দুই ধরনের জন্মদিন আমরা সাধারণত পালন করে থাকি। আমাদের কাছে সেই জন্মদিনের বিশেষ কিছু গুরুত্ব রয়েছে। এক, শিশুদের জন্মদিন প্রায় সবাই পরিবারের শিশুদের আয়োজনের সঙ্গেই পালন করে থাকে। আজকাল অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল পরিবারও তাদের শিশুদের জন্মদিন পালন করতে চেষ্টা করে। জন্মদিন পালনের প্রতি শিশুদের দারুণ আগ্রহ। তারা অপেক্ষা করে থাকে কবে নিজের বা বড় ছোট ভাইবোনদের জন্মদিন আসবে।
জন্মদিন আসার আগেই বাবা-মার কাছে জন্মদিনের কেক, পোশাক, লাল রঙের টোপর এবং উপহারের নানা আবদার জানাতে থাকে। পরিবারের বয়স্করাও সন্তানদের জন্মদিন পালনকে বেশ ভালোভাবে নিয়ে থাকে। মূলত, ছোটদের আনন্দ, উৎসাহ এবং খুশি করার জন্য অভিভাবকরা শিশুদের জন্মদিনগুলো বিশেষভাবে পালন করে থাকে। বড় হতে হতে নিজেদের জন্মদিন অনেকে আর সেভাবে পালন করে না। তবে যদি নিজ দক্ষতা, মেধা এবং বিশেষ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে দেশে খ্যাতি অর্জন করেন তাহলে শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানান আবার কেউ যদি খ্যাতির শীর্ষচূড়ায় উঠে যান তাহলে তার জন্মদিনের কথা অনেকেই জানতে পারেন। তবে বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষই নিজের জন্মদিন নিয়ে খুব বেশি আনন্দ উৎসব করার চেষ্টা করেন না।
দুই, জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে যারা খুব বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে কেউ যদি আদর্শ দ্বারা বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেন তাহলে তার জন্মদিন পালনের কথা অনুসারীরা উচ্চারণ করেন, অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন। আধুনিক দুনিয়ায় শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখেন তাদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন কমবেশি সকলের কাছেই আলোচিত হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবেও এসব মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। প্রধান নেতা ছাড়াও তার সহযোগী গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা ব্যক্তিরও জন্মদিন জাতীয়ভাবে জন্ম বা মৃত্যুদিন পালিত না হলেও দিনগুলোতে তাদের স্মরণ করা হয়।
আজ ১৭ মার্চ। ১৯২০ সালের এ দিনে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফুর রহমান এবং সায়েরা খাতুনের পরিবারে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল তাকে আদর করে বাবা মা খোকা নামে ডাকতেন। পুরো নাম যদিও শেখ মুজিবুর রহমান রাখা হয়, কিন্তু বাবা মা এবং নিকটজন ও অন্যদের কাছে এই শিশুটি খোকা নামেই পরিচিত ছিলেন। পাশেই মধুমতি নদীতে একটু বড় হয়ে খোকা সাঁতার কাটত, খেলার মাঠে খেলত, দুরন্তপনাও তার মধ্যে বেশ ছিল। তবে কৈশোরে খোকা বেশ সাহসী এবং সমবয়সীদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকত। অন্য দু’চারজন ব্যতিক্রমী শিশু-কিশোরদের মতো খোকাও একটু বেশি সাহস, সততা এবং সমাজ সচেতনতায় আলাদা ছিলেন। তবে গোপালগঞ্জের সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই খোকা ধীরে ধীরে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে যাবেন কিংবা রাষ্ট্র-সমাজ, রাজনীতিতে এতটাই খ্যাতি অর্জন করবেন সেটি হয়তো খোকার পরিবারও তখন ভাবতে পারেনি। ওই যে বলছিলাম ব্যক্তিত্ব, মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বেড়ে উঠে যদি সবাইকে অবাক করে দেয়ার মতো কিছু করেন তাহলে তার জন্ম, মৃত্যুদিন তার পরিবার বা এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি ছুঁয়ে যায় দেশ, জাতি এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকেও।
সমকালীন পৃথিবীতে দেড়শ’রও বেশি রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সেই আন্দোলনের ইতিহাসে কোনো কোনো জাতির অনেক বড় নেতাও ছিলেন। আবার কোনো একজন নেতার দূরদর্শিতা, নেতৃত্বের পারদর্শিতার কারণে স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে। আবার ভিন্ন রকমের ইতিহাসও অনেক দেশের রয়েছে। সেই ইতিহাস সৃষ্টিতে প্রধান নেতা জনগণকে কতটা সম্পৃক্ত করতে পারেন তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ইতিহাসের এই জটিল পথচলা অনেকের পক্ষেই বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। রাজনীতির পথ খুবই আঁকাবাঁকা। সেটি যদি স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তো কথা-ই নেই। অনেক ত্যাগ, আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্তক্ষয় ইত্যাদির মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসটি আরও জটিল।
ব্রিটিশ শাসনের কাছ থেকে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ১৯৪৭ সালে যে দেশটি আমরা লাভ করেছিলাম- সেটির নাম পাকিস্তান। পাকিস্তান লাভের বিষয়কে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা বলতে পারছে না। কারণ, স্বাধীনতার অধিকারগুলো পূর্ব বাংলায় কার্যকর ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিকশ্রেণি পূর্ব বাংলায় তাদের শাসন-শোষণ ঔপনিবেশিক ধাঁচে প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠা করছিল। একইসঙ্গে রাষ্ট্রটিকে ভয়ানক এক সাম্প্রদায়িক চরিত্রে পরিচালিত করছিল- যেখানে পূর্ব বাংলার জনগণের ধর্মীয় পরিচয়ও তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এহেন রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা, আন্দোলন সংগ্রাম এবং শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করা ইতিহাসে নজিরবিহীন। সেই নজিরবিহীন কাজটি করতে যাওয়া মোটেও সহজ ছিল না।
বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গীয় নেতাই পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত থাকাকালে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের কারো কারো মধ্যে পাকিস্তান নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও পাকিস্তান থেকে বের হওয়া, কিংবা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা অর্জন করার কথা কল্পনা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। সে কারণেই বেশিরভাগ বড় নেতাই পাকিস্তানকে মেনে নেয়ার মধ্যেই আটকে পড়েছিলেন। শাসনক্ষমতায় তাদের অংশীদারত্বের সুযোগ না ঘটলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্দোলন করার মানসিকতাও অনেকের মধ্যে ছিল না। তবে পূর্ব বাংলার জনগণের ভোটের অধিকার, দ্রব্যমূল্যের ন্যায্যমূল্য, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি কিছু বিষয়ে কিছু নেতাকে দু’চার বছরের জন্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে বড় ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রবীণ নেতাদের কাউকেই তেমন পাওয়া যায়নি।
একমাত্র ব্যতিক্রম রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ সাল থেকেই তরুণ ছাত্র ও যুব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহস, দেশপ্রেম, সাংগঠনিক দক্ষতা, জেল কারাগার ভোগ করার মানসিকতা ইত্যাদিতে একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে থাকলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তিনি সরব হলেন, ছাত্র সংগঠন গড়ে তুললেন। নিজেই দাবিনামা বিলি করলেন আবার মিছিলেও নেতৃত্ব দিলেন। ১৯৪৮ সালেই প্রথম গ্রেপ্তার হলেন। মুক্ত হয়ে আবারও তিনি আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন।
মুজিব কিন্তু রাজনীতিতে আকস্মিকভাবে আসেননি। তিনি কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। সান্নিধ্য লাভ করেন অনেক বড় নেতার, শেখেন স্বাধীনতার লড়াই, আন্দোলন ও প্রয়োজনীয়তা কীভাবে বুঝতে হয়, শিখতে হয় তার সবকিছুই চল্লিশের দশকে কলকাতায় থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন। তার তখন স্বাধীনতা সম্পর্কে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল দেশভাগের ফলে। নেতাদের দূরদর্শিতার অভাব তিনি লক্ষ করেছেন। সুতরাং স্বাধীনতার জন্য কী করতে হয়, কী করা উচিত শেখ মুজিব তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এসব অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। ঢাকায় তিনি চাকরি খুঁজতে কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আসেননি। এসেছিলেন পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করার জন্য। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুবলীগের সম্মেলনে যোগদান করে তিনি ভাষা আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করলেন।
১৯৪৮ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করানোর একে একে উদ্যোগ নিলেন। এরপর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে তাকে আবার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সেই সময়েই ২৩ জুনে আওয়ামী লীগ জন্ম নেয়। মওলানা ভাসানী এর প্রধান, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, জেলে বন্দি শেখ মুজিব যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হলেন।
এরপর ২৬ জুনে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন শেখ মুজিব। মুক্ত মুজিব নতুন করে সংগঠনকে জেলা মহকুমা ও থানা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সাংগঠনিক উদ্যোগ নিতে থাকেন। পাকিস্তান সরকার মুজিবের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতাকে পাকিস্তানের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। তাকে ৩১ ডিসেম্বর আটক করা হয়। নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে ২ বছর ২ মাসের মতো কারাগারে আটক রাখা হয়। আবার মুক্ত হয়ে তিনি স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অধিকার, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা, কৃষক শ্রমিকের মজুরি খাদ্য ইত্যাদির দাবিতে পূর্ব বাংলায় সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। ততদিনে মুজিব বয়োজ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ সকলেরই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। গঠিত হয় ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট, ২১ দফা দাবিতে
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। শের-এ-বাংলাকে মুখ্যমন্ত্রী করে যে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয় সেটিকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিতে চায়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে দেয়া হয় প্রাদেশিক সরকার। ফজলুল হক গৃহবন্দি হন, শেখ মুজিবকে জেলে পাঠানো হয়। অন্য কোনো নেতাই এর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন দাঁড় করাতে রাস্তায় নামেননি। শেখ মুজিব তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার জন্য যারা তদবির করেছিলেন তারা যদি জনগণকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিত তাহলে পাকিস্তানের রাজনীতি অন্যরকম হয়ে যেত। জনগণ প্রস্তুত ছিল কিন্তু নেতারা ভীতু ছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে, শেখ মুজিব বাইরে থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন সংগঠিত করা হবে। সে কারণেই তাকে জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারের আন্দোলন এবং সংগ্রামে বিশ্বাসীদের সঙ্গে ঐক্যজোট গড়ে তুললেন।
পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সেই সংকটকালে আতাউর রহমানকে মুখ্যমন্ত্রী করে যে সরকার গঠিত হয় সেটি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনসহ অনেকগুলো অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলো। কেন্দ্রে তখন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান পার্টির সরকার। ফলে প্রায় ১১ মাস পাকিস্তানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয়ে যায়, বৈদেশিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, পাকিস্তান স্বল্প সময়ের জন্য হলেও গণতান্ত্রিক আবহ কিছুটা ফিরে পায়। এর পেছনে ছিল সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবের মিলিত প্রচেষ্টা। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার এটিকে প্রতিহত করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। অবশেষ ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, শেখ মুজিব আবার জেলে যান। মুক্ত হয়ে আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ততদিনে অনেক নেতাই আর জীবিত নেই কিংবা রাজনীতিতে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারের লড়াইয়ে নেই।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর শেখ মুজিব ছয় দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার দাবি করলেন। এটিকে ধ্বংস করতে দমন-নিপীড়ন ব্যাপকভাবে শুরু হয়। অনেক বড় নেতাই তখন দূরে সরে যান। আওয়ামী লীগকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল না হয়ে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়।
এই মামলায় পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। বছর শেষে আওয়ামী লীগ দুই ন্যাপ ঐক্য গড়ে ওঠে, ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১৯৬৯ সালে, ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন দুই মাসেই গণ- অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এতে অসংখ্য মানুষ পাকিস্তানিদের গুলিতে শহিদ হন। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
শেখ মুজিব বিজয়ীর বেশে কারগার থেকে মুক্ত হন, ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিজয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে তখন বঙ্গবন্ধু। তিনি আদায় করে নিলেন পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন।
৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে তিনি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় পরাজয় এবার ঘটল। বঙ্গবন্ধু তখন ছয় দফাকে এক দফায় রূপান্তরিত করার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। সেই ঘোষণার পরেই মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলো একে একে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পথ রচনায় এগিয়ে চলতে থাকল। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু সবই বললেন, স্বাধীনতার ঘোষণাও চমৎকারভাবে দিলেন। রাষ্ট্রনায়ক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক আর স্বাধীনতার নেতা এভাবেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
২৫ মার্চে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই ঐক্য ভেঙে আলাদা করতে চেয়েছিল। গণহত্যার মাধ্যমে ভিত্তি তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অমর কবিতাখানি পঠিত হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং তার অবর্তমানে অনুসারীরা শক্ত হাতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করলেন। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলো, পাকিস্তানের পরাজয় ঘটল। মুক্ত স্বদেশে তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ফিরলেন। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশটাকে তিনি গঠন করার সকল উদ্যোগ নিলেন। কাজটি সুকঠিন ছিল। কিন্তু তিনি সেই কঠিন চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এগোচ্ছিলেন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ তাকে হত্যা করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকেও হত্যা করে।
মাত্র ৫৫ বছর ৫ মাসের এই জীবনে টুঙ্গীপাড়ার খোকা, শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা কীভাবে আমাদের রাষ্ট্রটিকে আমাদের জন্য করে গেলেন। নিজের জীবনের সবকিছু তিনি উৎসর্গ করে গেলেন। এই উৎসর্গীকৃত নেতার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ ৫০ বছর পার করতে চলছে এর মধ্যে তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরার দায়িত্ব নিলেন। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় ফেরার চেষ্টা হচ্ছে। এ বছর রাষ্ট্রের ৫০ বছরপূর্তি আর জাতির পিতার শত বছরের জন্মোৎসব একাকার হয়ে গেল। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু এভাবেই তৈরি হয়েছে এখন আমাদেরই দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক, কলাম লেখক