জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা যখন মুজিববর্ষ পালন করছি, তখন ঠিক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই সুনামগঞ্জের সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ওপর একটি ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে গত কয়েক বছরের পরম্পরা বিশ্লেষণে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা আমাদের জন্য নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়।
বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে, কখনও ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের কোনো সদস্যের সামাজিক মাধ্যমে করা মন্তব্য অথবা এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে, আবার কখনও সাধারণ মানুষের নিছক ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহারের মাধ্যমে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে। সেদিক থেকে আলোচনা করতে হলে আসলে সুনামগঞ্জের এই ঘটনায় নতুন করে কিছুই বলার থাকে না, থেকে যায় দেশের তথাকথিত ‘সংখ্যাগুরু’ অংশের একজন সদস্য হিসেবে লজ্জাবোধ, যদি তা আদৌ অবশিষ্ট থেকে থাকে।
এই লেখাটির সঙ্গে সুনামগঞ্জের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও এই বিষয় লেখার মূল বিষয় নয়। বরং এই লেখার মূল আলোচনার জায়গা ফেসবুক নামক বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
সুনামগঞ্জে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পর খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেশের নানা স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সাধারণ জনগণ তথা ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই ঘটনার বিরুদ্ধে তাদের রাগ, ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুল ব্যবহারের এই যুগে আমাদের দেশের সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় দেশ ও দেশের বাইরের যেকোনো জনরায় আলোচিত কোনো ঘটনা ঘটলেই তা নিয়ে দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী নেটিজেনরা আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক-ট্রলিং এমনকি হুমকি ও হয়রানিতেও জড়িয়ে পড়েন অহরহ। আর তাই সুনামগঞ্জের ঘটনার পরও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি, যাকে খুব স্বাভাবিকই বলা যায়।
এর ভেতর অন্য একটি বিষয় ঘটে গেছে যা নিয়ে ফেইসবুকে বেশ আলোচনাও হচ্ছে। আর তা হলো, সুনামগঞ্জে এই হামলার নিন্দা ও সমালোচনা করে যারা ফেইসবুকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্ট্যাটাস পোস্ট ও শেয়ার করেছেন তাদের অনেকেরই ওইসব পোস্ট ও স্ট্যাটাস ফেসবুক সরিয়ে দিয়েছে কিংবা সেসব পোস্টের প্রাইভেসি ‘অনলি মি’ করে দিয়েছে, ফলে হয় সেসব পোস্ট হারিয়ে গেছে অথবা যার পোস্ট সে ছাড়া আর কারো সেটি দেখার উপায় অবশিষ্ট থাকেনি। ফেসবুক বলতে চাচ্ছে সুনামগঞ্জের ঘটনার নিন্দা ও সমালোচনা করে শেয়ার করা এসব পোস্টের মাধ্যমে ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডস লঙ্ঘিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে অন্যদের বিরুদ্ধে ‘হেইট স্পিচ’ ছড়ানো এবং অপমান করা হয়েছে। যাদের পোস্ট সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের অনেককে এই বলেও সতর্ক করা হয়েছে যে পুনরায় এমন কিছু পোস্ট করা হলে ওই ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করা হতে পারে। আর এখান থেকেই আসলে ফেসবুকের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনার একটি দ্বার খুলে যায়।
২০২০ সালের শেষের দিকে একটি ওভার দ্য টপ বা ওটিটি প্লাটফর্মে ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’ নামক একটি ডকুমেন্টারি মুক্তি পায়। এই ডকুমেন্টারিতে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রথম দিকের উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও কর্মী এবং অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিদের আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যোমগুলো তাদের ব্যবসা ও মুনাফা ধরে রাখার জন্য কীভাবে নিজেদের বিজনেস মডেল সাজিয়েছে ও তাকে রক্ষা করছে তা নিয়ে এক ধরনের ধারণা প্রদান করা হয়েছে। এই ডকুমেন্টারির একটি পর্যায়ে কোনো এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে অতীতে যুক্ত একজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর যে প্রবণতা তার ফলাফল কী হতে পারে? তখন সেই ব্যক্তি বলেছিলেন, এর ফলে বিভিন্ন স্থানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। কোন প্রেক্ষাপটে কীভাবে এটি হবে সে সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য মূল ডকুমেন্টারিটি দেখা যেতে পারে। এখানে তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম।
কিন্তু সুনামগঞ্জের ঘটনার পর বিভিন্ন মানুষের, তাদের সংখ্যা কম বা বেশি হোক, স্ট্যাটাস সরিয়ে দিয়ে ফেসবুক নতুন এক সম্ভাবনা সামনে এনেছে। এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যবহারকারীদের নেটওয়ার্কিংয়ের ধরন, প্রবণতা, চর্চা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবসা ও মুনাফা ধরে রাখার জন্য নিজেদের বিজনেস মডেল জারি রাখার উদ্দেশে গৃহযুদ্ধকে উসকে দেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমর্থন করছে না। কারণ গৃহযুদ্ধ ঘটাতে হলে অন্তত দু’টি পক্ষ থাকতেই হবে, আরও থাকতে হবে তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্স। কিন্তু যেহেতু অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও এখন ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধির ক্ষেত্র, বরং আরও বড় ক্ষেত্র, তাই গৃহযুদ্ধ উসকে দেয়ার চেয়ে অন্য কোনো পথে যদি বেশি মুনাফার সুযোগ থাকে তাহলে তাকেই কেন বেছে নেবে না এই জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো?
এক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের ঘটনায় ফেসবুকের আলোচনা থেকে এই হাইপোথিসিসে আসা যায় যে, ফেসবুক সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে থেকে নিজের ব্যবসাকে সমুন্নত রাখা ও মুনাফা বৃদ্ধি চলমান রাখার একটি পথ বেছে নিয়েছে বা সেই পথ যাচাই করে দেখছে। এক্ষেত্রে যে অঞ্চলে যেই বিশ্বাস বা চেতনার মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফেসবুক তার কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডস বা গাইডলাইনে শুধু তাদের কথাই ভাববে বা তাদের চেতনা ও বিশ্বাসকেই দাম দেবে। এক্ষেত্রে যারা ভিন্নমত, বক্তব্য বা আওয়াজ তুলবে, ফেসবুক নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে তাদের সেই প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্স তা যতটাই যৌক্তিক হোক না কেন, তাকে বাতিল করে দেবে কিংবা সামনে আসতে দেবে না। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের জন্য ফেসবুক বা এরপর ফেসবুকের এই মডেলকে অনুসরণ করে লাভবান হওয়া অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে উঠবে অসম্ভব পছন্দের সাইবার স্পেস। আর যারা এর বিপরীত মতের মানুষ, তাদেরকে নানাভাবে, কখনও রিপোর্ট, কখনও অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড কিংবা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডস-বিরোধী আখ্যা দিয়ে চুপ চুপ থাকতে অভ্যস্ত করে তোলা হবে। ফলে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সকল অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত হবে, এরই ফলে নিশ্চিত হবে সমগ্র বিশ্বের নেটিজেনদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যোমগুলোর নিজেদের বিজনেস মডেলের অধীনে নিয়ে আসা।
ফেসবুকের এমন প্রচেষ্টার যে হাইপোথিসিস তা অদূর ভবিষ্যতে ভুল বা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে পারে, তা হওয়াটাই আসলে হবে অত্যন্ত শুভ, কিন্তু যদি এই হাইপোথিসিস বা এর কাছাকাছি ধরনের কিছু সত্য হয়, তাহলে ফেসবুক ও সমকালীন সমাজ এবং নিকট ভবিষ্যতের সংকটগুলো নিয়ে অ্যাকাডেমিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রে ভাবা শুরু করা খুব বেশি জরুরি।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।