জন্ম যেভাবেই হোক জিয়াউর রহমান বিএনপি নামের দলটিকে একটি শক্ত ভিত দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী পরিচালকরা শুদ্ধমন ও প্রজ্ঞার না হলেও তখন আওয়ামী লীগের ক্রমাগত রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে দলের শক্তিবৃদ্ধি করতে সমর্থ হন। এভাবে বিএনপি অল্প সময়ের ব্যবধানেই এদেশের একটি বড় দলে পরিণত হয়। একইভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পরস্পরের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে গিয়ে ক্রমাগতভাবে আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে। তাই উভয়পক্ষই সুস্থ রাজনীতির পথে না হেঁটে নানা অলিগলি খুঁজতে থাকে। সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করার পরও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে না। এর বড় প্রমাণ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
বিএনপি-শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ প্রায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোটকে। অমন জনসমর্থন আর কোনো কালে কোনো রাজনৈতিক দল পাবে এমন বোধ হয় না। এ ধারার জনসমর্থন অনেক বেশি সাহসী করে তুলতে পারে একটি রাজনৈতিক দলকে। সেবারই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সুযোগ ছিল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া। দিন বদলে দেয়ার স্লোগান ঠিকই কার্যে পরিণত করে আওয়ামী লীগ নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারত। কিন্তু অমন সুযোগ সেসময় হেলায় হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা। বিরোধী দলকে ঠেকানোর দুশ্চিন্তায় গণশক্তি থেকে শক্তিমান হওয়ার সাহস করতে পারেননি। তাই গড্ডলিকায় গা ভাসালেন। তাই তখন মরচে ধরা রাজনীতিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি।
নানা ঘাটের মিলন মেলায় সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের সমাবেশ সবচেয়ে বেশি বিএনপিতে। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক সুস্থ রাজনীতি নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর আশা করা যায় না। বিএনপি নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের জায়গাতে ঘাটতি অনেক বেশি। একারণে বিএনপি সুস্থধারার রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার পথে হাঁটতে পারেনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে প্রথমে একটি হীনন্মন্যতা গ্রাস করে।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধস্নাত একটি দেশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ বড় জায়গা নিয়ে থাকবে। বিএনপি নেতৃত্বের হতাশার কারণ এখানেই। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল। তাই এদিক থেকে আওয়ামী লীগকে টপকানো দরকার হয়ে পড়লো বিএনপির। বিএনপির জন্ম ১৯৭৮ সালে হলেও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ বিচ্ছিন্ন দল ছিল না। এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এখান থেকেই বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায় তৈরি হতে পারত। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারানো বিএনপি নেতৃত্ব মনে করল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান যেন অনেকটা দুর্বল হয়ে গেল। তাই ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে স্বয়ং জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় যে দাবি করেননি তার উত্তরসূরিরা সে দাবি করে লাঞ্ছিত করলেন শুধু দেশবাসীকেই নয়- জিয়াউর রহমানের বিদেহী আত্মাকেও। এক সুন্দর (!) সকালে বিএনপি নতুন তথ্য নিয়ে হাজির হলো। বলা হলো জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক। পাঠ্যবইতে লেখা হলো জিয়াউর রহমান ঘোাষণা না দিলে পাকিস্তানি আক্রমণে হতাশ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি আঁতকে উঠলাম। বিএনপি নেতৃত্বের এ কেমন হঠকারী আচরণ! সাময়িক রাজনৈতিক লাভের জন্য ভবিষ্যৎ বিএনপি নেতাকর্মী সমর্থকদের মাথা হেঁট করে দিলেন। ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন পুরো দলটিকে।
এসবেও স্বস্তি পেলেন না বিএনপি নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরাসরি অভিযোগ আছে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। এর সত্যমিথ্যা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কিন্তু কেন যেন অভিযোগটি অস্বস্তি তৈরি করে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে। বিএনপি নেতৃত্ব যেন আতঙ্কের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে থাকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনকে। যেন মনে করতে থাকে জাতীয় শোক দিবস তর্পণ প্রজন্মকে একটি কালো অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। তাই বেগম খালেদা জিয়া যখন বিএনপির হাল ধরেছেন তারই একটি পর্যায়ে আত্মবিশ্বাসহীন বিএনপি নেতা-নেত্রীরা কাঁঠাল ভাঙলেন স্বয়ং নেত্রীর মাথাতে। গিনিপিগ হতে হলো বেগম জিয়াকেই। ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো তাকে।
হঠাৎ করে আরও এক সুন্দর (!) সকালে জাতি জানলেন বেগম জিয়া জন্মে ছিলেন ১৫ আগস্ট। আর এভাবেই শোক দিবসকে চাপা দিয়ে ‘সুখ দিবস’ অর্থাৎ ঘটা করে নেত্রীর জন্মদিবস পালন করার আয়োজন শুরু হলো। আমি ইতিহাসের ছাত্র। ইতিহাস গবেষণায় সামান্য যুক্ত থাকি। তাই গবেষণা পদ্ধতি অবলম্বন করে বেগম জিয়ার জন্ম উৎসব পালনের ‘ঐতিহাসিকতা’ খোঁজার চেষ্টা করেছি। দেখা গেল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ফার্স্ট লেডি হিসেবে ১৫ আগস্টে কখনও বেগম জিয়ার জন্ম উৎসব পালিত হয়নি। বিএনপি সভাপতি হওয়ার পর পরও নয়।
কারো জন্মদিন-তারিখ কতটা রহস্যপূর্ণ তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অমন প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ রুচিকরও হবে না। এমন প্রশ্নও তুলতে চাই না- একটি বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেত্রীর জন্ম তো নিশ্চয়ই নিয়মমাফিকই হয়েছিল, তবে কেন একাধিক তারিখের কথা বাজারে ছড়িয়ে আছে!
যখন জন্ম তারিখের নব রূপায়ণ করেছেন তাতে আমাদের বলার কী। কিন্তু বিএনপি নামের দলটির পরবর্তী প্রজন্মকে যে ইতিহাসের বিচারে লাঞ্ছিত হতে হবে এটিই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাবনা। বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কলকাঠি নাড়ানোয় সিদ্ধ নষ্ট মানুষগুলোর একবারও কি মনে হয়নি, এদেশের অতি সাধারণ মানুষের কাছেও ১৫ আগস্টের মতো দিনে একজন জাতীয় নেত্রীর ঘটা করে জন্মদিন পালন কুরুচিপূর্ণ মনে হবে। অথবা তাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিএনপি কেন অমন দৃষ্টিকটু আচরণ করে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে চায়। অমন কাজ শুধু ফারুক-রশীদ-ডালিমরাই করতে পারে। এদের সঙ্গে কী সখ্য বিএনপির?
পরে বোধ হয় বিএনপি নেতৃত্বের বোধদয় হয়েছিল। বুঝেছিলেন একটি বড় ভুল কাজ করে ফেলেছেন। তাই কয়েক বছর আগে ১৫ আগস্টের দিন কয়েক আগে কোনো এক কাগজে দেখেছিলাম বিএনপি ঘটা করে দলীয় সভানেত্রীর জন্মদিন পালন করবে না। পড়ে বড় স্বস্তি পেয়েছিলাম। এখন অবশ্য ১৫ আগস্টের জন্মদিন পালন নিয়ে আগের মতো হৈ চৈ দেখি না।
অবশ্য বেগম জিয়ার নবরূপায়ণের ৬৭তম জন্মদিনটি শেষ বারের মতো ঘটা করে পালন করা হয়েছিল। নষ্ট রাজনীতির এমন আচরণ নিশ্চয় বিবেকবান সকলকে আহত করবে। টিভি চ্যানেল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মর্মান্তিক তথ্যচিত্র উপস্থাপিত হয়। স্মৃতিচারণ করা হয় দুঃসহ অভিজ্ঞতার। নানা অঞ্চলে কাঙালি ভোজ-দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ একটি শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করে। ঠিক তখনই এসব শোকগাথাকে আমল না দিয়ে বলা যায় পায়ে মাড়িয়ে এক কুৎসিত বন্যতা নিয়ে ‘বিবেকবান’ ডানহাত-বামহাত-তস্যহাত পরিবেষ্টিত হয়ে বেগম জিয়া তার ৬৭ বছর পূর্তি উদযাপন করেছিলেন ৬৭ পাউন্ড কেক কেটে। পত্রিকা আর টেলিভিশনের স্ক্রিনে এমন দৃশ্য চোখে জ্বালা ধরিয়েছিল। আমাদের দেশেরই জাতীয় নেতা-নেত্রীদের আমানবিক আচরণ দেখে বিব্রত হতে হয়। নিজেকে ছোট মনে হয় এই ভেবে যে, আমিও বোধহয় কোনো না কোনোভাবে এই অমানবিক বন্য আচরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম।
বিএনপির এমন রুচীহীন বিপন্ন দশা আমাদের চিন্তিত করে। গণতান্ত্রিক ধারা বহাল রাখার জন্য একটি শক্ত বিরোধী দল থাকা জরুরি। অতীতের মতো যারা সরকারও গঠন করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের বিএনপি যেন সুস্থ ও নিয়মতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি করাই ভুলে গেছে।
ইতিহাসের সত্য অস্বীকার করে কোনো রকম লাজলজ্জা বালাই না রেখে বিএনপি নেতারা কলের গানের ভাঙা রেকর্ডের মতো ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’র ধরনের হাস্যকর স্লোগান দিয়েই যাচ্ছেন। এভাবে এক সময় মুক্তিযুদ্ধচর্চা বিচ্ছিন্ন প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করতেও পেরেছিলেন। কিন্তু শাসন ক্ষমতা থেকে ছিটকে পরার পর দুর্বল ভিত্তির ওপর গড়া বিএনপির বালির ইমারত ভেঙে পড়ে। প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা স্পষ্ট হতে থাকে। তারা বিএনপির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ফিরিয়ে দিতে থাকে বুমেরাংয়ের মতো।
এসব দেখেও কি এক বিভ্রান্ত দশায় বিএনপি যে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর হঠাৎ ৭ মার্চ পালনের কথা বলে নতুন করে সস্তা প্যাঁচ কষতে মঞ্চে উঠলেন। বলতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু (দলটির ছক মতো ‘শেখ মুজিব’) ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মতো কিছু বলেননি। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন আর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাহলে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গোড়ে তোলার আদেশ দিলে দেশজুড়ে তরুণ যুবারা শারীরিক ও মানসিকভাবে কেন প্রস্তুতি নিচ্ছিল?
জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন। এরপরেও কতগুলো প্রশ্নের নিষ্পত্তি হলো না। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ঢাকার রাজপথে যে বাঙালি বেরিকেড দিচ্ছিল তা কার প্রেরণায়?
২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার পর পথে পথে বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কার নির্দেশে? রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বীর পুলিশরা কেনইবা যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন?
আরও একটি বড় প্রশ্ন যে, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন জিয়াউর রহমান সেই ট্রান্সমিটারটি ছিল ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। যা থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা থেকে ভালোভাবে শোনা সম্ভব। তাছাড়া কতজন মানুষ স্থানীয় বেতার কেন্দ্র শুনে অভ্যস্ত? হয়তো রেডিও সেটের নব ঘোরাতে ঘোরাতে কেউ দৈবাৎ শুনতে পারে।
তাই বলছি এমন এক বাস্তব অবস্থায় দাঁড়িয়ে খোদ জিয়াউর রহমানকে ছোট করে যে মিথ্যাচার বিএনপি নেতারা শুরু করেছিলেন তা মাঝখানে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আবার ৭ মার্চ সামনে রেখে ডুবন্ত বিএনপিকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করার জন্য সমস্বরে বিএনপি নেতারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে চেঁচামেচি শুরু করেছেন। এসব উগ্রপন্থী নেতারা কি শেষ পর্যন্ত দলটিকে চূড়ান্ত লাঞ্ছিত করেই ছাড়বেন!
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষক ও কলাম লেখক