বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিএনপির অবাঞ্ছিত আচরণ

  •    
  • ১৪ মার্চ, ২০২১ ১৫:০৩

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যাদের পরিপূর্ণভাবে জানা আছে, কিংবা নতুন প্রজন্মের যেসব তরুণ-তরুণী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গত কয়েক বছরে মৌলিক বইপুস্তক পড়াশোনা এবং দলিলাদি দেখার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে তারাও বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার বক্তব্যে যথেষ্ট স্ববিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন, হতবাকও হচ্ছেন। অবশ্য বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি লোকদেখানো আচরণ, একই সঙ্গে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দলে আশ্রয় দেয়া, তোষণ-পোষণ করার দ্বৈত নীতি প্রদর্শনের বিষয়গুলো কারও কাছেই খুব একটা অস্পষ্ট বা অজানা ছিল না।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে গত ১ মার্চ তারিখ থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এটি তাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরব্যাপী কর্মসূচির অংশ বলে নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন। বিএনপি এসব অনুষ্ঠান পালনের কর্মসূচি ঘোষণার পর কেউ কেউ এটিকে স্বাগত জানিয়েছিল, আবার কেউ কেউ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তব্য গভীরভাবে শোনার প্রতীক্ষায় ছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রথমদিকে স্বাগত জানালেও পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তির অভিযোগ যথার্থভাবে তুলে ধরে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যাদের পরিপূর্ণভাবে জানা আছে, কিংবা নতুন প্রজন্মের যেসব তরুণ-তরুণী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গত কয়েক বছরে মৌলিক বইপুস্তক পড়াশোনা এবং দলিলাদি দেখার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে তারাও বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার বক্তব্যে যথেষ্ট স্ববিরোধিতা খুঁজে পাচ্ছেন, হতবাকও হচ্ছেন। অবশ্য বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি লোক দেখানো আচরণ, একইসঙ্গে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দলে আশ্রয় দেয়া, তোষণ-পোষণ করার দ্বৈত নীতি প্রদর্শনের বিষয়গুলো কারো কাছেই খুব একটা অস্পষ্ট বা অজানা ছিল না। তাছাড়া বিএনপির বেশকিছু নেতা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে কোনো ভূমিকা না রেখেও সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে ‘দরদ’ ও ‘আন্তরিকতা’ দেখাচ্ছেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব কথাবার্তা নেতৃবৃন্দ বলছেন, সেগুলোর মধ্যে নানা ধরনের ইতিহাস বিকৃতি, দ্বিচারিতা ও স্ববিরোধিতা স্পষ্ট গণমাধ্যমে পাঠক-শ্রোতারা লক্ষ করছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ৭ মার্চ ইত্যাদি ঐতিহাসিক দিবস ছাড়াও প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো অঙ্গসংগঠনের আয়োজিত কর্মসূচি অথবা আলোচনা সভায় যোগদান ও বক্তৃতা প্রদান করে আসছেন। ৭ মার্চ যুবদলের আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

অথচ ৭ মার্চ পালনের বিষয়টি যদি শ্রদ্ধা ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তা দলের কেন্দ্রীয় তথা জাতীয় কমিটির উদ্যোগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যুবদলের আয়োজনে যখন অনুষ্ঠানটি করা হয় তখন এতে শ্রদ্ধার কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। সেই অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতৃবৃন্দ ৭ মার্চের গুরুত্বকে কতটা ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক বাস্তবতায় মূল্যায়ন করেছেন সেটি মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ জানতে পেরেছে। কোনো অবস্থাতেই বলা যাবে না বিএনপি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্বকে শ্রদ্ধা করার জন্য আলোচনায় অংশ নিয়েছিল।

মির্জা আব্বাস তার বক্তৃতায় বলেছেন যে, তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাঠিসহ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন। তার এই বক্তব্য শুনে কতজন মির্জা আব্বাসকে প্রশংসা করেছেন জানি না। তবে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণা কীভাবে কতটুকু দেওয়া হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে কীভাবে স্বাধীনতার জন্য জনগণকে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে- বঙ্গবন্ধুর এমন আহ্বানের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যন্তরে থেকে এর চাইতে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে আর কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতৃত্বদানকারী নেতা বাংলাদেশে দেয়ার মতো তখন বা কোনো কালে ছিলেন বলে কেউ বলতে পারবে না।

বিএনপির মহাসচিব দাবি করেছিলেন যে, জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা না করলে নাকি মুক্তিযুদ্ধ শুরুই হতো না, স্বাধীনতাও অর্জিত হতো না। অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম ১৩ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ড্যাব আয়োজিত রক্তদান কর্মসূচি অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন একটি ভাষণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। তার এই কথায় তিনি কতটা স্ববিরোধিতা করেছেন তা তাকেই বুঝতে হবে।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে তিনি ছোট করে দেখেছেন, অথচ জিয়াউর রহমানের একটি বেতার ভাষণকে তিনি এবং অন্য নেতারাও কতটা অতি মূল্যায়ন করেছেন সেটি তাদের ভেবে দেখার সময় হবে কি? তিনি ওই অনুষ্ঠানে আরও বলেছেন যে, আমরা সংগ্রাম করেছি, ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, এখন আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন দাবি কেউ করছে না। তিনিও সরাসরি বলছেন না। তাহলে তিনি কাদের কথা বলছেন তার এই বক্তব্যে সততার অভাব কতটা রয়েছে সেটি বোধহয় এখনকার তরুণরাও বুঝতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স নিশ্চয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি গেলেন না কেন বা দেশের অভ্যন্তরে থেকেও অংশ নিলেন না কেন সেই প্রশ্নের উত্তর তিনিই ভালো দিতে পারবেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি’ তখন তার মধ্যে দ্বিচারিতার যে প্রমাণটি দেখা যায় সেটি মোটেও কাম্য ছিল না। বিএনপির অপর সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২/৩টি অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে দাবি করেছেন যে, আওয়ামী লীগ যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, বিএনপি সেখানে সফল হয়েছে।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানে যদি ব্যর্থ হতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনাতে সংবিধান প্রদান, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, খুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন, যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের পুনর্গঠন, ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে চার লাখ মানুষকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের চাকরিতে বহাল করা, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়, প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহকুমা ও জেলা প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে যে কঠিন সময়টি অতিক্রম করেছে সেটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশে যুদ্ধের পর অন্য কারো পক্ষে সহজ হতো কি না মস্তবড় জিজ্ঞাসা রয়েছে।

বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল একটি হতদরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থা তথা ৯৩ ডলার বাৎসরিক মাথাপিছু আয় নিয়ে। ১৯৭৫ সালের জুনে এটি দাঁড়িয়ে ছিল ২৭৫ ডলারে। ফলে বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশের স্বীকৃতিও এই সময়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকে অর্জন করেছিল।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেসব পরিবর্তন এসেছিল তাতে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৯৭৫-৭৬ সালে ১০০ ডলারেরও বেশি কমে গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেটি ১৯৭৫ সালের চাইতে ১৫০ ডলারের মতো কমে যায়। এরপরও বাংলাদেশে সাফল্য নিয়ে কল্পোকাহিনি ছাড়া সত্যিকারের উন্নয়ন কতটা হয়েছিল তা সকলেরই জানা। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত তেমন আকর্ষণীয় হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিদেশনির্ভরতা কতটা কমাতে পেরেছিল, মাথাপিছু আয় কতটা বাড়াতে পেরেছিল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদি কতটা চালু করতে পেরেছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটা বৃদ্ধি করতে পেরেছিল, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিচুক্তি সম্পাদন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করতে পেরেছিল সেটি স্মরণ করার বিষয়। কিন্তু ২০০১-২০০৬ সাল জোট সরকারের শাসন আমলে খাদ্যঘাটতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, গ্রেনেড হামলা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতা এবং ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যেসব সংকট তৈরি করা হয়েছিল সেটি বোধহয় দেশের উন্নতির পক্ষে যায়নি।

অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়ার কারণে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, শহর, নগর ও গ্রামের জীবন ব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, একইসঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের বিষয়টি যেভাবে বাংলাদেশে ঘটেছে তার ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এখন মধ্যম আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সুপারিশ জাতিসংঘের মাধ্যমে লাভ করেছে। বাংলাদেশ এই করোনা মোকাবিলাতেও প্রশংসা অর্জন করেছে, অর্থনীতি সফলভাবে যে পাঁচটি দেশ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এছাড়া বাংলাদেশে এখন বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে।

আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা থাকলেও দেশ পরিচালনায় যেসব সাফল্য বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার আমলে এ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে তা বিএনপি হয়তো চোখ বন্ধ করে অস্বীকার করতে চাইবে। কিন্তু দেশ এবং বিদেশের পর্যবেক্ষকগণ তা বোধহয় করছেন না।

বিএনপি নেতৃবৃন্দ কোনো একটি আলোচনা সভায় বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অনেকেই লড়াই করেছেন। তারা সবাইকেই ঐতিহাসিক স্থানে মর্যাদা দিতে চান। মির্জা ফখরুল ইসলাম সেই তালিকায় শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ আর কজনের নাম উচ্চারণ করেছেন। এভাবে তার ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদাদানের বিষয়টি কোনো ইতিহাসবেত্তা আদৌ সমর্থন করবে কি?

পাকিস্তানকালে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধিকার আন্দোলনের কথা বলে মির্জা ফখরুল এবং খন্দকার মোশাররফ সাহেব কখনও নামগুলোকে মিশিয়েছেন আবার কখনও কারো নাম উল্লেখ না করে অস্পষ্টতা তৈরি করেছেন। ইতিহাসের চরম সত্য হলো পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ পর্যন্ত একটি পর্ব হিসেবে ছিল। এই পর্বে ছাত্রনেরা, ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অপেক্ষাকৃত বয়সে প্রবীণরাও যুক্ত ছিলেন। তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নির্যাতন এবং জাতিগত বিরোধ ইত্যাদি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আওয়ামী লীগের সৃষ্টি এবং যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন এবং ১৯৫৭-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে সবচাইতে বেশি জেল ও কারাবন্দি জীবন ভোগ করতে হয়েছে তরুণ নেতা শেখ মুজিব এবং মওলানা ভাসানীকে।

শের-এ-বাংলা পাকিস্তান আমলে স্বাধিকারের আন্দোলন বা স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার হওয়ার অবস্থানে রাজনীতি করেননি। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে যতদিন ছিলেন, ততদিন আওয়ামী লীগের দাবি হিসেবে এর বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু কাগমারী সম্মেলনের পর তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করে তিনি বামধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর তিনি আইয়ুব খানের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াননি, চীনা নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। সুতরাং ভাসানীর রাজনীতি ষাটের দশকে আইয়ুবের বিশ্বাসভাজনের বাইরে খুব বেশি এগোতে পারেনি।

একমাত্র শেখ মুজিব সামরিক শাসন শুরুর পর জেল থেকে বের হয়ে নিষিদ্ধ রাজনীতিতে আবার স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা শুরু করেন। ততদিনে একে ফজলুল হক সোহরাওয়ার্দীর জীবনাবসান ঘটে। মওলানা ভাসানী বাম রাজনীতি নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ছয় দফার মাধ্যমে তীব্রতর করার উদ্যোগ নেন। এই সময় মওলানা ভাসানীসহ মুসলিম লীগ, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ছয় দফাকে সিআইয়ের দলিল ইত্যাদি নামে অভিহিত করে।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব খান, শেখ মুজিব এবং ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তখনও পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে অংশ নেননি বরং চরম বিরোধিতাই করেছিল।

১৯৬৮ সালে সেপ্টেম্বর অক্টোবরের দিকে ওয়ালী ন্যাপ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করার উদ্যোগ নেয়। তখনও ভাসানীও তাতে যুক্ত হন। এরপর ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ১১ দফা পেশ করে। শুরু হয় ৬ দফা ও ১১ দফা নামে গণ-আন্দোলন। যা অচিরেই গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এই আন্দোলনে ভাসানীসহ অনেকেই যুক্ত ছিলেন। আইয়ুব খান শেষ পর্যন্ত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়, শেখ মুজিব জেল থেকে বের হন এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের বিজয়ী নেতা।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছয় দফার পক্ষে তিনি গণরায় লাভ করেন। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমান তখন এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন। তিনি আর শের-এ-বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীর পরের সারির নেতা ছিলেন না। বরং সবাইকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠলেন এই সময়ের প্রধান নেতারূপে। সে কারণেই ছয় দফা থেকে এক দফার আন্দোলনকে ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি প্রতিদিন সংগঠিত করতে থাকেন।

পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, এগুলো কোনোটিই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলার বাইরের কোনো আলাদা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনো একক কর্ম ছিল না। এগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলনকে নেতৃত্বদানকারী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমর্থনপুষ্ট কর্মযজ্ঞ, যা ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে নতুন ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধু জনগণের কাছে উত্থাপন করেন। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী বীর নেতা এভাবেই বীরদর্পে অগ্রসর হন। তিনি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। ঘরে বসে কেউ আত্মসমর্পণ করে না। থানায় কিংবা কোর্টে গিয়ে ধরা দিলেই কেবল আত্মসমর্পণ হয়। জনগণের নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন তার নেতাকর্মীদের স্বাধীনতার জন্য যা যা করণীয় দরকার তা জানিয়ে দেন। স্বাধীনতার একটি বার্তাও তিনি প্রচার করেন যা ২৬ তারিখ সারা বিশ্ব জানতে পারে। এ কারণেই ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে ২৬ মার্চ তারিখে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন এবং শেখ মুজিবকে এর জন্য শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দেন। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিব অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে অতিক্রম করে ষাটের দশকেই অগ্রসর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রেরণাদাতা হিসেবে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়। মনে হয় ইতিহাসের এই মূল্যায়নটি বিএনপির পছন্দ হবে না, তবে ইতিহাসে এভাবেই নেতা ও জনতার ভূমিকা নির্ধারিত হয়।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর