সেই পঞ্চাশ বছর আগের কথা, স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল। ১৯৭১- এর ঐতিহাসিক মার্চ। আগুন ঝরানো মার্চ। অবাধ্যতার মার্চ। বিদ্রোহের মার্চ। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূর্ত রূপ সেদিনকার বাঙালির চোখে-মুখে, চেহারায়, মিছিল-সমাবেশে ভেসে উঠেছিল সমগ্র পৃথিবীর সামনে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা!
মনে পড়ে ষাটের দশকের বিপুল ও আত্মপ্রত্যয়ী গণ-আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের এগারো দফা কর্মসূচিকে সর্বজনীন হিসেবে প্রচার করে অগ্নিঝরা ওই দশকটিতে যে আপসহীন গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল তার তাৎপর্য আজ সীমিত করে ফেলা হয়েছে।
মার্চ একটি মৌলিক পরিবর্তনের শপথে বলীয়ান মাস। একটি ভিন্নধর্মী মাস। ১৯৭০-এর নির্বাচনে গোটা পাকিস্তানের মানুষ যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল, পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ স্বার্থের সশস্ত্র পাহারাদার তাতে প্রমাদ গণেছিল। জনগণের প্রবল চাপে তারা প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয় জনগণের রায় মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা নির্বাচিত বৃহত্তম দলের অর্থাৎ পার্লাামেন্টারি পার্টির বা সংসদীয় ভাষায় পার্লামেন্টের নেতার কাছে হস্তান্তর করবে। সেই নেতাটি ছিলেন বাঙালির প্রাণের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই প্রতিশ্রুতির ফলেই আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি)-সহ আন্দোলনের দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। একমাত্র মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ভাসানী ন্যাপ উগ্র মাওবাদী নকশালপন্থীদের চাপে ওই নির্বাচন বর্জন করে।
জনগণ বিপুল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালটে ভোট দেয়। জনগণ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় এতটাই উচ্চকিত ছিলেন যে, শাসকগোষ্ঠী তাতে বিন্দুমাত্র কারচুপি করতে সাহস পায়নি; তেমন অভিযোগ কোনো মহল থেকে তোলাও হয়নি। এমনকি সব আসনে প্রতিক্রিয়াশীল প্রার্থীরা পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সরকার কারচুপির অভিযোগ তোলার সাহস পায়নি।
গণজাগরণ ষাটের দশক থেকে তুঙ্গে উঠেছিল, যে জাগরণের উন্মেষ ঘটতে শুরু করে ১৯৪৮-১৯৫২-র ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।
বায়ান্নর পর থেকে পূর্ব বাংলার মানুষ পরিবর্তনের নানা দাবিতে রাজপথে নেমে আসে, মুখরিত করে তোলে সারা বাংলাকে। তারা একের পর এক আন্দোলন গড়ে তুলে সরাসরি আন্দোলনের মালা গেঁথেছিল। মানুষ অসাধারণ ঐক্য গঠন করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হতে থাকে।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত দৃশ্যত পূর্ব বাংলার বাম প্রগতিশীল শক্তি প্রথমে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ও সর্বশেষ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর আগে জাতীয়তাবাদী শক্তি আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ) এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ)-এর মাধ্যমে সমান্তরালভাবে আন্দোলনে গোড়া থেকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারী গণ সংগঠনগুলোকে প্রভাবিত করে।
আবার ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে বামপন্থী শক্তিসমূহ পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো-সেন্টো চুক্তিসমূহ, পুঁজিবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্তিশালী জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এক এক পর্যায়ে এই উভয় শক্তি পৃথকভাবে আবার অনেকবার যৌথভাবে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল সরকার (১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ বাদে) ক্ষমতাসীন থাকায় ওই সরকারের বিরুদ্ধে এবং ১৯৫৮ সাল থেকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক সরকার ক্ষমতা জবরদখল করলেও পূর্ব বাংলার মানুষ রাজপথ কখনই ছাড়েনি। সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বাম প্রগতিশীল শক্তির সম্মিলিত আন্দোলন, যার প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৬২ সালে নয় নেতার যুক্ত বিবৃতি এবং অতঃপর এনডিএফ গঠন ও তার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যদিও এতে মূল নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দক্ষিণপন্থীদের হাতে।
এর পর পরই বাম-প্রগতিশীল শক্তিসমূহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সৃষ্ট মতাদর্শিক বিরোধের ধাক্কায় বিভেদের দিকে এগোতে থাকে অভ্যন্তরীণভাবে। এই বিরোধ অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি দল ও সংগঠনসমূহ মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী হিসেবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। চীনপন্থীরা অবশ্য সংখ্যায় ছিল অল্প এবং তাদের মধ্যে আবার বিভিন্ন ধারা-উপধারায় তত্ত্বের অনৈক্যজনিত ক্ষেত্রে গুরুতর মতানৈক্যের কারণে দ্রুতই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের কেউ কেউ আইয়ুব সমর্থক ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়।
মস্কোপন্থী অংশ জাতীয় রাজনীতিতে তার স্বৈরতন্ত্রবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বজায় রেখে মূলধারায় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু মওলানা ভাসানীর মতো জনপ্রিয় বামপন্থী, প্রগতিশীল নেতা চীনপন্থী অংশে চলে যাওয়ায় সমাজতান্ত্রিক ও কৃষক-শ্রমিকের রাজনীতি মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছিল। সভাপতি পদে আসীন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাশীল হলেও তার দেশব্যাপী জনপ্রিয়তায় যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। ফলে নেতৃত্বের ভাবমূর্তি উচ্চমানে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু সংগঠনের নানা স্তরে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও আদর্শিক সবলতাকে পুঁজি করে বামপন্থী আন্দোলন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার দিকে যেতে থাকে। গণভিত্তিও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এই সময় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী শক্তির মিলিত আন্দোলন জনগণের মধ্যেও বিপুল সাড়া জোগায়। উভয়শক্তিই দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর সামনে হাজির করলেন তার ঐতহিসাকি ছয় দফা কর্মসূচি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে এই কর্মসূচি পূর্ব বাংলার মানুষের মনের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ওই কর্মসূচি বিদ্যুৎগতিতে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একই সঙ্গে পরিপূরক এবং পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে জনগণের আস্থার স্থল শেখ মুজিব তৎক্ষণাৎ তাকেও আপন বা জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন। এ কর্মসূচিও জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে যায়।
৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা অর্পণ না করলে এবং তা নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার টালবাহানা শুরু করলে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়েন কার্যত বাঙালির একক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশে ব্যাংক, দোকান অফিস-আদালত পরিচালিত হয়। সেই লড়াইয়ের একজন অন্যতম সৈনিক হিসেবে যখন সেদিনকার কথাগুলো ভাবি, তখন যে দৃশ্য স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে জীবন্তভাবে আজ তা নিজের কাছেই যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। অসহযোগ আন্দোলন এমনই তীব্রতা লাভ করে যে, শেষ পর্যন্ত তা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়।
এবার জনতার স্পষ্ট উপলব্ধিতে এলো বাঙালি জাতির মুক্তির জন্যে সার্বিক পথনির্দেশ পাওয়া গেল। জনগণ সিদ্ধান্ত নিল ওই উভয় কর্মসূচি আদায়ে লড়াই-সংগ্রাম চালাতে হবে, চালিয়ে গেলেনও। লক্ষ্যণীয় সেই সময়ে পরিচালিত আন্দোলনগুলোর ডাক যদিও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ প্রভৃতি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো; মিছিলগুলোতে ওই সকল দলের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিত। সভা-সমাবেশগুলোতে যোগদানের জন্য তখন মানুষ আসার জন্য আদৌ কোনো গাড়ি বা বাহনের ব্যবস্থা করা হতো না। নিজেরাই বাস, গরুর গাড়ি ভাড়া করে বা পায়ে হেঁটে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসত আবার সভা-সমাবেশ শেষে ফিরে যেত।
বঙ্গবন্ধু এই জনগণকেই ডাকলেন ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে। তার ওই ভাষণের প্রতিটি বাক্য শেষে মানুষের করতালি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং দেখার মতো। বঙ্গবন্ধু মানুষকেই তার করণীয় অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার যখন আহ্বান জানান (যার যা আছে তা-ই নিয়ে) তখন মানুষের সমুদ্র ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কণ্ঠে ধারণ করে অনেকেই মাথায় পট্টি বেঁধে হাতে থাকা বড় লাঠি উঁচিয়ে সমর্থন জানায়। লাখ লাখ মানুষের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগের মতো ছিল মধ্যবিত্ত। বাদ-বাকি সবই শ্রমিক-কৃষক ও তাদের সন্তান।
এর পর নেমে আসে ভয়াল ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি সৈন্যরা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল জেলায় পাকিস্তানি সৈন্য কারফিউ ঘোষণা করে, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শুরু করে; তখনই জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতির লক্ষ্যে বন্দুক-রাইফেল, লাঠি-ফালা, সড়কি নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে নেমে পড়ে।
এভাবেই মার্চ হয়ে উঠেছিল বিশাল জাগরণের মাস। একান্তই জনগণের মাস। এভাবে শুরু হয়ে যায় বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। মূল সশন্ত্র যুদ্ধ তো শুরু হয় ভারতে সবার প্রশিক্ষণের পর। সে আরেক ইতিহাস।
লেখক: কলাম লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক