় হয়, তা তো আগে কল্পনাও করা যেত না।

‘এই জায়গায় এই রকম দুটি টেস্ট ম্যাচ হারের পরও সাকিব কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা আমার চিন্তাও আসে না। আমার ধারণা ছিল, সবাই পরের টেস্টটা জয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে। সেই জায়গা থেকে যদি কেউ বলে, আমি টেস্ট খেলব না, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলব– তাহলে আসলে আমাদের করার কিছুই থাকে না।

‘আজকে যেসব খেলোয়াড় তারকা হয়েছেন, প্রথম ছয়-সাত বছরে তাদের গড় কত ছিল। খেলতে খেলতেই তো তারা আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন। যখন তাদের সার্ভিস আমাদের পাওয়ার কথা, তখন তারা দলের কথা চিন্তা করছে না। সেটা তো অবশ্যই হতাশাজনক।’

একটু বড় হলেও পাপনের ক্ষোভ কিন্তু সুনির্দিষ্ট। কিন্তু চতুর সাকিব আজ পাপনকে প্রশংসায় ভাসিয়ে সব দোষ চাপাচ্ছেন আকরাম খানের ঘাড়ে। তার কৌশলটা পুরোনো, এক সাথে সবাইকে শত্রু না বানিয়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির প্রয়োগ। বোর্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুজন পাপন আর সুজনকে প্রশংসা করে ধুয়ে দিয়েছেন আকরাম আর দুর্জয়কে। প্রসঙ্গ যখন টেস্ট খেলা, তখন আকরাম খানের চেয়ে অনেক বেশি কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন পাপন। অথচ সাকিব পাপনের প্রশংসা করছেন, আর আকরামকে ধুয়ে দিচ্ছেন।

সাকিব দাবি করেছেন, তিনি চিঠিতে টেস্ট না খেলার কথা লেখেননি। কী চমৎকার কৌশল। সাকিব আইপিএল খেলার জন্য ছুটি চেয়েছেন। সেই চিঠিতে শ্রীলঙ্কা সফরের কথাও আছে। আর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা যাচ্ছে দুটি টেস্ট খেলতেই। তার মানে কী দাঁড়ায়? সরাসরি ‘টেস্ট খেলব না’ এই কথাটি না লিখলেও তিনি যে টেস্ট না খেলে আইপিএল খেলতে চান, এটা তো স্পষ্ট। এই কথাটাই তো বলেছেন আকরাম বা পাপন।

সাকিব যে টেস্টের ব্যাপারে আগ্রহী নন, সেটি তো নতুন নয়। এবার তো তবু আইপিএল-এর কারণে শ্রীলঙ্কায় যেতে চাননি। কিন্তু এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও টেস্ট খেলতে যাননি তিনি। সেবার কোনো কারণ ছিল না। বাংলাদেশ যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় নাকানিচুবানি খাচ্ছিল, সাকিব তখন বাংলাদেশে ঘুরে ঘুরে নির্বাচনি ক্যাম্পেইন করেছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে মানুষকে উৎসাহ দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন, দোকান উদ্বোধন করেছেন। বোর্ড সভাপতি পাপন তো আগেই বলেছেন, তিন বছর আগেই সাকিব টেস্ট খেলার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। সাকিব যাতে টেস্ট খেলেন, সে জন্য তাকে ক্যাপ্টেনও করা হয়েছিল। তাতেও কাজ হয়নি।

সাকিব যা বলেছেন তা ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক করা যাবে। বোর্ডের পারফরমেন্স নিয়ে সমালোচনা কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাকিব এভাবে বলতে পারেন কি না। ছাত্র যদি শিক্ষকের ভুল ধরতে থাকেন, তাহলে তো আর কোনো ব্যবস্থাই কাজ করবে না। বোর্ডের কেউ কোনো কাজ করে না, সব কাজ একা পাপন করেন; এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো বোর্ডের ব্যর্থতার দায়ও পাপনকেই নিতে হবে। কিন্তু চতুর সাকিব পাপনকে আকাশে তুলে প্রকারান্তরে ‘গাটসি’ আকরামের পদত্যাগের দাবি তুললেন। হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের সমালোচনা করলেন। পরে বললেন, তিনি জানেনই না এটা নাঈমুর রহমান দুর্জয় চালান। যেন জানলে বলতেন না। বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ একজন খেলোয়াড় যদি পরিচালকদের এসিআর লিখতে শুরু করেন, তাহলে সেই দেশের ক্রিকেটের কপালে খারাবি আছে।

সাকিব লাভক্ষতির হিসাব কষে বলে দিলেন, শ্রীলঙ্কায় টেস্ট না খেলে আইপিএল খেলতে যাওয়াটা দেশের জন্য ভালো হবে। দেশের জন্য কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, সেটা তো বোর্ড বিচার করবে। সাকিবের তো সেটা করার কথা নয়। সাকিব বলছেন, যেহেতু বাংলাদেশ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তলানিতে, তাই এ দুটি টেস্ট অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ তো কখনোই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার আশা করেনি। শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজের কোনো গুরুত্বই যদি না থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সফর বাতিল করলেই পারত। আর সব খেলা কি এই রকম লাভক্ষতি বিবেচনা করে খেলা যায়? এভাবে বিবেচনা করলে তো অনেক ম্যাচ খেলারই দরকার নেই। ফলাফল টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকায় কোনো প্রভাব ফেলবে না, তাহলে কি বাংলাদেশ সেখানে হারতে যাবে?

আইপিএল খেলতে গেলেই পরবর্তী টি-২০ বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি ভালো হবে, সাকিবের মানের খেলোয়াড়ের জন্য এটা হাস্যকর যুক্তি। গত বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের জন্য সাকিবকে তার আগে ইংল্যান্ড যেতে হয়নি।

সাকিব সম্মানের প্রশ্নটি তুলেছেন। কিন্তু তিনি যেভাবে দুজন সাবেক অধিনায়ককে তুলোধুনা করলেন, তাতে সম্মানের বিষয়টি থাকল কই? নতুন ক্রিকেটাররা সাকিবের কাছ থেকে কী শিখবেন? আকরাম-দুর্জয়ের বিরুদ্ধে বলেছেন। এর আগে বোর্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এর আগেও তিনি সাবেক ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো তো প্রকাশ্য। ব্যক্তিগতভাবে সাকিবের বেয়াদবির শিকার হয়েছেন, এমন অনেক সাবেক ক্রিকেটার লজ্জায় সেটা বলতেও পারেননি। শুধু সাবেক ক্রিকেটার নয়, বর্তমান ক্রিকেটারদেরও তিনি গোনেন না। গত বিশ্বকাপের আগে মাঠে এসেও টিম ফটোসেশনে অংশ নেননি সাকিব। সাকিবের এই ঔদ্ধত্য ঢাকা পড়ে যায় তার পারফরমেন্সে। কিন্তু পারফরমেন্স আর সেই সূত্রে পাওয়া বিপুল জনপ্রিয়তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সাকিব দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছেন। জুয়ারির সাথে যোগাযোগের অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে শাস্তি পাওয়ার পরও নিজেকে শোধরাননি তিনি। সাকিবের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। বোর্ডের কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলাই যেন তার জন্য প্রযোজ্য নয়। আর সাকিবের জন্য বোর্ড অন্যদেরও শৃঙ্খলায় আনতে পারছে না।

কোনো খেলাই ব্যক্তিগত পারফরমেন্সনির্ভর নয়। সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হয়। সাকিবকেও তা মানতে হবে। কিন্তু বারবার তিনি বোর্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বা চাপ দিয়ে নিজের অন্যায় আবদার আদায় করে নিয়েছেন। বোর্ড কঠোর না হলে এই বিশৃঙ্খলার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কঠোর মূল্য দিতে হবে।

জুয়ারির সাথে যোগাযোগের অপরাধ প্রমাণিত হয়ে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাকিব যখন ফিরে এলেন, আশা করেছিলাম, তিনি বিনয়ী হবেন, নত হবেন। কিন্তু চোরের মায়ের মতো সাকিবের গলা আরও বড়। দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট না খেলে স্রেফ টাকার লোভে আইপিএল খেলতে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে আবার সেটার পক্ষে যুক্তি দেয়াও যে সম্ভব, এটা সাকিবের কথা না শুনলে আমি বিশ্বাস করতাম না।

এ বিভাগের আরো খবর