২০২১ সালে করোনা-পরবর্তী নতুন আশা নিয়ে বুক বেঁধেছে বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনগণ তার ব্যতিক্রম নয়। হবেই বা কেন? আমরা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে না গিয়ে নিশ্চিন্তে বলতে পারি, ২০২০ সালের বৈশ্বিক মহামারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছি। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের প্রতি আল্লাহর খাস নেয়ামত ও রহমত আছে।
এসবের সঙ্গে ১৫ আগস্টের যোগসূত্র কোথায়? ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় কালো দিবস ও জাতীয় লজ্জা। স্বাধীন বাংলাদেশের দুই-দুইজন রাষ্ট্রপতি দেশ স্বাধীনের এক যুগের মাঝে নৃশংসভাবে খুন হওয়া আমাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে অমোচনীয় কলঙ্কের ললাট টিপ। অধুনা ১৫ আগস্টের কথা স্মরণ করিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকি বাংলাদেশের অভ্যম্তরীণ বিষয় ভাবাটা অযৌক্তিক কেন, তা বুঝতে চলুন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের অবস্থান বুঝে নিই।
রাজনীতি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং শীতকাল এলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দান ও আবহাওয়া গরম হয়। এটা আমার মতো পঞ্চাশোর্ধ্ব সবাই জানি ও বুঝি। ইদানীংকালের বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা সমষ্টিগতভাবে এ দেশের জনগণকে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলছে বিধায় আজকের এই শঙ্কা প্রকাশমূলক লেখনী। আমরা সাধারণ জনগণকে বেকুব ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাই না।
বাংলাদেশ নিয়ে আজ শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিদেশেও অনেককে বেশ পেরেশান দেখে মন্দের মাঝেও পুলকিত হই। বেশ কিছু বৈশ্বিক পরিবর্তনের হাওয়ার আঁচ লাখো শহীদের সোনার বাংলাকেও স্পর্শ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
আমেরিকার জো বাইডেন প্রশাসন, মিয়ানমারে অং সান সু চিকে অপসারণ করে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর, চীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চুক্তিসমূহ-সবকিছুর একটি যোগসূত্র আছে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত খোঁচাখুঁচি তাই কেবল আমাদের বা মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন আর নেই। চীন, রাশিয়া, ভারত, আমেরিকার ইশারায় বাঁধতে পারে এই খোঁচাখুঁচি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া, বাংলাদেশ চীন বাণিজ্য সম্পর্ক, ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক, আমেরিকার নয়া প্রশাসন বাংলাদেশকে ভারতীয় চোখে না দেখার সিদ্ধান্ত এবং আমেরিকার আধিপত্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় হারানো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সবার কাছেই একটি গুরুত্ব বহন করছে। এদিকে চীন কর্তৃক ‘চিকেন নেক’-এ তাদের সরব উপস্থিতি ভারতকে হুমকির মুখে ফেলা, এনআরসির কারণে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে অসন্তোষ, তিস্তার চুক্তি ভারত কর্তৃক বহুদিন ঝুলিয়ে রাখার সময়ে চীন সরকার কর্তৃক তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং সামরিক বিশ্লেষণে উপমহাদেশে ভারতের বাংলাদেশ ব্যাতিরেকে সব মিত্র হারানো এবং আধিপত্য হারানো– এসব কারণেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নিয়ে হয়তো সবার এত আগ্রহ।
এর সাথে আল জাজিরা এপিসোড দ্বারা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে প্রশ্নবোধক করে তোলার চেষ্টা বা অপচেষ্টা, বিদেশে বসে একটি দল রাত-দিন গোয়েবলস তত্ত্ব দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাতে এদের সফলতা, আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসব ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথমে আমলে না নেয়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত হওয়া। এসব কিছুতে কারও কোনো সমস্যা নেই।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটা জনগণের মৌলিক অধিকার। জনগণ নির্ধারণ করবে সরকারি দলের কর্মকাণ্ডের আমলনামা এবং বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড স্বাধীন নির্বাচনের ব্যালটের মাধ্যমে।
তবে হ্যাঁ, ক্ষমতাশীল দল বলি আর বিরোধী দল যাই বলি না কেন, সংসদ নির্বাচনে যত দিন প্রার্থী হতে কোটি কোটি টাকা/মনোনয়ন বাণিজ্য এবং কালোটাকা ঢালার অভ্যেস আমরা পরিহার করতে না পারব, তত দিন গণতন্ত্র লুটেরা শ্রেণির হাতেই থাকবে। হাইব্রিড নেতাদের দাপটে নিবেদিত সৎ মাঠপর্যায়ের নেতারা বঞ্চিত হবেন। এর দ্বারা সব প্রজন্মের নেতা কিংবা কর্মীগণ আগ্রহ হারাবে রাজনীতি থেকে।
সবারই ভাব, আমি তো আছি ভালোই। অন্যের প্রতি জুলুম হলে তাতে আমার কী?
সপ্তাহ খানেক আগে পরিচিত এক সহকর্মী যিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একদা প্রধান নিরাপত্তা সমন্বয়ক ছিলেন, তিনি একটি দোয়া মাহফিলে দুঃখপ্রকাশ করে বলছিলেন, ২০১৮-এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ২০-২৫টি আসনের মনোনয়ন অর্থের বিনিময়ে হয়। কিন্তু সেই অর্থ আদৌ তারেক রহমান পেয়েছেন কি না, তাতে তার সন্দেহ আছে অনেক। এই ভদ্রলোক নিজেও তার এলাকা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েও এই কারণে সুযোগবঞ্চিত হয়েছেন। তার আনুগত্য খালেদা জিয়ার প্রতি এবং তিনি তারেক রহমানের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কিছু উপদেষ্টা কর্তৃক বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে নিবেদিত জাতীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নেতাকে বিএনপি কর্তৃক ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত অবহেলায় চরম দুঃখপ্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগেও নিশ্চয়ই এমন উদাহরণ আছে। না হলে নোয়াখালীতে এই দলের সাধারণ সম্পাদকের আপন ভাই মির্জা কাদের বনাম বর্তমান সাংসদ একরামের দ্বন্দ্ব, নারায়ণগঞ্জে সাংসদ শামীম ওসমান ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব কিসের ইঙ্গিত বহন করে? দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এদের কি শায়েস্তা করে ঝি-কে মেরে বউকে শিক্ষা দেয়ার প্রচলন প্রবর্তন করা হয়েছে?
এবার আসি, মূল প্রসঙ্গে। রাজশাহীতে বিএনপির সভায় রাজশাহীর সাবেক মেয়র এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু কর্তৃক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাবলিকলি ১৫ আগস্টের কথা মনে করিয়ে দেওয়া বক্তব্যে আমি, আমরা এবং অনেকেই বিস্মিত, চিন্তিত। সত্য বলতে কী, ওনার কাছ থেকে এমন হুমকি প্রত্যাশা করিনি।
বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো অবকাশ নেই। এটা কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়। বিশেষ করে বর্তমান অবস্থার আলোকে এটা বিশ্লেষণ অতীব জরুরি।
আমরা কি তবে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছি? আমরা কি আবারও দেশে গন্ডগোল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় শঙ্কার দিকে ধাবিত হচ্ছি? আমরা কি রাজনৈতিক নেতাদের অপরিনাম এবং অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডের বলী হতে যাচ্ছি? আমরা কি আফগানিস্থান টাইপ বাংলাদেশের দিকে এগোচ্ছি? আমরা কি বিশ্বের তিন সুপার পাওয়ারের রিমোট যন্ত্রে বলী দিতে চলছি আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সব অর্জনকে?
আজ এ পর্যন্তই। এই হুমকি বিশ্লেষণে আপনাদের স্বীয় মেধা, যুক্তি, তথ্য বিশ্লেষণের দ্বায়ভার আপনাদের কাধে দিয়ে মুক্তি চাই।
আল্লাহ হাফেজ।
লেখক: কলামিস্ট, সাবেক সেনা কর্মকর্তা