‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাফনের কাপড় পরে মানববন্ধন’। গত ১ মার্চ এই শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে ছবিসহ নিউজ ছাপা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামাতে একদল প্রতিবাদী মানুষ এভাবেই রাস্তায় নেমে আসেন। ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সিলেটের রশিদপুরে কাফনের কাপড় পরে মানববন্ধন করেছে সচেতন বিশ্বনাথ সমাজকল্যাণ সংস্থা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই এলাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আটজন নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সংগঠনটি ২৮ ফেব্রুয়ারি এই কর্মসূচি পালন করে। এসময় তারা স্পিড ব্রেকার নির্মাণ, ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন, সড়কবাতি স্থাপন, রোড ডিভাইডারের মাধ্যমে পৃথক লেন এবং দূরপাল্লার বাসে দুইজন করে চালক রাখার দাবি জানান।’
ছবিতে যে তারিখে সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এ দিন সারা দেশে সড়কে প্রাণ গেছে ২৬জনের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন তথ্যের বাইরে আরও যেসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে তা হয়ত অজানাই থাকবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দেশে দুর্ঘটনা বা প্রাণহানি এ তো নতুন কিছু নয়। এর প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ, দাবি-দাওয়া তুলে ধরাও নতুন নয়। সংকট সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এরচেয়ে বড় সত্য হলো দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার যেন কিছুতেই কমছে না, বাড়ছে।
প্রশ্ন আসে তাহলে সংকটটি কোথায়? আমরা কেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি? এককথায় যদি বলা হয়- দুর্ঘটনারোধে স্বল্পমেয়াদি যেসব পদক্ষেপে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব- তা একেবারেই কার্যকর করা যাচ্ছে না। তবে কী বলব? জাতীয় এই সমস্যাটি সরকারের ভেতর থেকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ অনুভব করা হচ্ছে না।
সিলেটে কাফনের কাপড় পরা প্রতিবাদী মানুষগুলোও সরকারের কাছে করণীয় তুলে ধরেতে পেরেছেন। তাহলে প্রকৃত অর্থে কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব তা সরকারের নীতিনির্ধারকরা বোঝেন না, তা হতে পারে না। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় গুরুত্ব অনুভব না করার।
ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখের পর পরবর্তী ১৬ দিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন রাস্তায় যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৯০ ভাগের বেশি। অর্থাৎ সড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাড়ছে। এটা নিরাপদ সড়কের ক্ষেত্রে শুভ লক্ষণ নয়। চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা থেকেই এই ধরনের দুর্ঘটনা বেশি। স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বলছে, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, চালকের অদক্ষতা, এক লেনে গাড়ি চলাচল, স্বল্প গতির যানবাহন এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
এজন্য সড়ক মহাসড়কে বিআরটিএসহ জেলা ও হাইওয়ে পুলিশের তদারকি ও তৎপরতা প্রশ্নাতীত নয়। কেউ বলতে পারবেন না দায়িত্বশীলরা সড়ক নিরাপদ করতে বলার মতো কোনো কাজ করে দেখিয়েছেন। ফলে চালকরা ইচ্ছেমতো যানবাহন চালাচ্ছেন। এ কারণেই দুর্ঘটনা। মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রতিদিন আসছে একের পর এক মৃত্যুর খরব। বাস্তবতা হলো, এখন সড়কে চালকদের লাইসেন্স দেখার পর্যন্ত কেউ নেই! একারণে গোটা পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা দৃশ্যমান।
এ সংক্রান্ত সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর মতো আমাদের দেশের সড়কগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে। ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সড়কের সব রকমের অব্যবস্থাপনার সংকেত দেবে। যার মাধ্যমে রাস্তায় অনেকটাই শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএসহ হাইওয়ে এবং জেলা পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো বা দুর্ঘটনা হ্রাসে প্রথম দায়িত্ব পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএর। তারপর পুলিশ বিভাগের। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্য কোথাও বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট বা ইন্সপেক্টর নেই। ভাবা যায়! এ দুই বিভাগে যা-ও আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মূলত, একারণেই তাদের পক্ষে দেশজুড়ে কোনোরকম তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের সব জেলা উপজেলায় অভিযানের জন্য জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ের ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সুযোগ হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে অভিযান পরিচালনা করেন। এভাবে কি সড়কে শৃঙ্খলা আসবে? নাকি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। তাহলে আমরা বছরজুড়ে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ শুনেই যাব? না। প্রকৃত অর্থে এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও আন্তরিক ভূমিকার প্রকাশ মানুষ দেখতে চায়। যার মধ্য দিয়ে সড়ক অনেকটাই নিরাপদ হবে।
বিআরটিএ বলছে, জনবল সংকটের মুখে সড়ককে নিরাপদ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সিসি ক্যামেরা স্থাপন। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার পাশাপাশি মালিক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের সচেতনতাই পারে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ নব নিযুক্ত সচিব মো. সরওয়ার আলম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সংস্থার পক্ষ থেকে সারাদেশের সড়ক-মহাসড়ক দেখভালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। দুর্ঘটনা হ্রাস ও রাস্তায় শৃঙ্খলা আনতে সড়ক মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ক্যামেরা বসানো হলে ঘরে বসেই সড়কের অনেক কিছুই দেখভাল করা সম্ভব। মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, উন্নত অনেক শহরে দেখেছি রাস্তায় ট্রাফিক নেই। কোনো চালক বেপরোয়া চালানো বা দুর্ঘটনা ঘটালে এমনকি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে কন্ট্রোল রুম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। চালকদের দোষ থাকলে লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা, লাইসেন্স স্থগিত-বাতিলসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমাদেরও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। তাছাড়া হাইওয়েতে ডাকাতি, গাড়ি চুরিরোধসহ রাস্তায় যেকোনো অপরাধ দমনে সিসি ক্যামেরা অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে’।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সকলের সহযোগিতা নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। বিআরটিএতে জবল বাড়ানো ও দক্ষ জনবলের অভাবের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, দক্ষ জনবল বাড়ানো সম্ভব হলে আমাদের অনেক বিষয়ে উন্নতি হবে। যার সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব দেখতে পাব সড়কে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি ও দুর্ঘটনা হ্রাসে’।
দেশের কোনো জেলা-উপজেলায় বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করার জন্যও অনেক জেলা কার্যালয়ে কোনো গাড়ি নেই। তাই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বা তদারকি একেবারেই সম্ভব হয় না। জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দুর্ঘটনার ডাটাবেজ পর্যন্ত নেই। পুলিশের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয়! এভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১০টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে যাত্রী অধিকার আদায়ে নিয়োজিত একটি সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। দুর্ঘটনা কমাতে এই সংগঠনের দেয়া সুপারিশগুলোকে আমলে নেয়া যেতে পারে।
সর্বোপরি কথা হলো স্বল্পমেয়াদি যেসব উদ্যোগে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত। আশাকরি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সিলেটের সড়কে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো মানুষগুলোর প্রতিবাদের ভাষা, পরামর্শ দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছাবে। সে অনুযায়ী আমরা দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে পাব।
লেখক: অধিকারকর্মী, সাংবাদিক