১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইমস’ পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘পয়েট অব পলিটিকস’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল।
আমেরিকান মিশনারি জেনিন লকারবি তার ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটছে, যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির স্বাদ দেবে, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আদর করে ডাকা হয় ‘মুজিব’।
ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের সদস্য ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধা ফেনার ব্রুকওয়ে বলেন, ‘তাকে হত্যা করা ছিল মানব হত্যার চেয়ে অনেক বড় অপরাধ। শেখ মুজিব শুধু তার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেননি। তিনি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও সংগ্রাম করেছিলেন।’
এভাবেই সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ, বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমের কাছে পরিচিত ছিলেন বাঙালির এই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। একজন অবিসংবাদিত নেতা। দেশের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও স্বাধীনতা অর্জনে তিনি তার জীবনের প্রায় ১৪টি বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার সেলে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর কোনো দমন-নিপীড়ন তাকে দমাতে পারেনি এতটুকুও।
১৯৬৮ সাল; প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণসর্মথন লাভ করে। শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কোণঠাসা করে তোলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে।
১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে একটি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করে। এই ঐতিহাসিক মামলায় শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং পাকিস্তান বিভক্তিকরণ এর মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ-আন্দোলনই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান নামে পরিচিত, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের পথকে সুগম করেছে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করার ডাক দেন। এরপর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহহিয়া খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। জাতির পিতা পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি।
মাত্র ৫৫ বছর বয়সের জীবনে এক-চতুর্থাংশ কেটেছে অন্ধকার কারাগারে; কিন্তু তাতেও এতটুকু বিচলিত দেখা যায়নি মহান এই নেতাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। পরাধীন জাতিকে তিনি স্বাধীনতার গান শিখিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর বুকে এঁকেছেন নতুন একটি মানচিত্র, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। তিনি বাংলার আকাশে উড়িয়েছেন লাল-সবুজের এক নতুন পতাকা।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে নিখাদ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, তা কোনো দিনই পরিমাপ করা যাবে না। বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার জন্য জেল-জুলুম-হুলিয়া-অত্যাচার-নির্যাতন; এমনকি ফাঁসির মঞ্চকেও তুচ্ছ করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলতেন: ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে; কিন্তু বাংলার মানুষকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা আমাকে হত্যা করলে লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে।’ সত্যিই বঙ্গবন্ধু ছিলেন মৃত্যুহীন প্রাণ। আর তাই তো আজও নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম অনুস্মরণীয়৷ বঙ্গবন্ধু তারুণদের কাছে একজন আদর্শ নেতা৷ তার ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, গুণাবলি বাঙালির কাছে অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল৷
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সহকারী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিকট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।