মাদকদ্রব্যের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। শুধু আমাদের সমাজে বলি কেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মাদকদ্রব্যের প্রচলন ছিল। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে সোমরস নাকি ইন্দ্রদেবের অতি প্রিয় পানীয়। সে যুগে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস ছিল সোমরস পান করলে দেবতাদের সংস্পর্শে যাওয়া যায়। এ সোমরস হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে, একপ্রকার বিষাক্ত ছত্রাক, গাঁজা বা মারিজুয়ানার নির্যাস, চেতনানাশক। ইতিহাসের পাতায় আমাদের দেশের এটি হচ্ছে প্রথম ড্রাগ।
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে হেরোডটাসের লেখায় গাঁজার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন পলিনেসিয়ায়ও সোমরসের মতো একপ্রকার পানীয় পাওয়া যেত, যাকে সে দেশের ভাষায় বলা হতো কাবা কাবা। আর তা তৈরি হতো পিপুল গাছের মূল থেকে। সে যুগে মেক্সিকানরাও ক্যাকটাসের মাথা শুকিয়ে নিয়ে তা দিয়ে ধূমপান করত। এতে শরীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ছিল পিয়ট। সে যুগে পেরুর ইরকারা নেশা করত কোকো গাছের পাতা খেয়ে, যা থেকে আধুনিক যুগে তৈরি হচ্ছে কোকেনের মতো মাদকদ্রব্য। সে যুগে চীন দেশেও আফিমের চাষাবাদ করা হতো।
দূরপ্রাচ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো আফিম বা মারিজুয়ানা। সে যুগে আমাদের দেশেও নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো সিদ্ধি বা গাঁজা। এখানে বলা বাহুল্য যে নেশাযুক্ত দ্রব্যের ব্যবহার পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ছিল।
উনবিংশ শতাব্দী থেকেই এ নেশাযুক্ত দ্রব্য পেল আধুনিকতার ছোঁয়া। ব্যথানিরোধক হিসেবে আফিমের ব্যবহার কিছুসংখ্যক মানুষের কাছে ক্রমে নেশার উপাদান হয়ে দাঁড়াল। কালক্রমে, কফ শিরাফ, কোমল পানীয়ের হাত ধরে ড্রাগের অনুপ্রবেশ ঘটে আমাদের সমাজে। আর দিন যতই গড়াচ্ছে ততই পাল্লা দিয়ে চলেছে নেশাযুক্ত দ্রব্যের ব্যবহার। নেশার দ্রব্য হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে হেরোইন, ব্রাউন সুগার ইনজেকশন, কোকেন, ব্যথানিরোধক মলম, অ্যাফিটামাইন্স গাঁজা, এলএসডি, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদির মতো মারাত্মক বস্তু।
আগের দিনে আমাদের সমাজে কোথাও কোথাও কোনো কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তামাকপাতা দিয়ে হুঁকো টানত অর্থাৎ নেশা করত। সে সময় যৌথ পরিবার ছিল। কাজেই বাবা-মায়ের বাইরে অন্যদেরও নজর থাকত বাড়ির ছেলেমেয়েদের ওপর। শুধু তা-ই নয়, স্কুলের মাস্টার সাহেবরাও নজর রাখতেন ছাত্রদের ওপর। তারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মেলামেশা করছে সবই জানতেন বাবা-মায়েরা। সে সময় পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদেরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। আর ছোটরাও বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা মেনে চলত। এখন সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। অপরের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কারও নেই। কারণ, তারা তাদের মানসম্মান আর প্রতিপত্তির পেছনে দিনরাত ছুটছেন। ছেলেমেয়েরা সারা দিন কী করছে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, সেদিকে নজর দেয়ার কারও যেন সময় নেই। মোটা অঙ্কের একটা পকেটমানি আর টিউটর দিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রতি তাদের কর্তব্যের পরিসমাপ্তি বলে মনে করেন, যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়।
এদিকে সবেমাত্র যৌবনে পা দেয়া ছেলেমেয়েদের এ সময় শরীর, মন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে একই সঙ্গে। ফলে এই তিনটির মধ্যে কোনো একটির অভাব হলেই শুরু হয় আবেগজনিত সমস্যা। যা বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধবদের সংস্পর্শে দূর হয়ে যায়। কিন্তু আজকাল পেশাগত ইঁদুর দৌড়ে যুবসমাজ অবতীর্ণ হওয়ায় সে সুযোগ আর তাদের থাকে না। ফলে বাড়তে থাকে অবসাদ। তদুপরি উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর প্রতিযোগিতার মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, ছেলেমেয়েরা ঘর আর সমাজের চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে গিয়ে হতাশায় ভোগে। এরই পাশাপাশি মাথাচাড়া দেয় বেকারত্বের মতো ঘটনা। হতাশা আর অবসাদ কাটাতে যুবসমাজ বেছে নেয় ড্রাগের নেশা।
আগের দিনের লোকদের আনন্দফুর্তি করা আর বর্তমানের আনন্দফুর্তির মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। সে সময় মানুষ আনন্দ করত বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। তারা নিজেরা খেতে ভালোবাসত অপরকে খাইয়েও তৃপ্তি লাভ করত। আজকাল আনন্দের জায়গা হচ্ছে ঘর ছেড়ে হোটেলে, তা-ও আবার সঙ্গে দামি মদের বোতল, যা না হলে নাকি আতিথেয়তা ঠিকমতো হয় না। অর্থাৎ সমাজে প্রেস্টিজ থাকে না।
প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের সমাজে উৎসবের সময় গাঁজা, সিদ্ধি, আফিম সেবনের রেওয়াজ রয়েছে। এসব উৎসবে বন্ধুবান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে বা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে টিনএজ অনেকেই ড্রাগের খপ্পরে পড়ে যায়। এ ছাড়া আজকাল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ড্রাগের অনুপ্রবেশ ঘটছে। এদিকে আজকাল খোলা বাজারেই পাওয়া যায় বিভিন্ন পানীয়সহ খাবারদাবার, যাতে ড্রাগ মেশানো থাকে, আর তা কম বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রিয়। পুলিশের মতে, বেশ কিছু খাবারের মধ্যেও ড্রাগের অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। ফুচকা, আলুকাবলি, দইবড়া ইত্যাদির মাধ্যমে ড্রাগ শরীরে প্রবেশ করে পঙ্গু করে দিচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে।
ড্রাগের কবল থেকে যুবক-যুবতীদের রক্ষা করা প্রত্যেক বাবা-মা তথা দায়িত্বশীল নাগরিকেরই কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য টাকাপয়সার ওপর বেশি গুরুত্ব না দিয়ে বা নিজেদের বিনোদনে ব্যস্ত না রেখে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করলে নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েরা আর একাকিত্ব অনুভব করবে না। ফলে তাদের নেশায় আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা যাবে কমে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিবারের লোকেরা প্রথম প্রথম এসব বুঝতে পারেন না। মনে রাখা দরকার ফ্যাকাশে চোখ, নির্বোধের মতো ফ্যালফ্যালে চাহনি, সর্বদা অশ্রুপূর্ণ ঢুলুঢুলু চোখ, ঝিমুনি ভাব, বাতিকগ্রস্ত ব্যবহার, সর্দিকাশির সমস্যা, হাতে সুচ ফোটানোর দাগ, ওজন হ্রাস, রোজ ফুচকা, আলুকাবরি খাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে ধরে নিতে হবে যে ড্রাগে আসক্ত।
ড্রাগ নামের দৈত্যের কবল থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হলে প্রচারমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে ড্রাগের অপকারিতা সম্পর্কে জনমানসে আলোড়ন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বাল্যকাল থেকেই ছেলেমেয়েদের উগ্র আধুনিকতার ধাঁচে তৈরি না করে আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ হিসেবে যাতে গড়ে উঠতে পারে, তার প্রতি লক্ষ রাখা মা-বাবা, অভিভাবকদের প্রধান কর্তব্য। এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকেই। ড্রাগ আসক্ত লোকদের কেবল চিকিৎসা করলেই হবে না, মনোবিদ দিয়ে তাদের পরীক্ষা করতে হবে। ড্রাগের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পরিবারের লোকজনদের নজর রাখতে হবে, যাতে পুনরায় নেশাসক্ত হয়ে না পড়ে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মাদকবিরোধী আন্দোলনকর্মী