মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশের মিটিকিনা শহরে ক্যাথলিক সিস্টার অ্যান রোজ নু থং যখন আর্মড পুলিশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কিশোর তরুণদের হত্যা না করে তাকে হত্যার আকুতি জানিয়েছিলেন, তখনও হয়ত কাচিন প্রদেশের বাতাসের কোথাও কোনো গতিবেগের তারতম্য ঘটেনি। নড়ে ওঠেনি কোনো গাছের পাতা। এমনকি কোনো একটি গাছের পাতার আড়ালে থাকা কোনো পাখিও উচ্চস্বরে ডেকে ওঠেনি। শুধুমাত্র এএফপির ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটটি এক ঝলক জ্বলে উঠেছিল। আর কিছু সেল ফোন করেছিল অ্যান রোজের আকুতির ভিডিও। তারপরে তা ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর প্রচার করেছে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো বড় বড় মিডিয়া হাউজ। বলা যেতে পারে, প্রচার পেয়েছে এই আত্মহুতির আকুতি দিয়ে গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলনরত মিয়ানমারের তরুণ ও কিশোরদের বাঁচানোর এক আকুতি। প্রচার পেয়েছে অ্যান রোজ নু থংয়ের বর্ণনায় পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রক্তাক্ত মানুষের দৃশ্যগুলো।
তবে এর ফলে যে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের দমননীতি কমবে, এ কথা কেউ মনে করে না। কারণ সব দেশে সব সময়ই সামরিক সরকাররা, স্বৈরতন্ত্রী, একনায়কতন্ত্রী সরকাররা টিকে থাকে এভাবেই। মানুষের জীবন আর পাখির জীবন তাদের কাছে একই রকম। তবু মানুষ মাঝে মাঝে এমনি গণতন্ত্রের জন্যে ফুঁসে ওঠে, পৃথিবীর দেশে দেশে। আর সেখানে কখনও কখনও রাজপথে নেমে আসে এমনি অ্যান রোজরা। যেমন ৮ মার্চ ২০২১, কাচিন প্রদেশের মিটিকিনা শহরে জীবনের সকল মায়াকে পেছনে ফেলে, নিজেকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দিতে নেমে এসেছিলেন রোজ। এ কি শুধু আকুতি না বীরত্ব - তাও হিসাব করা কঠিন। কারণ এটা কখনই প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি নিয়মিত ঘটনা নয়। মাঝে মাঝে শুধু ঘটে পৃথিবীতে। আর একটি ঘটনা একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকে।
যেমন চীনের তিয়েন আন মেন স্কয়ারের ট্যাঙ্ক ম্যান। আজও পৃথিবী তার নাম জানে না। নাম না জানা এই আন্দোলনরত তরুণ এখনও ট্যাঙ্ক ম্যান নামেই পৃথিবীতে পরিচিত। ১৯৮৯ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে যখন চায়নার তিয়েন আন মেন স্কয়ারে নেমে এসেছিল লাখ লাখ ছেলে মেয়েরা। সে ছিল পৃথিবীর পরিবর্তনের একটি মুহূর্ত, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সামরিক বাহিনীর বিপুল সমরাস্ত্রের কাছে জীবন দিতে দিতে এক সময়ে নিঃশ্বেষ হয়ে গিয়েছিল সেই আন্দোলন। সে আন্দোলন এখন ইতিহাসের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়। তার সব কিছু ঢাকা পড়ে গেছে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচারে। তবে তারপরেও এই সকল প্রচার ভেদ করে, সকল সত্য উন্নয়ন ভেদ করে মাঝে মাঝে ইতিহাসের পাতায় উঁকি দেয় ৫ জুন ১৯৮৯। এ দিন আজও যার নাম জানা যায় না, সারা পৃথিবীতে ইতিহাসের যারা খোঁজ রাখেন তাদের কাছে তিনি ট্যাঙ্ক ম্যান নামে পরিচিত। আসলে সে ছিল ২১ থেকে ২২ বছরের এক তরুণ। তিয়েন আন মেন চত্বরে অবস্থান নেয়া লাখ লাখ ছাত্রকে হত্যা করার জন্যে যখন চীনের সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক বাহিনী এগিয়ে আসছিল, তখন এই তরুণ একাই ট্যাঙ্কের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থামিয়ে দিয়েছিল সেই ট্যাঙ্ক বহরের গতি। স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেই ট্যাঙ্ক বহর। সেদিন কোনো সোশ্যাল ফোরাম বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তখন পৃথিবী জুড়েই মিডিয়ার সংখ্যা কম। তারপরও এপির ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরায় ধরা পড়ে সে ছবি। আর এই ছবি সেদিন লিড নিউজ হয়েছিল পৃথিবীর বড় বড় সব পত্রিকায়। তাছাড়া তখন পৃথিবী জুড়ে ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকার যুগ, ফার ইর্স্টান ইকোনমি রিভিউ থেকে নিউজউইক-এর কভারেও ছিল এই ছবি। এ কোনো তরুণের ছবি ছিল, না কি বীরের ছবি ছিল, তা হয়তো আজও হিসাব হয়নি। এমনকি তার সকল শক্তি কি একজন আন্দোলনকারীর শক্তি, না গণতন্ত্রের শক্তি তাও চিহ্নিত হয়নি। তারপরেও হাজার বছর পরের ইতিহাসেও স্থান পাবে এই ছবি।
১৯৮৯ সালে এমন একটি ছবির সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে সেদিন কেন যেন সেই ছবিটি গুরুত্ব পায়নি। এমনকি এই নিউজটিও সেদিন বিবিসি বাংলা ছাড়া প্রকৃত গুরুত্বের সঙ্গে কেউ প্রকাশ করেনি। সে ছবির নায়ক ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবীরা সেদিন ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিলেন। এই প্রতিবাদ সমাবেশ ঠেকানোর জন্যে তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদ ওই স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করেন। যে কারণে অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং আইনজীবীরা সেখানে দাঁড়াতে পারেনি, পুলিশ ও আর্মড পুলিশের ব্যরিকেডের কারণে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেখানে রিকশা করে আসেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি রিকশা থেকে নামলে পুলিশ তাকে জানায়, এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এখানে দাঁড়ানো যাবে না। বেগম সুফিয়া কামাল তাদের কোনো কথায় কান না দিয়ে সেখানে কোমরে আঁচল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং একাই স্লোগান দিতে থাকেন: ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না’, ‘অবিলম্বে এরশাদের পদ্যতাগ করতে হবে’, ‘এরশাদের গদিতে, আগুন জ্বালো এক সাথে’। একা। বেগম সুফিয়া কামাল তার সেই সত্তরোর্ধ বয়সে সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে শুধু সেখানে রাজনৈতিক স্লোগানই দেননি, তিনি সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী বক্তব্যও রাখেন।
বাস্তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সব সময়ই সম্মিলিত আন্দোলন। তারপরেও এই আন্দোলনের ইতিহাসে দেশে দেশে দেখা যায় কখনও কখনও কোনো একজনের বীরত্ব আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে। হয়তো যারা ইতিহাস লেখেন, তারা সব সময়ই এ বীরত্বকে মনে রাখেন না। বা ওইভাবে তুলে আনেন না। নিজ নিজ জাতিও তাদের খুব বেশি যে মনে রাখে, তা নয়। তবে যে কোনো আন্দোলনের এই ল্যান্ডমার্ক এটাই শুধু প্রমাণ করে দেয়, ওই আন্দোলনের সঙ্গে একটি প্রাণের চাহিদার যোগ আছে। যে কারণেই কারও কারও প্রাণের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা বীরত্বই আন্দোলনকে চিরকালের এক ল্যান্ডমার্কে নিয়ে যায়। ইতিহাস খুঁজলে এমন হয়তো আরও অনেক মিলবে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের এই তিন ঘটনা হয়তো ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেয়নি। তবে আন্দোলনকে চিরকালের ইতিহাসে নিয়ে গেছে।