বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঘটনাগুলো শুধু গল্প নয়

  • জাহীদ রেজা নূর   
  • ১৯ মার্চ, ২০২১ ১৫:৪৩

দরিদ্র রিকশা বা সিএনজিচালক নিজে এসে যাত্রীর ফেলে যাওয়া মূল্যবান জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন, এমন ঘটনাও আমরা পড়েছি পত্রিকায়, দেখেছি টেলিভিশনে। সৎ হওয়ার ব্যাপারটা নির্ভর করে আবহের ওপর। আমরা কি দেখছি না, বড় বড় সব কোম্পানি সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে টাকা দিনের পর দিন শোধ করছে না। সুযোগমতো পুনঃতফসিল করছে বার বার। ব্যাংক লুট হচ্ছে, কারখানা লুট হচ্ছে, জমি লুট হচ্ছে—কিন্তু তাদের পেশিশক্তির কাছে রাষ্ট্রও অসহায় হয়ে থাকে।

আচ্ছা, কেউ যদি আবর্জনা স্তূপে হঠাৎ করে খুঁজে পায় জীবনানন্দ দাশের একটা অপ্রকাশিত কবিতা? কিংবা নজরুলের হাতেলেখা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পাণ্ডুলিপি?

তাহলে নিলামে কত দাম উঠবে তার?

আমাদের জীবনানন্দ দাশ তো ভ্যান গঘের ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলেন, কিংবা র‌্যাবোর ভাগ্য। মৃত্যুর পরই তাদের কদর বেড়েছে। জীবনটা কেটেছে অন্ধকারের মতো।

আমাদের দেশে আবর্জনা স্তূপে এ ধরনের মণি–মুক্তার দেখা সহজে মিলবে না। কিন্তু অন্য অনেক দেশে হঠাৎ করে কেউ আবর্জনা স্তূপে পেয়ে গেছে ‘অমূল্য রতন’।

এ রকম কটি ঘটনার কথাই আজ বলি।

ব্রিটেনের এক নারী স্কুলশিক্ষকের হাতে কী করে মোটা টাকার আমদানি হলো, সেটা দেখা যাক। সংগতকারণেই তার নাম বলা হচ্ছে না। শুধু বলা যায়, তার বয়স এখন ৬৫। ২০২০ সালে এই টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

কীভাবে এই টাকা তার হাতে এলো, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০০৮ সালে। আবর্জনা স্তূপে কেউ একজন বেশ কিছু বই ফেলে দিয়ে গিয়েছিলেন। বইয়ের সংখ্যা ছিল অনেক, শিক্ষক সব বই তো নিয়ে যেতে পারেননি, নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচটি বই। এর মধ্যে তিনটি বই ছিল হ্যারি পটারের প্রথমটি। দুটি সুলভ সংস্করণ, পেপারব্যাক। অন্যটি ছিল মোটা মলাটের। শিক্ষক তার নাতিদের পড়তে দিয়েছিলেন সে বই। ওরা তা পড়েনি। ১২ বছর সেই বইগুলো পড়ে ছিল চিলেকোঠায়।

২০২০ সালে শিক্ষকের কাছে খবর এল ডারবিশায়ারের নিলাম প্রতিষ্ঠান Hansons Auctioneers অনলাইনে হ্যারি পটার বইয়ের দুষ্প্রাপ্য সংস্করণগুলো সংগ্রহ নিলাম করছে। নিয়মাবলি পড়ে বর্ষীয়ান শিক্ষক তো অবাক! ১৯৯৭ সালে শক্ত মলাটে হ্যারি পটারের যে ৫০০ কপি প্রকাশিত হয়েছিল, তার দামই নিলামে সবচেয়ে বেশি। আর সুলভ সংস্করণগুলোও একেবারে জলের দামে বিক্রি হয়নি। ওই দুটি হ্যারি পটারের জন্য তিনি পেয়েছিলেন ৩৪০০ পাউন্ড আর ৩০০০ পাউন্ড। আর শক্ত মলাটের হ্যারি পটারের জন্য পেয়েছিলেন ৩৩ হাজার পাউন্ড!

বিবিসি যখন প্রশ্ন করল, এই দাম পেয়ে তিনি কি তৃপ্ত?

তখন তিনি বললেন, ‘তৃপ্ত— এই কথা বলে কিছুই বোঝানো যাবে না।’

তবে তারই দেশি ভাই ডেভিড রোজের ব্যাপারটা খানিকটা ভিন্ন। আবর্জনাগুলো বিভিন্ন স্তূপ থেকে এলে সেগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করার কাজটি তিনি করছেন পনেরো বছর ধরে। বিবিসির এক অনুষ্ঠানে তিনি দিলেন এক অবাক করা সংবাদ। আবর্জনার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের পাইপ, চুরুট রাখার বাক্স, এমনকি চুরুটও! শুধু কি তাই? যে মেয়েটি কাজ করত চার্চিলের হেঁসেলে, তার অনেকগুলো চিঠিও উদ্ধার করেছেন রোজ। চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন তার ছেলেকে। চার্চিলের দিনের রুটিনটার বিশদ বর্ণনা ছিল চিঠিতে। চার্চিলের অভ্যাস, বদ অভ্যাসগুলোর কথাও তিনি লিখেছিলেন বিস্তারিত। চার্চিলের জীবনের কিছু টুকরো ঘটনারও বর্ণনা ছিল চিঠিগুলোয়। চিঠির সংখ্যা শুনবেন? দু’শটি। জি না, ভুল শোনেননি। সংখ্যাটা দু’শই।

জিনিসগুলো চার্চিল তার বাবুর্চিকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কীভাবে এ অমূল্য সম্পদগুলোর জায়গা হলো আবর্জনা স্তূপে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে এগুলো যে সত্যিই চার্চিলের ব্যবহার করা জিনিসপত্র, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই জিনিসপত্রের মূল্য হবে ১০ হাজার পাউন্ড বা তার চেয়েও বেশি। কারণ কিছুদিন আগে চার্চিলের ঘরে পরার স্যান্ডেল নিলামে বিক্রি হয়েছে ৩৯ হাজার পাউন্ডে।

এ রকম আরেকটি আবর্জনার গল্প বলে আলাপটি শেষ করব।

এই গল্পটি অবশ্য মেক্সিকোর। সে দেশের খ্যাতিমান মডার্নিস্ট শিল্পী রুফিনো তামাইয়ো অনেক অনেক বড় বড় পুরস্কার পেয়েছেন তার জীবনে। মেক্সিকোর রাষ্ট্রীয় সেরা উপহারও তার আছে তার ঝুলিতে। তিনি ১৯৯১ সালে প্রায় ৯২ বছর বয়সে মারা যান।

জীবদ্দশাতেই তার আঁকা একটি ছবি নিয়ে যে কাহিনির জন্ম, তা যেকোনো গোয়েন্দা কাহিনিকেও হার মানায়।

হিউস্টনে বসবাসকারী মার্কিন এক দম্পতি ‘থ্রি পারসনস’ নামের একটি ছবি কেনেন ৫৫ হাজার ডলার দিয়ে। সে বহু বছর আগের কথা। অল্প সময়ের জন্য তারা এই ছবিটি রাখতে দিয়েছিলেন টেক্সাসের একটি খুবই সম্মানজনক গুদামঘরে। এখানে দামি জিনিসপত্র নিশ্চিন্তে রাখা যেত। কিন্তু থ্রি পারসনসের ব্যাপারটা কেঁচে গেল। ওটা একদিন চুরি হয়ে গেল। ব্যাপক অনুসন্ধানেও তার দেখা মিলল না। যে সময় ছবিটি চুরি হয়েছিল, তখন তার দাম ছিল ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ছবিটি উদ্ধারের জন্য খুব চেষ্টা করল পুলিশ, দামি পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করা হলো, কিন্তু তাতে লাভ হলো না কোনো।

এরপর ১৬ বছর কেটে গেল। ২০০৩ সালে নিউইয়র্কের অধিবাসী লেখক এলিজাবেত গিবসন ম্যানহাটনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন কোনো কফিশপ পেলে কফিতে গলা ভিজিয়ে নেবেন। এদিক–ওদিক তাকিয়ে কফিশপ খুঁজতে লাগলেন। একটা আবর্জনা স্তূপের দিকে চোখ গেল তার। তিনি দেখলেন সেখানে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে একটা আঁকা ছবি পড়ে আছে। যদিও এ ধরনের ছবির ভক্ত ছিলেন না এলিজাবেত গিবসন, কিন্তু এত ভালো একটা ছবির জায়গা হয়েছে আবর্জনা স্তূপে? তাতে তার মন খারাপ হলো। তিনি ছবিটা নিয়ে এলেন বাড়িতে। মজার ব্যাপার হলো, পথেই তিনি সেটা ফেলে দিতে চেয়েছিলেন কয়েকবার, কারণ ফ্রেমসহ ছবিটা ছিল বেশ বড় ও ভারী।

বাড়ি ফিরে ইন্টারনেটে তিনি দেখতে গেলেন, যা কুড়িয়ে পেয়েছেন রাস্তায়, তা আসলে দামি কিছু কি না। তিনি যা দেখলেন, তাতে তার বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন, এই ছবিটি তিনি ফিরিয়ে দেবেন ছবির মালিক দুজনকে। তবে সে সময় এই দম্পতির পুরুষ সদস্যটি আর বেঁচে ছিলেন না।

ছবিটি নিলামে বিক্রি হয়েছিল এক হাজার ঊনপঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারে! ভাবতে পারেন?

আমাদের লেখক এলিজাবেত গিবসন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ডলার এবং নিলাম থেকে শতকরা হারে বিশাল পরিমাণ অর্থ।

২.

আবর্জনা স্তূপ সবসময় শুধু ‘আবর্জনা স্তূপ’ নয়, সে কথা বলার জন্যই উপরের গল্প তিনটি বলা। এখানে সত্যি যা ঘটেছে, তা নিত্যদিনের ঘটনা নয়। কিন্তু ঘটেছে তো! আবর্জনা ঘাঁটলেই যে কেউ লাখপতি, কোটিপতি হয়ে যাবেন- এমন নয়, কিন্তু কারো যদি ভাগ্য খুলে যায়, তাহলে তাকে ঠেকায় কে?

আমাদের দেশে এ রকম সৌভাগ্যবান হওয়ার সুযোগ কম। কিন্তু একেবারেই নেই, সে কথা বললে ভুল বলা হবে। এখানেও কেউ কোনো কিছু কুড়িয়ে পেলে মালিককে ফেরত দেয়ার নজির আছে। দরিদ্র রিকশা বা সিএনজিচালক নিজে এসে যাত্রীর ফেলে যাওয়া মূল্যবান জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন, এমন ঘটনাও আমরা পড়েছি পত্রিকায়, দেখেছি টেলিভিশনে। সৎ হওয়ার ব্যাপারটা নির্ভর করে আবহের ওপর। আমরা কি দেখছি না, বড় বড় সব কোম্পানি সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে টাকা দিনের পর দিন শোধ করছে না। সুযোগমতো পুনঃতফসিল করছে বার বার। ব্যাংক লুট হচ্ছে, কারখানা লুট হচ্ছে, জমি লুট হচ্ছে—কিন্তু তাদের পেশিশক্তির কাছে রাষ্ট্রও অসহায় হয়ে থাকে। এরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ সব কথা ভাবলে মনে হয়, দেশের ভবিষ্যৎ নেই আর। হুমায়ুন আজাদের কবিতাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে নিজের মতো করে বলা যায়- সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে।

কিন্তু এ রকম হতাশ হতেও মন চায় না। আবর্জনার স্তূপ খুঁড়ে না হোক, নিজেদের পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে আমাদের কৃষক, আমাদের উদ্যোক্তা, আমাদের শ্রমিক তো এমন কিছু কাজ করে চলেছেন, যা বিশ্ব পরিমণ্ডলেই ঈর্ষণীয়।

ধানে–মাছে আমরা তো কীভাবে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেলাম! সাড়ে সাত কোটি মানুষ বেড়ে ১৬ কোটি হয়েছে, ভূমির পরিমাণ বাড়ার কোনো সুযোগ নেই, তারই মধ্যে দেশের কৃষক, খামারি ধান আর মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ফার্মের মুরগি স্বল্পখরচে প্রোটিনের চাহিদা মেটাচ্ছে। একটু পরিকল্পনামাফিক চলার কারণে যে ইলিশ মাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পথে চলে গিয়েছিল, সেটাই কবছরের মধ্যে ফিরে এসেছে নদীতে। জালে আসছে মাছ।

সাফল্যের কথাগুলোও বলতে হবে। আর এই সাফল্যের মূল নায়ক খেটে খাওয়া মানুষই। যারা ঋণ নিয়ে তফসিল–পুনঃতফসিল করে, তারা এ দেশের নায়ক নয়, নায়ক ওই শ্রমজীবী মানুষটাই।

৩.

শেষের বলা কথাগুলোর সঙ্গে আবর্জনা স্তূপের গল্পটাকে কীভাবে একাত্ম করব?

খুব সহজভাবে।

ওই পেশিশক্তি আর দুর্নীতির কারিগরদের বলছি আবর্জনা স্তূপ।

আর নিজ পরিশ্রম ও মেধায় যারা দেশটাকে গড়ে তুলছে, সেই শ্রমজীবী মানুষটাই আসলে রুফিও তামাইয়োর দামি ছবিটি। সেই ছবিটি চিনে নিতে পারলেই আপনি ভাগ্যবান। বুঝতে পারবেন, আপনি সঠিক পথেই হাঁটছেন।

লেখক: গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর