বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের বর্ষপূর্তি হয়েছে। গত বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। অবশ্য বিশ্বহিসাব ধরলে করোনার বয়স প্রায় ১৫ মাস হয়েছে। ২০১৯ সালের শেষদিনে চীনের উহানে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বাংলাদেশে আসতে সময় লেগেছে দুই মাসেরও বেশি। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বকেই প্লাবিত করে করোনার ঢেউ। এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনা কেড়ে নিয়েছে ২৬ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ। বাংলাদেশে সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার। প্রতিটি মানুষের মৃত্যুই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ঘনবসতি এবং করোনার ভয়াবহতা বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা কমই বলতে হবে।
ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোতে করোনা যে মৃত্যুর মিছিল শুরু করেছিল; আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশেও তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু সে আশঙ্কা সত্যি হয়নি। কেন হয়নি, তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা বা উত্তর নেই। নানান মত আছে, গবেষণাও আছে। তবে বাংলাদেশ কোনো একটা প্রাকৃতিক সুরক্ষা পেয়েছে নিশ্চয়ই। প্রস্তুতির জন্য দুই মাসেরও বেশি সময় পেলেও বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে পারেনি। বরং করোনা আসার পর বাংলাদেশে অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত হয়েছিল। করোনার বর্ষপূর্তির দিনে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখনকার পরিস্থিতিটা তুলে ধরেছেন দারুণভাবে, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে অব্যবস্থাপনা ছিল বলে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এবং সমালোচনা করেন। কিন্তু আমি তো বলব, তখন তো কোনো ব্যবস্থাপনাই ছিল না, অব্যবস্থাপনা তো দূরের কথা।
নতুন একটি মহামারি নিয়ে সারাবিশ্বই বিপর্যস্ত ছিল, কোথাও কিছু বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না, কোনো উপকরণ পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপরও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এসব মোকাবিলা করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে এসেছি, যার প্রশংসা মিলছে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অল্পকথায় পুরো চিত্রটা তুলে এনেছেন। শুরুতে কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকলেও দ্রুতই বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে। করোনার অব্যস্থাপনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সব মানুষের জন্য টিকা কার্যক্রম চালিয়ে দারুণ ব্যবস্থাপনায়, উৎসবমুখর পরিবেশে এর সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু সেই টিকাই আমাদের জন্য হিতে বিপরীত হচ্ছে?
শীতে করোনার প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা করা হলেও, তা সত্যি হয়নি। বরং বাংলাদেশে সংক্রমণের হার কমে আসছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের হার অল্প অল্প করে বাড়ছিল। কিন্তু গত ৯ মার্চ সংক্রমণের হার ৫ শাতাংশের বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায়। এর আগে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের ওপরে ছিল সর্বশেষ ১৮ জানুয়ারি। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহ সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশে টানা প্রায় দুই মাস শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল, পরিস্থিতিটা বেশ স্বস্তিদায়কই ছিল। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার আস্তে আস্তে বাড়ছিল। চারদিন হার ছিল ৪ শতাংশের ওপরে। আর ৯ মার্চ সেটা ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
সংক্রমণের হার কেন বাড়ছে, এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানান মত আছে, ব্যাখ্যা আছে। তবে আমার ব্যখ্যা হলো, টিকা আসার পর আমাদের সবার মধ্যে একধনের শৈথিল্য চলে এসেছে। আমরা ধরেই নিয়েছি, টিকা যেহেতু নিয়েছি, তাই আমার আর ভয় নেই। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, করোনা ভাইরাস চলে গেছে। আমাদের আর কিছু মানতে হবে না। করোনায় আমরা যে ‘নিউ নরমাল’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলাম, সেটা ফেলে আমরা আবার ‘নরমাল’ জীবনযাপনে ফিরে যেতে চাইছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও খোলেনি। এছাড়া বাকি সবকিছুই স্বাভাবিক। শহরেও মাস্ক ব্যবহারের সংখ্যা কমে এসেছে। বাস-ট্রেনে উপচেপড়া ভিড়। বিয়ে-শাদি থেকে শুরু করে সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে জনসমাগম বাড়ছে। কোনো অনুষ্ঠানেই সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা পরিবারের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
২১ ফেব্রুয়ারির সময় পাওয়া তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে নাকি ১০ লাখ লোক গিয়েছিল। সমুদ্রসৈকতে সুই ফেলার জায়গা ছিল না। এ কারণেই আমি বলছি, টিকার দারুণ ব্যবস্থাপনাই কি আমাদের জন্য হিতে বিপরীত হচ্ছে। টিকা থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস আমাদের সুরক্ষা ভাবনায় যে শৈথিল্য এনেছে, তার ফাঁক গলেই বাড়ছে করোনা। করোনা সংক্রমণের হার যদি ৫ শতাংশের ওপরে থাকে তাহলে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ বজায় রাখা কঠিন হবে।
বিশ্বের অনেক দেশ এখনও টিকার দেখা পায়নি। উন্নত অনেক দেশেই টিকা পাওয়া রীতিমতো লটারি জেতার মতো। সেখানে বাংলাদেশে ৪০ বছরের বেশি বয়সী সবাই চাইলেই নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারছেন। যদিও মাত্র ৫০ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন। এখনও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের একটা বড় অংশ টিকা সুবিধা নেননি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং দরিদ্র মানুষ টিকার ব্যাপারে বেশ উদাসীন। এই শৈথিল্যই আমাদের জন্য কাল হতে পারে।
করোনা যতটা শারীরিক সমস্যা, ততটাই মানসিক। করোনা ভাইরাস আসলে আমাদের সঙ্গে একটা চোর-পুলিশ খেলে। আপনি যদি আতঙ্কে কাবু হয়ে যান, তাহলে করোনা আপনাকে পেয়ে বসবে। আবার করোনাকে যদি একদম ভয় না পান, তাও আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে। তাই করোনা ভয় পাওয়াও যাবে না, আবার একদম উদাসীন থাকাও যাবে না। এটা ঠিক আমাদের আর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে করোনা পূর্ব অবস্থায়ও আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সাবধানতাই করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আর সাবধানতাগুলো কিন্তু আমরা সবাই জানি। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। জনসমাগমে যেতে হলে অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আর পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলতে হবে। এইটুকু সাবধান থাকতে না পারলে কিন্তু করোনা আবার আমাদের ওপর চেপে বসতে পারে। এরইমধ্যে যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যেকোনো মূল্যে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে বজায় রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।